ছো ট গ ল্প ২
রাত এগারোটা বাজে, নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে শুভ মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রল করছিল প্রতিদিনের মত। মনটা একটু খারাপ । অদ্ভুত অস্থিরতা ওর মনে। ওকে কিছুতেই শান্ত থাকতে দেয় না এই অস্থিরতা। অস্থিরতার কারণ যে ওর নিজের কাছেও খুব পরিষ্কার তাও নয়। তবু এ নিয়ে ও কখনো কারুর সঙ্গে আলোচনা করেনি। কোলকাতা থেকে নর্থবেঙ্গলে ট্রান্সফার নিয়ে চলে এসেছিল ও এক বছর আগেই, বাড়ির লোকেদের থেকে দূরে থাকার জন্য । কিন্তু এখানে এসেও ও নিস্তার পায়নি বাড়ির লোকেদের প্রশ্নবাণ থেকে। মা, বাবা, এমনকি দাদা-দিদিও ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর সম্বন্ধ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওদের ধারণা, শুভর কিছু প্রবলেম আছে নিশ্চয়ই, তাই সে কোনো মেয়েকেই পছন্দ করে না। বিয়ের কথা তো শুনতেই চায় না। একদিন তো মা বলেই ফেলল, ‘দ্যাখো বাবা, আমাদের পরিবারের নাম ডুবিয়ো না আবার । আমেরিকায় যা চলতে পারে , এখানে তা চলে না।’ শুভ বুঝতে পারল মা কী মিন করছে। ও কিছু বলল না। মনে মনে হয়তো একটু নিশ্চিন্ত হল। ভাবল, যা হয় তা ভালোর জন্যই হয় । বাড়ির লোকেদের যদি মনে হয় ও হোমোসেক্সুয়াল তাহলে অন্তত পেছনে পড়ে থাকাটা বন্ধ হবে। ইদানীং, এই সাবজেক্টটা নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। বেশ কিছু সিনেমা গল্প ও লেখালেখি হয়েছে। দেশের আইন তা মানুক বা না মানুক সমাজ ভাবতে শুরু করেছে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার, এর ভেতরে কোন অন্যায় নেই। কিন্তু শুভর খটকাটা অন্য জায়গায়, প্রশ্নটা অন্য রকম।
বাড়ির লোকেরা না বললেও ওর নিজের অস্থিরতা কিন্তু ওকে কুরে কুরে খায় প্রতিদিন। সারাদিন অফিসে ব্যস্ততায় ভুলে থাকলেও, বাড়ি ফিরে এলেই ও ভীষণ একাকিত্বের কবলে পড়ে । একটা কথাও কাউকে বলতে পারে না, ডায়েরিতেও লিখতে পারে না, কারণ ও জানে এই ব্যাপারটা সমাজ মেনে নেবে না কোনোদিন। অথচ ওর শুধু মনে হয়, ওর এই চিন্তাটার ভেতরে কোনো ভুল নেই। আর তাই , প্রতারণা করবে না বলেই ও আজও বিয়ে করার কথা ভেবে উঠতে পারেনি। ও মনে মনে এমন একটা মেয়ে খুঁজছে যে ওর ধারণাটার সঙ্গে একমত হবে। ও কাউকে ঠকাতে চায় না। হয়তো, এই অস্থিরতা ওর তখনই শেষ হবে যখন এমন কাউকে পাবে যে ওর মতো করেই ভাবে।
শুভ তখন ক্লাস ফাইভে পড়ত। অঙ্ক দিদিমণি, খুব সিরিয়াস, অপূর্ব সুন্দরী। কালো বোর্ডের ওপর, সাদা চক দিয়ে অবলীলায় শুভর না পারা অঙ্ক করে দিয়েছিল। একদিকে না পারা অঙ্কটা এত সহজে করে দেওয়ায় ওর খুব ভাল লাগছিল আবার ওর না পারাটা ওকে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ও হেরে গেছে । দিদিমণির দিকে তাকাতে পারছিল না ও। দিদিমণি হঠাৎই এসে ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘শুভবাবু, এত লজ্জা পেলে হবে? সব না পারাগুলো জয় করতে হবে তো!’ শুভর শরীরে বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেছিল তখন । গলাটা কেঁপে উঠেছিল । সেই প্রথম ও বুঝতে পেরেছিল এ এক অন্য রকম স্পর্শ । অঙ্ক না পারার হার আর পরম মমতায় ছুঁয়ে তাকে বোঝানো তালগোল পাকিয়ে গেছিল ওর। সেই প্রথম ওর পুরুষ হয়ে ওঠা। এক অসম্ভব টান তৈরি হয়েছিল দিদিমণির প্রতি। দিদিমণির ছোঁয়া, সে তো মাতৃসুলভ অনুভূতি জাগানোর কথা! কিন্তু ওর তো তা হয়নি। যা হয়েছিল তা ওর ভালো লেগেছিল আবার ভয়ও পাইয়ে দিয়েছিল। কী এক অজানা ভয় আর পাপবোধে ও দিদিমণির হোমওয়ার্ক না পারলেও আর কখনো দিদিমণিকে বলেনি, যদি আবার কাছে ডেকে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়!
