ছো ট গ ল্প ১
এক
লাঞ্চের অনেক আগেই পিওন বাদল টেবিলে এসে বলে গিয়েছিলো – ‘বস্ ডাকছে।’
আকাশ যখন বসের চেম্বারের দরজা ঠেলে ‘আসব স্যার?’ বললো, ঘড়িতে তখন তিনটে কুড়ি। গলার আওয়াজ পেয়ে পাল সাহেব মুখ তুলে তাকালেন এবং আকাশকে দেখেই তাঁর ভ্রূজোড়া বেশ কুঁচকে গেল। তবু শান্ত স্বরে আকাশকে বললেন– ‘আসুন, বসুন।’ ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’– বলে একটা চেয়ার টেনে আকাশ বসলো। একটা পেপার ওয়েট নিয়ে টেবিলের কাচের ওপর পাল সাহেব ঘোরাতে লাগলেন, মুখ নিচু। এটা পাল সাহেবের মুদ্রাদোষ। কোনো ব্যাপার পছন্দ না হলেই উনি এটা করে থাকেন। আকাশও জানে। তাই ও চুপচাপ বসে রইলো। ‘আপনার কি শরীর খারাপ?’– আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে পাল সাহেব প্রশ্ন করলেন। ‘কই না তো! ঠিকই তো আছে!’– আকাশের জলদি জবাব। ‘ওয়েল মি: মিত্র, সেক্টর সেভেনের এস্টিমেটটা একটু ইনকমপ্লিট আছে। সবটা প্রায় হয়েই আছে, ফাইনাল ক্যালকুলেশনটা বাকি।’ বলতে বলতে ডানদিকের ড্রয়ার থেকে ফাইলটা বার করেন পাল সাহেব। তারপর আকাশের দিকে ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলেন– ‘আমি সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত আছি। যাবার আগে এটা কমপ্লিট করে আমাকে দিয়ে যাবেন, ও.কে? ‘
ফাইলটা নিয়ে আকাশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে। মিনিট কয়েক চুপ। তারপর ফাইলটা টেবিলে রেখেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–’আমি পারবো না স্যার।’
–’মানে?’ কিঞ্চিৎ উত্তেজিত পাল সাহেবের গলা। একটু অবাকও বটে। একটা সামান্য ফাইনাল ক্যালকুলেশন। বড়ো জোর ঘণ্টা খানেক লাগতে পারে। আর আকাশের মতো ডিপেন্ডেবল এমপ্লয়ী বলছে– পারবে না?
‘আমি এখন পারবো না স্যার’– আকাশ আবার বলে।
– তা কেন পারবেন না মি: মিত্র?
– আমি এখন বাড়ি যাবো।
– বাড়ি? এখন? দরকারি কাজ ফেলে?
– আমাকে যেতেই হবে।
– কিন্তু কেন? এনি প্রবলেম?
– না, প্রবলেম তেমন কিছু নয়। আসলে পরশু আমার ছেলের ভর্তির ইন্টারভিউ। বেস্ট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্যার। ক্যাপিটেশন ফি আমি তো দিতে পারবো না, তাই আমিই ছেলেকে আর তার মাকেও তৈরি করছি।
– ‘মাকেও?’ পালসাহেব বিস্ময় চেপে রাখতে পারেন না। ‘ছেলের সঙ্গে বাবা মায়েরও ইন্টারভিউ হবে স্যার। চান্সটাও নিতেই হবে। আমি আজ যাই স্যার। প্লীজ ফরগিভ মি।’ এরপর আর একটিও কথা না বলে আকাশ আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে চেম্বার থেকে। দরজা আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়।
এবার পাল সাহেব কি খুব রেগে যাবেন? আবার ডেকে পাঠাবেন আকাশকে? এক্ষুণি কাজটা করে দিতে বলবেন? বাচ্চা ছেলের একটা ভর্তির পরীক্ষা, তার জন্য এতো? এসি ঘরে হতভম্ব মুখ করে পাল সাহেব বসে রইলেন।
দুই
– অ্যাই শোনো! তুমি বাপিকে স্কুলব্যাগটা দিচ্ছ কেন?
