Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

পা ঠ  প্র তি ক্রি য়া  ১

রা জী ব   চ ক্র ব র্তী

আদি মহাকাব্য গিল্গামেশ : এক মানবিক বীরত্বগাথার আলেখ্য

‘আপনি দেবর্ষি, আপনিই প্রধান, কেমন করে আপনার বিচারবুদ্ধি সম্পূর্ণ লোপ পেল, কেন ডেকে আনলেন আপনি, এই মহাপ্লাবন! যে নিয়মলঙ্ঘন করে চলেছে, তার অপরাধ দিয়েই তাকে প্রহার করুন। যে পথভ্রষ্ট, তার ভ্রান্তি দিয়েই তাকে প্রহার করুন। শিথিল রাখুন তাকে, যাতে সে আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে।’ (গিল্গামেশ কাব্য: একাদশ অধ্যায় )

দীর্ঘ সন্ধানের পর গিল্গামেশ, যা কিনা রচনাকালগতভাবে বিশ্বের প্রাচীনতম মহাকাব্য বলে স্বীকৃত, তা বাংলায় হাতে আসার আনন্দ টাটকা থাকতে থাকতেই বইটির পাঠ সম্পূর্ণ করে যাবতীয় অনুভূতি  কিছু শব্দবন্ধে ধরে রাখার চেষ্টাতেই বর্তমান আলোচনা। 

এগারোটা খন্ডে বিন্যস্ত এই কাব্য আমাদের সামনে তুলে আনলো মধ্যপ্রাচ্যের এক পটচিত্র যার পদে পদে স্থান পেয়েছে প্রাক-ইসলাম প্যাগান বহুদেববাদ ও  সংস্কৃতির উন্নত এক  কথামালা । মানবসভ্যতা পুরাকাল থেকেই নদী নির্ভর। সেই উর্বরা মাটিই মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে। সেও গড়ে তুলেছে স্বচ্ছন্দ বসতি, স্থায়ী বসবাস। তবে এই সভ্যতাগুলি বিচ্ছিন্ন ছিলোনাl তাদের এক সুদীর্ঘ ইতিহাসের বিবর্তনক্রম লক্ষণীয়, পাশাপাশি এদের আন্তর্সম্পর্কও ছিল বহুল প্রসারিতl 

গিল্গামেশ মূল কাব্যটি তিনটি ভাগে রচনা করা হয়েছে। গোটা পৃথিবীতে যে ক’টি মহাকাব্য রচিত হয়েছে শিশুপাঠ্য কাহিনীতে, তাদের রচনাকারদের নাম উল্লেখ থাকলেও যুগের পর যুগ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে মাটির সঙ্গে যুক্ত থাকা চারণ কবিরা কাব্যের আয়তন বৃদ্ধি করেছেন, তাতে জল – হাওয়া দিয়ে তাকে পল্লবিত করেছেন, যার সাক্ষী এই গিল্গামেশ কাব্যও। মহাকাব্যটির প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টিকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ। কাব্যের প্রাথমিক রূপ লিপিবদ্ধ আকারে পাওয়া গেছে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ভাষায় আনুমানিক আঠারোশো সাল নাগাদ। এই প্রাচীন ব্যাবিলনীয় ভাষা থেকে পরবর্তীকালে তার ক্ষয়প্রাপ্তির পরে একটি মান্য ব্যাবিলনীয়  ভাষায় নতুন করে কাব্যটির সংকলন করা হয় আনুমানিক তেরোশো থেকে হাজার খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে, অর্থাৎ তাম্রপ্রস্তর যুগ থেকে লৌহ যুগের সূচনাপর্বে পৃথিবীর প্রাচীনতম এই মহাকাব্যের রচনা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, যা অবশ্যই এক অবাক করা বিষয়। প্রাথমিক পর্বে যে রচনাকার্যটি করা হয়েছিল তা ছিল আক্কাদীয় ভাষায়, যার সঙ্গে আবার ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা বংশের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলত, এই লেখা পাঠোদ্ধার করে তাকে তুলে আনার বিষয়টা যতটা কঠিন, তার যৌক্তিক অর্থসজ্জার প্রকাশও ততটাই।