ভালবাসা কখন কীভাবে বাসা বাঁধে মনে, কতক্ষণ থাকে আর কখনই বা চলে যায় তা জানা খুব মুশকিল। শুভও বুঝতে পারে না কোনটা ভালবাসা আর কোনটা ভাল লাগা। আকর্ষণ বোধ করলেই কি তা ভালবাসা ? নাকি আরও কিছু বেশি? কোনো একজন মেয়ের প্রতি টান এক এক সময় এমন দুর্নিবার হয়ে ওঠে যে সমাজের সব বাধা ভেঙে এক হয়ে যেতে মন চায়। বেশ কয়েকদিন সেই রেশ লেগে থাকে, তারপর নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় নিজেই নিজের কাছে, সমাজের নিয়মের কাছে হার মেনে নেয়। এ ভাবেই চলছে ও, এ ভাবেই চলছে সমাজ। শুভ বুঝতে পারে।
শুভর সঙ্গে কলেজ জীবনে যে মেয়েরা পড়ত, তারা কেউই শুভকে তেমন ভাবে আকর্ষণ করেনি কখনো। ওদের মেয়েলি ন্যাকামি দেখলে শুভ ভেতরে ভেতরে রেগে যেত। এইসব মেয়েদের সঙ্গে আধঘণ্টার বেশি থাকলেই শুভ নিজের ভেতরে বিরক্তি টের পেত। ও খুব মন দিয়ে মেয়েগুলোকে পর্যবেক্ষণ করত। ওদের অস্তিত্ব যেন নেলপলিশের রঙের মতোই উজ্জ্বল আর ক্ষণিকের । এমনই কোনো মেয়েকে ও বিয়ে করবে আর তারপর সারাজীবন তার প্রতি কমিটমেন্ট রাখার জন্য ও তিল তিল করে নিজের ইচ্ছেগুলোর গলা টিপে মেরে ফেলবে আর এভাবেই একদিন ও নিভে যাবে, এটা ভাবতেই ওর মনটা না না করে উঠত। আস্তে আস্তে ও বুঝতে পারছিল আর পাঁচ জনের মতো করে সংসার ও করতে পারবে না, কিছুতেই । কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটা ওর কাছে অর্ধেক উঠে যাওয়া নেলপলিশের মত ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে, তখন ও আর কিছুতেই থাকতে পারবে না মেয়েটির সঙ্গে। কিন্তু তখন ছেড়ে গেলে সেই মেয়েটার প্রতি অন্যায় করা হবে, এই সমাজের নিয়ম অনুযায়ী ।
এখানেই জট। সমাজের এই যে নিয়ম, এই যে কমিটমেন্ট-এর নামে দুটো জীবনকে জুড়ে দেওয়া, সারা জীবনের মতো, আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি এক রাশ অভিযোগ নিয়ে, সন্দেহ নিয়ে, কদর্য বাক্য বিনিময়ের সঙ্গে শুধু অনুশোচনা নিয়ে জীবন শেষ করা, ঠিক এটাই চায় না শুভ। শুভ দেখেছে, ঝলমলে শাড়ি পরে পার্টি থেকে ঘুরে আসা মাসি-মেসো রাতে হিস হিস শব্দে কী ভীষণ খারাপ কথা ছুঁড়ে দিচ্ছে পরস্পরের দিকে। পাশের ঘর থেকে সেই শব্দবাণ শুনে ওর মনে হয়েছিল, ও হলে সেই রাত থেকেই সম্পর্ক ছিন্ন করে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিত। ওর মতে, সম্পর্ক হবে সাবলীল, পরস্পরের প্রতি অবিভেদ্য বিশ্বাস আর স্বচ্ছতার বাতাবরণে সে প্রাণ পাবে। সে জোয়ারের জলের মত আসবে আর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর দু’জনে সেই ভরা নদীতে স্নান করবে ততক্ষণ, যতক্ষণ দু’জনেরই মন চাইবে। স্নান তো চিরদিন স্থায়ী হয় না। এক সময় মন শান্ত হবে, শরীর ঠাণ্ডা হবে। সমাপ্ত হবে স্নান। নদীতে যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাটার টানে একসময় জল নেমে যায়, এক্ষেত্রেও তেমনই হবে। ভাটার জলে যদি জীবনের নৌকো জোর করে ভাসাতে চায়, তবে তা নদীর চরে ধাক্কা খেয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ক্ষয়ে