– বা রে, যদি কিছু লিখতে টিখতে বলে, তাই পেন্সিল বাক্সটাও নিয়ে নিলাম।
– আস্ত আনস্মার্ট! হবে ভাইভা, নিচ্ছে পেন্সিলবক্স। নাহ্, এতোদিন কোলকাতায় থেকেও তোমার ঐ গাঁইয়া স্বভাবটা আর গেল না। শোনো, এটা যে সে স্কুল নয় রে বাবা, তোমার জ্ঞানদাময়ী উচ্চতর তো নয়ই।
– আজ তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছো যেন তুমি দার্জিলিংয়ের ডন বস্কো’র– হুম্। ঠিক আছে, ঠিক আছে , আমার শাড়ী পরা হয়ে গেছে। আমি আসছি।
– হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি করো। রাস্তায় আবার জ্যাম ট্যাম হলে, বলা তো যায় না। বাপি, এদিকে আয় তো। দেখি তোর জুতো দেখি। হ্যাঁ, একদম চকচক করছে। খেয়াল রাখবে, নোংরা যেন না লাগে, বলে দিলাম। শু ইজ দ্য ফার্স্ট ইমপ্রেশন অব এ পার্সন, ওকে?
– ও. কে. স্যার। আই য়্যাম রেডি।
– থ্যাংক য়্যু মাই সন্। স্মার্ট বয়। কই গো? তোমার হলো? আমরা রেডি কিন্তু।
– যাচ্ছি রে বাবা, যাচ্ছি। ইন্টারভিউ তো নয় – যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
– দ্বিতীয় হয়ে গেছে। এটা তৃতীয় হতে যাচ্ছে।
– এই যে, এসে গেছি, রেডি।
– ওমা! একি? এতো গর্জিয়াস শাড়িটা পরতে কে বলেছে? বউভাতে যাচ্ছো নাকি? মফস্বলী ভূত কোথাকার। কোথায় কি পরতে হবে, বলতে হবে… নাহ্, কিচ্ছু শিখলে না এখনও।
হাসিখুশি প্রতিমার মুখটা মুহূর্তে কালো হয়ে গেলো। ও পেছন ফিরেই ভেতরের ঘরে চলে যাচ্ছিল। আকাশ চট্ করে বলে – অ্যাই, শোনো শোনো।
– বল, শুনছি।
– আহ্ কাছে এসো না। আরো কাছে। তোমার ওই সবুজ ঢাকাই তাঁতটাই পরে নাও। দারুণ লাগে তোমাকে। ওরা কিন্তু সব লক্ষ্য করবে। হ্যাঁ, আর এই কোমরের কষিটা একটু নিচে নামাও।
এই বলে নিজের বউয়ের মুড ঠিক করতে নরম ফরসা পেটটা একটু খাবলে ধরে আকাশ।
– আহ্ কী হচ্ছে কী? বাপি রয়েছে না?