এই কাব্যটি যে সময় তৃতীয় পর্বের রচনায় বিকশিত হয় তখনও ভারতে বেদ রচনার কোনো লিখিত রূপের সন্ধান মেলেনি। ভারতে আগত বৈদেশিক আর্যরা এই বেদকে লিখিত রূপ দিয়েছিলো আনুমানিক হাজার খ্রিস্টপূর্বের পরে। অন্যদিকে তাম্রপ্রস্তর যুগের সিন্ধুলিপিও অপঠিত। ফলে তাদের রচনাও অধরা। সেই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এই প্রাচীনতম মহাকাব্যের রচনাপর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছে। ক্রমশ তা ব্যাবিলনের একের পর এক সাম্রাজ্যের পতনের ধারাকে অনুসরণ করে মাটিতে চাপা পড়তে থাকলো। অন্যদিকে আলোকিত হতে থাকলো পূর্ব দিকের আকাশ। এটাই বোধহয় কালিক রীতি।

প্রসঙ্গত জানানো প্রয়োজন সেখানকার রাজকুমারী এনহেডুয়ান্নার নাম, যিনি তাঁর  রচনারীতিতে উপাসনা গান গেয়েছেন ‘চন্দ্রদেবতা সিন্ ও সুমেরীয় দেবী ইনান্নার ( আক্কাদীয় নাম ঈশতার ) উদ্দেশে, আনুমানিক ২২৮৫-২২৫০ এর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়কালে। তাঁর সাহিত্যকীর্তিই পৃথিবীর প্রাচীনতম গাথা ( উপাসনা ) হিসাবে জানা গেলেও বৈচিত্রের অভাবহেতু  তা মহাকাব্য হয়ে উঠতে পারেনি। তার অনতিকাল পরেই এই গিল্গামেশ কাব্যগাথা নিয়েছে আধুনিক মহাকাব্যের রূপ। শুধু তাই নয়, এর প্রভাব পরবর্তী বা অনুবর্তী সিন্ধু সভ্যতা সহ সমকালীন অন্যান্য সভ্যতাতেও স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। এইরকমই একটি উদাহরণের কথা বলা যায়l যেমন, মহেনজোদারোয় প্রাপ্ত একটি সীলে খোদিত একটি ষাঁড়ের সঙ্গে সুঠাম পুরুষের যুদ্ধের ছবি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গিল্গামেশ যে কিনা সূর্যপুত্র, তার মধ্যে সূর্যের তেজ ও গোলাকার মুখাবয়বকে লক্ষ্য করে তাঁরা দেবী ঈশতার পাঠানো দুর্ধর্ষ ষাঁড়কে বধ করার জন্য যে মল্লযুদ্ধ চালায় তদনুরূপ একটি ছবি ওই সীলে দেখিয়ে তাঁরা বলেন নীল- টাইগ্রিস- ইউফ্রেটিস্- সিন্ধু- হোয়াঙহো পর্যন্ত বিস্তৃত এই উর্বর হাঁসুলি সংস্কৃতির মধ্যে বহুমুখী যোগাযোগের কথা ; ফলে তা সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ধারক হয়।

তবে, একটি প্রশ্ন রয়েই যায়, যে তাম্রপ্রস্তর যুগে প্রবল ব্যাবিলনীয়-মেসোপটেমিয় সভ্যতা  চূড়ান্ত সমৃদ্ধ হয়ে সুদীর্ঘ ও সুদৃঢ় শাসনকার্য ও নাগরিকরীতির ধারাপর্ব চালিয়ে গেলো, সিন্ধু সভ্যতা সেখানে উন্নত নাগরিক সভ্যতার সাক্ষর রেখেও কীভাবে হৃতযৌবনা হয়ে মিশে গেলো মাকরান – সোয়াত উপত্যকার মরুবালিতে ! উত্তর হয়তো নিশ্চই আমাদের দেবে ভবিষ্যৎ।