যেতে থাকে। আমরা উপর থেকে দেখে বুঝি না, কিন্তু ক্ষয়রোগ আমাদের জীবন-যৌবন সব চিবিয়ে খেয়ে ছিবড়ে করে ফেলে দিয়ে যায় । শুভ তাই বিয়ে নামক কোনো ইনস্টিটিউশনে বিশ্বাসী নয়। আর তাই, যৌবনের যাবতীয় ইন্সটিঙ্ট সে দু-এক জনের সঙ্গে মিউচুয়াল কনসেন্টে বার দশেক এক্সপিরিয়েন্স করলেও এক জনের সঙ্গে জীবনভর থেকে যাবার কথা এখনো ভেবে উঠতে পারেনি। আরও বিশদে ভাবলে ও দেখেছে, ও যৌনতাকে সম্পর্কের সঙ্গে এক তারে বাঁধতে চায়নি কোনোদিন। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে দেখেছে, এটা কি চরিত্রহীনতা ? নাকি দায়িত্ব টেনে নিয়ে যাবার অপারগতা? দুটোরই সম্ভবনা খুব বেশি ওর নামের পাশে বসে যাবার জন্য। শুভ মনে মনে ভাবে মানুষ যদি একটা প্রাণী হয়ে থাকে , তাহলে আর বাকি প্রাণীদের মতো তার জীবন স্বাধীন নয় কেন? কেন সমাজের গড়ে দেওয়া শিকলে নিজের পা গলিয়ে দিতেই হবে প্রতিটা মানুষকে? কী হবে এ নিয়ম না থাকলে? সত্যিই কি সব সম্পর্ক সেই অর্থে কলুষ নয়? শতকরা কত ভাগ মানুষ সত্যিকারের একগামী? যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে মানুষ নিজের জ্ঞাতসারে একাধিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছেই ঘরে ঘরে, তাহলে কেন এ লুকোচুরি? কী দরকার এই মেকি সততার!
মণীষাদি। মাজা রঙ, গাঢ় চাহনি, উদ্ধত বক্ষযুগল আর কোমরের ভাঁজ দম বন্ধ করিয়ে দিতে পারে পুরুষদের। মণীষাদি এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। অসম্ভব কাজপাগল এই মহিলাকে শুভ জয়েনিং এর সময় থেকেই সমীহ করে চলে। প্রথম এক বছর প্রায় কথাই হয় নি ওর ম্যাডামের সঙ্গে । ওরা যারা জয়েন করেছিল এক ব্যাচে, তাদের প্রত্যেকেরই আইডল ছিল মণীষাদি। উনি কিন্তু কাউকে কোনো রকম আলাদা প্রশ্রয় দিতেন না। কাজ না পারলে ধমক দিতেন নির্দ্বিধায় । আবার এমন দিনও গেছে যখন নিজের টিফিনবক্স থেকে খাবার এগিয়ে দিয়েছেন শুভদের। মণীষাদির কাছে বেস্ট বয় হবার জন্য ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছিল। জীবনে দ্বিতীয়বার শুভ বাকিদের থেকে পিছিয়ে পড়াটাকে মেনে নিতে পারছিল না। শুভর দিনরাত সব আবার ওলটপালট করে দিচ্ছিল মণীষাদি। আট ঘন্টা ছাপিয়ে কখন যে বারো ঘন্টা টানা কাজ করে যাচ্ছে, তা বোঝেনি ও। মণীষাদি শুধু বলেন, ‘কারুর কাছে কমিটমেন্ট রেখো না, শুধু নিজের কাছে কমিটমেন্ট রেখো। যেদিন নিজের কাজে নিজে আর কোনো খুঁত বার করতে পারবে না, সেদিন জানবে কিছুটা হলেও জীবনের ঠিক পথে হাঁটছো।’ প্রায় তিন বছর কাজ করার পর শুভ অফিসে একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিল। সেটা বুঝতে পারত অফিসের বসদের, এমনকি সহকর্মীদের ব্যবহারে। যেদিন ও প্রমোশন পেল আর তার সঙ্গে ট্রান্সফারের অর্ডার, ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিল। বেস্ট পারফরমার ও! কিছুক্ষণ ঘোরে ছিল। তারপর মনে হল, যার জন্যে ওর এই প্রাপ্তি, সেই মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ওকে। কোনোদিনই হয়তো আর দেখা হবে না। দূরত্ব বড় বিষম বস্তু। সে ধীরে ধীরে স্মৃতির গোড়ায় সেঁকো বিষ ঢালতে থাকে। ওর মনটা ভারি হয়ে এলো।