প্রতিমার মুডটা আবার ক্রমশ ঠিক হয়ে আসে।
– তোমরা রিক্সা ডাকো, আমার হয়ে যাবে।
তিন
সবুজ রঙের বড়ো লোহার গেট। বন্ধ। মাঝখানে ছোটো গেট। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। আর ঠিক ঐখান দিয়েই একটা নেপালি মুন্ডু একবার করে বেরোচ্ছে এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা বা পুরুষমানুষটির কাছ থেকে ইন্টারভিউ লেটারের ডেট চেক করে ভেতরে ঢোকাচ্ছে।
অন্তত জনা তিরিশের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো আকাশ, প্রতিমা ও বাপি। বেশ গরম দমকা হাওয়া বইছে থেকে থেকে। অনেকের মতো আকাশও তার বউ বাচ্ছাকে বললো – ‘’তোমরা ঐ বড়ো দোকানটার শেডে গিয়ে দাঁড়াও। আমি লাইনে আছি।’’ মা ছেলের হাত ধরে শেডের আশ্রয়ে চলে গেল। গুটিগুটি পায়ে লাইনও এগোচ্ছে। এদিকে বাপি এতো ভিড়ের মধ্যেও ঐ দোকানের শো-কেসে ক্যাডবেরী দেখে ফেলেছে। বাপি দেখল জেদ দেখাবার এই সুযোগ, পরে কি হয় বলা তো যায় না। তাই ও জেদ ধরলো — ‘ক্যাডবেরী কিনে দাও এক্ষুণি।’ যতো প্রতিমা বলে –‘ইন্টারভিউ এর পরে কিনে দেবো ঠিক ‘, ততো বাপির গলার স্বর চড়ে — ‘না, এক্ষুণি দিতে হবে।’ অন্য মায়েরাও দেখছে দু’জনকে। দৃশ্যতই দরদর করে ঘামতে থাকে প্রতিমা। মাও দেবেনা, ছেলেও নাছোড়। শেষমেষ রফা হলো — ‘ঠিক আছে আমি ক্যাডবেরী কিনছি, তবে এটা থাকবে আমার কাছে। ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়ে তবেই তুমি হাতে পাবে, ঠিক আছে?’ পুরোটা না হলেও তখনকার মতো অর্ধেক জয়ে শান্ত হল ছেলে। প্রতিমা সবে ক্যাডবেরীর দামটা মিটিয়েছে, ওমনি আকাশের ডাক – ‘’কই গো তোমরা কোথায়? এক্ষুণি কাছে এসো। ওঁর পরেই আমাদের ডাক।’’ তাই হলো। ঘামতে ঘামতে প্রতিমা ছেলেকে নিয়ে গেটের কাছে আসতেই সেই নেপালি লোকটা বললো — ‘ঐ দূরের বেঞ্চিতে গিয়ে বসুন, সময় হলে ডাকবো।’
আধঘন্টার কিছু বেশি হয়েছে, তিনজন পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসে। আকাশ বড় বড় চোখ করে বউকে ইঙ্গিত করছে – ‘আহ্ ঘাম মোছো, ঘাম মোছো।’ শেষে কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলো – ‘কি ব্যাপার? এত ঘামছো কেন?’ প্রতিমা বলল — ‘জানি না।’ ‘মুখ মোছো, চুলটা ঠিক করো, টেক ইট ইজি। আর বাপি? যা যা বলে দিয়েছি সব মনে আছে তো?’ ‘ইয়েস স্যার’ — বাপির সপ্রতিভ উত্তর।
‘মিসেস অ্যান্ড মিস্টার আকাশ মিত্র।’ স্কার্ট পরা অল্পবয়েসী একটি মেয়ে করিডোরের ও প্রান্ত থেকে বেশ চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় ডাকলো।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রেজেন্ট ম্যাডাম’ বলে দাঁড়িয়ে উঠে ডানহাতটা উঁচু করে বলল আকাশ, যেন ও জলে ডুবে যাচ্ছিল। তাই দেখে একটা অদ্ভুত সুন্দর অবজ্ঞার হাসি হাসল মেয়েটি। বলল, ‘আমার কাছে এসে দাঁড়ান। আপনারাই নেক্সট, কেমন?’ আকাশরা তিনজনে মিলে গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল — ‘ও. কে., ও. কে. ম্যাম।’