মূল মহাকাব্যটি থেকে যে বিষয়টি উঠে এলো তার আনুপূর্ব আলোচনায় পশ্চিমী সভ্যতার চর্চাতে কাব্যটি বিস্ময়সূচক ঠেকেছে। হোমারের রচনাকালেরও প্রায় দেড়হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে ( অন্ধকার রাজ্যে ) যে সাহিত্যের এমন চর্চা ও ইতিহাসের এতো ধারাবাহিক সম্পদ লুকিয়ে ছিলো, তা পশ্চিমের পণ্ডিতদের মধ্যে তীব্র বিস্ময় ও অনুরাগের জন্ম দিয়েছে। স্পষ্টতই এখানে ইউরোপের জাতিগৌরবের যে শ্লাঘা, সেখানে এই কাব্য আঘাত হানতে পেরেছে। 

কাব্যের অন্য দিকটা হলো অলৌকিকতাl কোথাও যেন তা মাত্রাজ্ঞানে সীমিত। যেখানে মহাভারতের সুদূর বিস্তৃত কার্যাবলীতে একদিকে আমরা পাই প্রবল কূটনীতি ও জ্ঞানগর্ভ নৈতিকতা, অন্যদিকে পাই এক ঐশী ক্ষমতার আধারস্বরূপ সংগঠিত রাজশক্তি। সেখানে নামভূমিকা সর্বস্ব এই কাব্য কেবলই এক বীরগাথা।  দৈব ষড়যন্ত্রে যে সাফল্যকে ছুঁয়েও তা খণ্ড, তাই ব্যর্থ। পোয়েটিক জাস্টিস সেখানে যেন অধরাই রয়ে যায়।

কৃষিসম্পদের ব্যবহার, দাসশ্রমের একটি সুস্পষ্ট আহরণ, অনেক বেশি সরলীকৃত বর্ণনায় এই কাব্য রচিত। তা মহাভারতের যে শতধারার বিন্যাস, তার নৈকট্য  কতটুকু লাভ করতে পেরেছে সে প্রশ্ন উঠবেই। তাই শুধু বহরে নয়, ভাষায় নয়, এমন এক যৌক্তিকচেতনার জটিলজালে মহাভারতকে বোনা হয়েছে, তাতে কৃষিসভ্যতার বিবর্তনের যে ছবি ও বৈচিত্র আনা হয়েছে তা অবশ্যই তাকে শ্রেষ্ঠত্ব তথা কৌলিন্যের আসনে আসীন করেছে। আর এখানেই যেন ‘ভারত’ আঁকড়ে ধরেছে তার বহুধাবিভক্ত ঐতিহ্যকে। ভারতাত্মার প্রতীক হয়েছে এই শক্তিমান মহাকাব্যটি। এছাড়া আর একটি বিষয় এখানে আলোচ্য, তা হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠাl সাহিত্যের সঙ্গে কোনো এক ক্ষীণধারায় এই ন্যায় প্রতিষ্ঠাতত্ত্বকে দাঁড় করানোর এক অলীক তাড়না গোটা পৃথিবীর সমস্ত মহতীকাব্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তাঁর রচয়িতারা। গিল্গামেশ কাব্যেও তার ব্যত্যয় ঘটেনিl

বর্তমান কাব্যটিতে পরম পরাক্রমশালী বীর গিল্গামেশ দেবাংশ হয়েও নশ্বর মানব। এই চেতনা তার মধ্যে বন্ধু এঙ্কিডুর মৃত্যুতে সুস্পষ্ট হয় ও সে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চায়। মনে পড়ে যায় বুদ্ধের কথা, তিনিও মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুরহস্যকে অনুধাবন করেছেন সমস্ত ত্যাগ করে। আদতে কৃষি-অর্থনীতির উত্থানের পর্বে উদারমনস্ক এক চর্চাই বুদ্ধের দর্শনে ধরা দিয়েছিলো সেদিন। কিন্ত গিল্গামেশ হাতড়েছে অন্ধকারে। সে বুঝেছে সে কতো অসহায়। মৃত্যুলোককে অমরাতে রূপান্তরিত করার মানবিক সাধ তার নেহাতই তুচ্ছ। তার কারণ হয়তো মানুষের অসীম লোভ। সুগভীর সম্পদের ধারক হুমবাবাকে হত্যার মাধ্যমে যে মানুষ বিশ্বকে করায়ত্ব করতে চেয়েছে, সেখানে প্রকৃতির রোষ তাকে সহ্য করতে হয়েছে। যুগে যুগে এই ঘটনার  পুনরাবৃত্তি হয়েছে। যুগে যুগে এই ঘটনা ঘটেছে।