মণীষাদিকে মেসেজ করলো, ‘সব কিছুর জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, ভালো থাকুন, ভালবাসা।‘
তারপর আজ প্রায় এক বছর, শুভ মাঝে মাঝে টের পায়, সে একা। কিছু একটা তার কাছে নেই। কী সেটা ? বন্ধু নেই? ভালবাসা নেই? শারীরিক সুখে ভাসা নেই? নাকি মনে কোনো স্বস্তি নেই? ও কি একাকিত্বে ভুগছে? মোবাইলে চ্যাট করে একাকিত্ব কমাতে চায়। কিন্তু এত মেকি লাগে সব চ্যাট যে বেশি কথা বাড়াতেও ওর ভাল লাগে না। আজও, এমনই এক রাত। মন আর শরীরের অস্থিরতা ওকে টিকতে দিচ্ছিল না। শরীরের ক্লান্তি ঘুমের সহায়ক হচ্ছে না। ও কি কাউকে চাইছে? কাকে? কোনো আবছা মুখ কি ভেসে আসছে ওর চোখের সামনে? নাকি নিজেই নিজেকে খুশি করতে চাইছে কোনো মুখ স্বপ্নে ভাসিয়ে? স্বপ্নে চাওয়া এক গোপন চাওয়া। সেখানে সমাজের কেউ নাক গলায় না। বাস্তবে চাইলেই সমাজ রে রে করে তেড়ে আসে।
ও মোবাইল নিয়ে দেখলো , হোয়াটসঅ্যাপে মণীষাদি অনলাইন । ‘কেমন আছেন? প্রোফাইল পিকচারটা খুব সুন্দর ।’ লিখে পাঠিয়ে দিল ও। একটু পরে উত্তর এলো, ‘কাজ কেমন চলছে?’ শুভ একটু কষ্ট পেল। ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে কি মণীষাদি ? মণীষাদি যেন বুঝতে পেরেছে। লিখলো, ‘বিয়ে করেছো ?’ শুভ এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায় যে কোনো আলোচনায়। আজ কিন্তু লিখে ফেললো, ‘বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশনে বিশ্বাসী নই।’ একটু পরে ওপাশের রিপ্লাই এলো, ‘এক্সপেকটেড।’ এবার শুভর চমকে ওঠার পালা। ও তবু ভয়ে ভয়ে লিখলো, ‘আমি ইমমরাল নই। কিন্তু, আমি মোনোগ্যামিতে বিশ্বাস করিনা । আমার মতে পৃথিবীর বাকি সব প্রাণীর মতোই মানুষও আসলে পলিগ্যামাস। বিয়ে এই ধারণার পরিপন্থী । আমি মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাই না । তাই বিয়ে করতেও চাই না। তোমার কী মনে হয়? আমি কি ভুল? আমি কি খারাপ ছেলে?’ ওদিকে কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর উত্তর এলো, ‘প্রথমত, তোমার পাশের ডেস্কের মোনা সিং-এর সঙ্গে কিছু হবে ভেবেছিলাম । দ্বিতীয়ত, আমাকে তুমি বলছো, ভালো লাগলো । ভৌগোলিক দূরত্ব হয়তো মানসিক দূরত্বের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক ।’
শুভ বুঝতে পারলো, ও মণীষাদির কাছে ধরা পড়ে গেছে। কি হলো ও বুঝলো না, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মনে হল, ওর আর মণীষাদির মাঝে যেন কোনো আড়াল নেই। ও সারেন্ডার করতে পারে মণীষাদির কাছে। বলতেই পারে সব কথা। ও লিখলো, ‘আই স্লেপ্ট উইথ হার, উইথ মিউচুয়াল কনসেন্ট, বাট ইট ওয়াজ নট লাভ, অ্যান্ড বোথ অফ আস রিয়েলাইজড দ্যাট।’
ওদিকে চুপ। শুভর দমবন্ধ হয়ে আসছিল । বুক ধড়াস ধড়াস করছিল । হঠাৎই ও বুঝতে পারলো, ও অস্থির হয়ে উঠেছে । এক দৃষ্টে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে ও তাকিয়ে থাকলো।