এরপর দরজা খুলে আগের পরিবারটি বেরিয়ে যেতেই সেই অল্প বয়সী মিষ্টি মেয়েটি চোখ দিয়ে একটা বাঁকা ইঙ্গিত করল। ভাবটা যেন ‘আসলে কি হবে তো আমি জানি, ঢুকে যাও।’ এবারও একটা অদ্ভুত অপমানের গন্ধ পেল আকাশ।
মন থেকে ওসব সরিয়ে নিজের ফোকাস ঠিক করলো আকাশ। তারপর হাসি হাসি মুখে বললো — ‘মে আই কাম ইন স্যার?’ ‘ওহ ইয়েস ইয়েস, এভরিবডি কাম ইন।’’ — মধ্যিখানে বসে থাকা সবচেয়ে প্রবীণা মহিলাটি আকাশদের আমন্ত্রণ জানালেন সরল হাসিমুখে। বাপি বললো – ‘মে আই সিট ম্যাম?’ ‘ওহ্ সিওর সিওর। বসুন বসুন আপনারা।’’ আকাশরা বসলো। টেবিলের ও প্রান্তে তিনজন মহিলা একজন পুরুষ। ঘরে হাল্কা এসি চলছে। এই ঠান্ডাটা প্রতিমার খুব ভালো লাগলো। তবু কেন জানিনা তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ। আর ঠিক তখনই প্রধানা ঐ মোটাসোটা মহিলা প্রতিমাকে লক্ষ্য করেই বললেন — ‘একটু জল খান, ভালো লাগবে।’ ব্যস, আর একদম দেরি না করে সামনে রাখা কাচের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে একটু ঢক্ ঢক্ শব্দ করেই জলটা পুরো শেষ করলো। তারপর একটা তৃপ্তির আহ্ হালকা শব্দ বেরিয়ে এলো প্রতিমার বুক থেকে। বাপি আর আকাশ জল খায়নি। আকাশ চোখ দিয়ে ছেলেকে না করেছে।
মি: মিত্র, কেন জানিনা, আপনাকে আমার খুবই চেনা চেনা লাগছে। – মহিলা বললেন।
– আমাকে? হেসে ফেলে আকাশ। হাসলে আকাশকে সত্যিই সুন্দর দেখায়, ওর গজ দাঁতটির জন্য।
– ইয়েস মি: মিত্র। আপনাকে। কোথায় দেখেছি দেখেছি লাগছে, ভেরী রিসেন্টলি। এক্ষুণি ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু দেখেছি। যাই হোক, আপনি তো সার্ভিস করেন অ্যাম আই রাইট?
– ইয়েস ম্যাম।
– দেখুন মি: মিত্র, প্রথমেই ব্যাপারটা আর একবার পরিষ্কার করে নিই। আমাদের টিচিং বিট এক্সপেনসিভ। অন্যদের তুলনায় আমাদের স্কুলের পড়ানোর খরচটা সত্যিই রিমার্কবলি বেশি। তাই…।
– নো প্রবলেম ম্যাম।
– ভেরি গুড। তা আপনি কোন ডিপার্টমেণ্টে আছেন কাইন্ডলি বলবেন?
– আজ্ঞে আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রাইভেট ফার্মের ঠিক কোন পোস্টে আছেন?
– আমি ইউডিসি।
– অ। মহিলার গম্ভীর প্রকাশ।
– তাছাড়া আমি একটু লেখালেখিও করি, অভিনয়ও করি।
– লেখালেখি মানে?
– ওই গল্প কবিতা। মূলত কবিতাই লিখি।
– রাইট রাইট। মহিলা এবার হাসিমুখে নড়ে চড়ে বসলেন। এর মধ্যে কোন পুরস্কার টুরস্কার?
– ইয়েস ইয়েস ম্যাম। আমি একই সঙ্গে এ বছর সুধন্য স্মৃতি আর কাব্যসুষমা পুরস্কার পেলাম। কভারেজও হয়েছে উপাসনা টিভি চ্যানেল থেকে।
– দ্যাটস রাইট, অ্যাট দ্য আউটসেট আপনাকে আমার চেনা চেনা লাগছিল বলছিলাম না? ইয়েস, আই হ্যাভ উইটনেসড্ দ্যাট প্রোগ্রাম। চার-পাঁচটা চ্যানেলেই আপনাকে দেখাচ্ছিল। আপনি তো বক্তৃতাও দিলেন। ইজনট্ ইট?
– অ্যাবসোলিউটলি রাইট ম্যাম।
– মিসেস মিত্র তো হাউজওয়াইফ, তাই না?
– হ্যাঁ ম্যাডাম। স্বামীর গরবে প্রতিমা এখন একটু বেশিই উদ্ভাসিত।
– আর সূর্যতোরণ? হাউ আর ইউ?