মহাকাব্যের একেবারে শেষ বা একাদশ অধ্যায়ে যে মহাপ্লাবনের বিবরণ আমরা পাই দেশ-কাল-জাতিভেদে তা আমাদের সামনে বারবার উঠে এসেছে ইহুদি ওল্ড টেস্টামেন্টে, এসেছে ভারতের পুরাণগাথায়, এমনকি চৈনিক তত্ত্বগ্রন্থেও। বিশ্বনাশ ও নতুন সৃজন, এ যেন এক চির শাশ্বত নিয়ম। আলোচ্য কাব্যেও তার নজির স্পষ্ট। এই সৃষ্টিতেই প্রাণের জয়, মানুষের বিজয়l এই কুদরতি মৃত্যুকে জয় করার স্পৃহার মধ্যেই ন্যস্ত হয়েছে। তবে এখানে চোখে পড়ার মতো বিষয়টি হলো, ভারতীয় পুরাণের ঋষিরা কিন্তু মন্বন্তরে বাঁচার জন্য তাঁদের সংগ্রহে থাকা পুঁথিরূপ জ্ঞানকে সঙ্গে নেন, সেই তাগিদ কিন্তু গিল্গামেশ কাব্যে চোখে পড়ে না; বরং বিবরণে স্থান পায় মনোজ্ঞ পার্থিব সম্পদ। কিন্তু সমগ্র সৃষ্টির বিনাশের পরে তার কী প্রয়োজন থাকতে পারে! তার মূল্য কি তখনো একই থাকে? পাঠকের মনে এ প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, যার হয়তো একটাই উত্তর আসবে। যে কোনো সভ্যতার মধ্যেকার ধনবৈষম্য ও সম্পদের প্রতি আসক্তির দ্যোতক এই ঘটনার ইঙ্গিত এক সুগঠিত বিভাজিত দাস শ্রমের শোষণযন্ত্রের প্রতিভূ।  সুতরাং, ধ্বনাদগমে তত্সুখমl

শেষে বলতে হয়, অনুবাদক মূলকাব্যের ইংরেজি থেকে যে অনুবাদটি বাংলায় করেছেন তার  উল্লেখ তিনি করলেও কাব্যটি পাঠের সময় একই বিষয়ের ‘উদ্ভট পুনরাবৃত্তি’ অস্বস্তির কারণ হতে পারে। মূল কাব্যের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটে থাকতেই পারে, কিন্তু অনুবাদ ও সম্পাদনার সময় এই বিরক্তিকর পরিস্থিতি কি এড়ানোর চেষ্টা করা যেতো না? আশা করি ভবিষ্যতে এই বিষয়টি নজরে আসবে। কারণ মূল লেখার যাবতীয় সীমাকে অনুবাদক তাঁর দক্ষতাবলে অতিক্রম করবেন, তাতে ‘অনুবাদকের স্বেচ্ছাচার’ থাকতেই পারে, এমনটাই মনে করতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও। এই কুণ্ঠাহীন স্বীকৃতি অনুবাদকে করে স্বাধীন ও আকর্ষণীয়, পৃথক ও মৌলিক। এছাড়াও সামান্য কিছু বানানের ত্রুটি লক্ষণীয়। এগুলিকে সরিয়ে রেখে এই মহাকাব্যের যে অনুবাদকার্য ভাষালিপি করেছে, তা নিঃসন্দেহে এক মহৎ উদ্যোগ যাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা কার্যের এক সার্থক উপাদান বা দলিল এই গিল্গামেশ গাথা সুন্দর মলাট ও শোভন  প্রচ্ছদ এবং স্বাদু ও সরল ভাষায় প্রকাশ ও উপস্থাপনের জন্য অনুবাদক তথা সম্পাদককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বাংলাভাষায় এই সফল প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হিসাবে রয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য।

গিল্গামেশ- কাব্য

বঙ্গানুবাদ ও সম্পাদনা: গৌতম বসু

প্রকাশনা: ভাষালিপি

আরও পড়ুন...