বি শে ষ র চ না
কবিতা নকশাকাঁটা সেলাই। যে যত যত্নে ফোঁড় তোলে ততো সুন্দর জেগে ওঠে টলটলে জল, পদ্মপাতা, মৌচাক, অপরাজিতা, রুক্ষ চুলের মেয়েটা। আবহমান এই বেঁচে থাকার মধ্যেই থাকে সময়। তাকে ধরে রাখতে আঙুলের ডগায় ছুটছে সবাই। কেউ পিছিয়ে পড়ছে, কেউ দৌড়োচ্ছে। যারা পারছে না তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেউ বা ‘যাঃ হলো না’ বলে পেন রেখে খেয়ে নিলো দু কাপ চা আর সিগারেট। আবার কে যেন কিছুই হয়নি, বাকি আছে কতো ভেবে আবার ছুটলো। তা এই পিছিয়ে পড়া দলের লোকজন গভীরভাবে যখন জলের মধ্যে দেখে নেয় নির্মল রঙের সত্যি, তখনি পাড়ায় রে রে করে উঠে মা কাকিমারা চেঁচায়, কী রে শুনলাম নাকি তুই কবি হয়েছিস? পাশের বাড়ির সমীরবাবু চশমা নামিয়ে বলেন, তা খোকা কবি হয়ে কি মালকড়ি পাচ্ছো? অথবা পিসিমা রান্নাঘরে শুকনো লঙ্কা, হিং ফোড়নে ডাল ঢালতে ঢালতে ফিক ফিক করে হেসে বলেন, ‘বলি অ খোকা… অমন হয়, এ বয়সে হয়!’
আচ্ছা, কবিতা কত প্রকার বলুন তো? এক্ষুণি বলবেন অমন করে হিসেব খয়রাতি করে নাকি। এই তো করলুম… এক ধরনের কবিতা হলো ইনস্ট্যান্ট ম্যাগি নুডলস থুড়ি পুডল। ওই জমা জলে ঢোঁড়াসাপ। দেখলাম আর লিখলাম। আরেক ধরনের কবিতা একখানা ছন্নছাড়া লাইন দিয়ে পালাল। লে হালুয়া, দিন মাস বছর পেরোয়। তাকে কোথায় রাখি, কোথায় ফেলি। হঠাৎ কোনো এক বৃষ্টিমেদুর সন্ধ্যে, খসখস ছপছপ। একরাশ ব্যাঙ কোঁকরকো করে ডাকছে। লাইনটাও নিয়ম মেনে ঢুকে পড়লো। একে বলে আইনত অনুপ্রবেশ। এক্কেরে লুকিয়ে দেশে ঢুকে তারপর সবার অলক্ষ্যে ভোটার লিস্টে নাম তুলে আত্মপ্রকাশ। তা এই অপেক্ষাটুকু নিয়ে বাঁচা। তাহলে যারা বলে কবিতা লিখতে হলে কী করতে হবে। সাফ কথা, অন্য রাস্তা দেখুন মশাই। এখানে কোনো গ্যারান্টি নেই।
কবিতা ছাড়া অন্য কিছু পারবো না এইটে কখনো বলবো না। অন্য কিছু হলেও এই বান্দা সহজে ধরা দেবে না। চাতক পাখির মতো বসে থাকো বছর ধরে। তারপর খানিক প্রতিক্রিয়া সবারই চাই বইকি। মুখে, হে হে, না না তেমন কিছু না। এ বলে কী আর পেট ভরে?
তার মধ্যে যদি কেউ আবার তোমার গোদা খাতা খুলে ধরিয়ে দিলো গুচ্ছখানেক ভুল। ভেবেছিলে যা লিখবে লোকে বাহ বলবে… কারা যেন আবার ধুয়ো তুললো কানে শোনো, মকশো করো, ছন্দে লেখো, অন্ত্যমিলে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। মালমশলা, পাঠক, রুচি, কারিগরীবিদ্যা সব ছেড়ে বেরিয়ে চলে আসতে ইচ্ছে করছে। থাক তবে, এতসবের কী বা প্রয়োজন।
জীবনানন্দের একটি লাইন মনে পড়ছে: ‘কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে’। রে রে করে কারা যেন বলবেন সাধু চলিত, গুরুচন্ডালি। জীবনানন্দ বলবেন, নিকুচি করেছে। বাংলা ভাষা কানের ভাষা। এখানে শুনে শুনে কান তৈরী করতে হয়। হাঁটিতেছি আর হেঁটে চলেছি— পার্থক্য আছে বটে। হাঁটিতেছি হাজার বছরের সময় নিয়ে, এমন নদী সময়কে ধরে না। পিছু পিছু চলে। হেঁটে চলি ক্লান্ত হয়ে বসে মাঝে মাঝে। খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প যেন ঠিক।
অঙ্ক খাতার ফাঁকে চিঠি, উত্তর আসবে কি না ঠিক নেই। সাইকেলটা মাঠের ওপাশ দিয়ে ঘোরাতে হবে প্রতি বৃহস্পতিবার। যদি এক ঝলক, একবার… মাথার ভেতর ট্রালা…লালা…লা! মদ খেয়ে মাথা ফাটিয়ে লোকটা বসে আছে সিড়িতে। বউয়ের করুণ গলা, ‘কিয়ু পিতে হো রোজ?’ …‘বধুয়া! তু নেহি সমঝেগি।’
পুকুর থেকে চান করে উঠে পিছু ফিরে মায়ের অত সুন্দর চেহারা দেখে ফেলে দৌড়োনো, রাতে বিছানার চাদর কলের জলে ঘষে আনা। ছি ছি কেউ জেনে গেলে। সাবিনা, সাবিনা কহা গয়ি তু? আজ বড়া সা মেহফিল হ্যায়, চলে। হ্যাঁ হ্যাঁ সব কিছু লিখে ফেলেছে কেউ না কেউ। তাহলে আর কী লিখবে তুমি? কবিতা শেষ? স্টক আউট অফ অর্ডার? না না দেখো অন্যভাবে দেখো। দুঃখ পাও এখনো, কাঁদতে পারো? ছুঁতে পারো… যা কিছু অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে? বিস্মিত হয়ে দেখো। তোমার বিস্ময় শেষ হলে ছোটা শিখে যাবে। তখন কী করে লিখবে?
এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবে সাঁকো পার করে। মাঝখানে আস্ত নদী। ভেসে গেলে ধাক্কা খাবে মরা গোরু, আধপোড়া কাঠ, না পোড়া নাভি আর পচা কচুরিপানার সাথে। বুক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভয় নিয়েও কেন লিখতে পারছো না? এখনো কি তুমি সেই হিসেবী পরিণত বুদ্ধির কাঠপুতুল? কারোর মৃত্যুতে এতটুকুও আশ্চর্য হও না। নাকি জানোই যে কবিতা আসলে ছেড়ে যাবেই। মাথায় উঠিয়ে তাকে প্রশ্রয় দিলেও প্রেমের মতোই হাত ফসকায় সে।