– ভেরি ফাইন ম্যাডাম।
– স্মার্ট বয়। পাশ থেকে সেই ভদ্রলোক এবার মুখ খুললেন।
– থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। ‘আহ্’ বলে হঠাৎই কঁকিয়ে ওঠে বাপি।
আসলে থ্যাঙ্ক ইউ দিতে গিয়ে টেবিল ধরে উঠে দাঁড়াতেই যত বিপত্তি। গোল টেবিলের কোথাও একটা ধারালো পেরেক বেরিয়েছিল। কেউ খেয়াল করেনি, কিন্তু সেটা বাপির বাঁ হাতের আঙ্গুলে ঢুকে যায়। সামান্য রক্তও বেরোয়। বাপির চোখে জল।
ঘরের সবাই হঠাৎই খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। সেই মোটাসোটা প্রধানা সঙ্গে সঙ্গে কলিং বেল বাজাতে থাকেন। আর বাপির অবস্থা দেখে বেশ জোরে জোরেই চিৎকার করে ওঠেন – ‘ফার্স্ট এইড ফার্স্ট এইড, ঔর মিস্ত্রি। আরে পহেলে মিস্ত্রিকো বুলাও।’
বাপির কান্না থামাতে থামাতে প্রতিমা বলে ওঠে –হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন ম্যাডাম।
– মিস্ত্রি, আমি মিস্ত্রিকে ডাকছি। মহিলার গলার স্বরে এবার কর্তৃত্ব।
– আমরাও তো মিস্ত্রিই ছিলাম দিদিমণি। উঁহ্!!!
এবার প্রতিমাও কঁকিয়ে ওঠে। আকাশ প্রতিমার ঊরুতে এক রামচিমটি দিয়েছে।
– কী বললেন মিসেস মিত্র? মিস্ত্রি ছিলেন?
– হ্যাঁ দিদিমণি।
– আর এখন?
– এখন মিত্র। মিত্র ম্যাম। আকাশের মিনমিনে সমর্থন।
– মাই গুডনেস, হোয়াট এ সাসপেন্স! দাঁড়ান দাঁড়ান। আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
বিগ আন্টির কলিং বেলে ঘরে আস্তে আস্তে প্রচুর লোক জড়ো হয়ে গেছে। দুজন এসে তাড়াতাড়ি ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে বাপির আঙুলে ব্যান্ড এইড ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় বাপির কান্নাও থেমে গেছে। প্রতিমা হতচকিত। কি হয়ে গেল, বুঝতে পারছে না। একবার স্বামীর দিকে আর একবার অন্যদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে বিগ আন্টি সবাইকে চলে যেতে বললেন। সবাই চলেও গেল।
মহিলা এইবার শান্ত ভাবে চোখ তুলে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলেন – আপনার নাম কি?
– আজ্ঞে প্রাণবল্লভ মিস্ত্রি।
– তাহলে আকাশ মিত্র নামে বিখ্যাত এবং পুরস্কারজয়ী কবিটি কে?
– ওটাও আমি ম্যাডাম, বিশ্বাস করুন। লেখালেখির জগতে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে যে প্রাণবল্লভ মিস্ত্রি চলে না ম্যাডাম।
– আর আপনার বাবার নাম?
– আজ্ঞে প্রাণগোপাল মিস্ত্রি।
– উনি এখনও বেঁচে আছেন কি?
– হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম। মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়িতে ছিয়াশি বছরের আজও কর্মঠ একজন মানুষ প্রাণবল্লভ মিস্ত্রি। চাষবাস সবটাই দেখছেন তিনি।
– না। উনি বোধহয় দেখছেন না। দেখবেন কী করে? উনি তো মৃত। হ্যাঁ মৃত। অন্তত আপনাদের কাছে। যার কোনো পরিচয়ই নেই সে জীবিত কার কাছে?
আকাশ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। ঝনঝন করছে তার রক্ত।
– মিসেস মিত্র, আপনি কি শ্বশুরের ঠিক নামটি জানেন?
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে প্রতিমা অনেক আগে থেকেই মাথা নিচু করে বসে। আর পারছে না সে।
– আর আপনার ছেলে? সূর্যতোরণ? তুমি জানো তোমার দাদুর নাম? তাঁর পরিচয়?
স্তিমিত সূর্যতোরণ তখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে লাল আকাশ জুড়ে তার চোখের জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।