ওপাশে মণীষাদি চুপ অনেকক্ষণ। তারপর উত্তর এলো, ‘লিভ ইন করতে পারো।’ শুভ আরও অস্থির হয়ে উঠলো, একটু মরিয়াও। ও কেন যে বোঝাতে পারছে না মণীষাদিকে! ও লিখলো, ‘ওটা বেটার অপশান। তবে এই সোসাইটি কি সেভাবে মেনে নেয় এটা? দ্যাখো, আমার কাছে মানুষ শুধু একটা প্রানী, তাই তাকে জীবনের বেসিক ইন্সটিঙ্কটগুলো অন্য প্রাণীদের মতো করেই পূরণ করতে দেওয়া উচিত। শারীরিক সম্পর্কের শুচিতার নামে, মানসিক ও শারীরিক ভাবে কোনো মিল নেই এমন দুটো মানুষকে কেন সারা জীবনের জন্য কলুর বলদের মতো জুড়ে দেওয়া হবে? দুটো মানুষ শুধু কমিটমেন্ট রাখতে গিয়ে নিজেদের সমস্ত ইচ্ছা অনিচ্ছা গোল্লায় দিয়ে জীবন শেষ করবে? অরণ্যের হরিণের জীবনের বদলে বাজারের থলি হাতে মধ্যবিত্তের জীবন কাটাবে? মানুষ তো আসলে প্রাণী। তাহলে তার চাওয়াগুলো আর পাঁচটা প্রাণীর মতো হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা কেন মেনে নেয় না সমাজ?’ কথাগুলো লিখে মণীষাদিকে পাঠিয়ে দিল শুভ। উত্তরে মণীষাদি লিখলো, ‘বুঝলাম।‘ শুভ এতদিনে এমন কাউকে পেল, যাকে ও কথাগুলো বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । মণীষাদি লিখলো- ‘তাহলে একা থাকো, হয়তো ওটাই বেস্ট হবে তোমার জন্য। সমাজ তোমার মতো করে চিন্তা করে না বলেই আমার ধারণা। তাই সেটা সমাজ। আর সমাজ ভুল করে নাকি ঠিক, তার উত্তর শুধু দিতে পারে সময়। যুগে যুগে এভাবেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সময়। তাই তো সময়ের চেয়ে বড় উত্তর আর কিছুই নেই। তবে তোমার এই সরল স্বীকারোক্তি তোমাকে আমার মনের কাছে একটা বড় জায়গা করে দিলো। গভীরভাবে ভাবলে তোমার এই ধারণাকেও ফেলে দিতে পারা যায় না। হয়তো আগামীতে কোনো এক সময় এই সমাজই ‘সংসার’ নামের এই ইনস্টিটিউশনের প্রয়োজন আর দেখবে না। তখন হয়তো তুমি বা আমি , আমরা কেউই থাকবো না। আগামী প্রজন্ম থাকবে।’
শুভ এবার চুপ। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে, নিজের ভেতরের পুরুষটা জেগে উঠেছে হঠাৎই । ওর ইচ্ছে করছিল উড়ে গিয়ে মণীষাদিকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে শেষ করে দিতে। ইচ্ছে করছিল মণীষাদির কোলে মাথা রেখে প্রায় এক যুগ ঘুমিয়ে থাকতে। ইচ্ছে করছিল প্রবাল দ্বীপে গিয়ে দু’জনে সমুদ্র স্নান করতে। তাহলে কি রূপ, যৌবন বা শরীর নয়, মনের মিলই ভালবাসার জন্ম দেয়?
প্রায় পনের মিনিট কেটে গেল, শুভ ফ্যান্টাসির জগতে বিচরণ করছে। মোবাইলে মণীষাদির ছবিটা দেখলো বড় করে। তারপর লিখলো ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই টেক ইউ ফর এ ডেট?’
মোবাইলে এবার আর কোন উত্তর এলো না। প্রাথমিক ভয় পেয়ে যাওয়াটা এক সময় কেটে গেলো। জানলা দিয়ে আসা রাস্তার হাল্কা আলোয় ও ফ্যানের ব্লেডের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকলো, এক ক্লান্ত অথচ শান্ত মন নিয়ে। সময় পার হতে লাগলো। ওর চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ছেলেদের কাঁদতে নেই, এটাও এই সমাজেরই নিয়ম। আজ কিন্তু বন্ধ ঘরে শুভ কাঁদলো, জ্ঞানত প্রথমবার।