বি শে ষ র চ না
( ‘রক্তকরবী’ একটি বিশ্বপ্রেমের পাঠ। )
“আন্দাজে বলতে পারি । তুমি ভিতরে ভিতরে ওর মনের তারে টান লাগিয়েছ;”…
কে বলল কথাটা? এই মানুষটিকে চিনি মনে হয়? অধ্যাপক! না না … মনের কথাগুলো তিনি জানবেন কি করে! পাশে তাকাতেই —
চারপাশে অনেকদিন পর এমন একটা সবুজের পাশে বসে আছি। বাতাসের ছোঁয়ায় গাছের পাতারা আরও লাজুক হয়ে উঠছে।
এখানে সভ্যতা – সোনা আর সফলতা, বাজার আর বিল গেটস নিয়ে মন কষাকষি করে না সকাল বিকেল রাত।
কাকে দেখে এমন মনে হল – কে ও?
ওকে মনে হয় অনেকদিন ধরেই আমি চিনতে গিয়ে গভীর এক অজানা অতলের কাছে মন রেখেছি বার বার। দশ বছর ধরে তার মুখের প্রলেপ খুঁজেছি রঙ আর ভাষায় । চুপ করে বসে ওর বুকের ভিতর দেখছি জলের ফেনারেখা, বাহুজোড়ায় লেগেছে পৌষের মায়াবী প্রলেপ, নীলকন্ঠ পাখির কোমলতায় গ্রীবাদেশ বেষ্টন করে আছে কোনো এক গোপন শিল্পীর হাতে গড়া কণ্ঠহার, দেহময় ছেয়ে আছে ধানী রঙের শাড়ি, হাঁটু ছোঁয়া চুলের সুগন্ধে মেলে রাখা শান্তির নিদ্রাহীন রাত… তার আকাশগঙ্গা সিঁথির রেখা লেপে গেছে রক্তকরবীর আলোয়…
– তুমি কে গো নারী?
কোনো দিন কোনো অন্ধকার তোমাকে স্পর্শ করেছে বলে তো মনে হয় না!
দীর্ঘ পলকের বিদ্যুৎ আঁখি বলে – “আমি নন্দিনী ।
হ্যাঁ, তুমি আমাকেই খুঁজতে চেয়েছ বহুকাল! কিন্তু সাহস …….”
আমি ঘুরে যাই বিপরীত পথে – হাতটা নরম হাতে ধরা পড়ল – ” যেও না, পাশে বস”…
– তোমার সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলব গো নন্দিনী?
– তোমার ভাষায় বলবে গো শুধু! আমি তোমার ভাষা শুনব বলেই তো অপেক্ষা করে আছি। সবাই তো শুধু আমার কথা আমাকেই শুনিয়ে গেল!
তাল তাল মাটির অন্তরে গাঁথা সোনা, অসহায় রাজা, ক্ষমতার উইপোকা সর্দার,খনি শ্রমিকদের কান্না আর রঞ্জনের আগামীর বার্তার মাঝে – এই আমি নন্দিনী, একলা নন্দিনী, নিঃসঙ্গ নন্দিনী – এই নন্দিনী কে কি শুধু দেখা যায় না গো?
তোমার যেমন একজন অধ্যাপক আছে, সর্ব সময়ের গ্রন্থ দংশনকারী , আমারও একজন অধ্যাপক আছে তিনি কিন্তু যৌবন বাউল, আমাদের ভিতর একটা দোতারা আছে, সেখানে সুর বাঁধেন সর্বক্ষণ ।
নন্দিনী অবাক হয়ে বলে – কে গো সেই যৌবন বাউল?
– মলয় রক্ষিত। উনি তোমাকে নিয়ে একটা ভাবনার সুর বেঁধেছেন – ” যক্ষপুরীর রাজার জালের মুখোশের আড়ালে একটা খন্ডিত , সুপ্ত ব্যক্তিমানুষও ছিল। সেই ব্যক্তি মানুষটা মুক্তপ্রাণ নারী- নন্দিনীকে দেখে চঞ্চল হয়েছে; তাকে মুঠোর মধ্যে ধরতে চেযেছে। শুধু রাজা কেন,যক্ষপুরীর সর্দার-মোড়ল-অধ্যাপক-খোদাইকর সবাই যে যার নিজের মতো করে নন্দিনীকে পেতে চেয়েছে । কে এই নন্দিনী? যক্ষপুরীর মতো খনি-সভ্যতায় পুঁজিবাদী শাসন-ব্যবস্থার ঘটনাজালের মধ্যে তার এসে পড়াটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? কাজকর্ম না করে ঘুরে-বেড়ানোর অবাধ স্বাধীনতাই বা নন্দিনী পায় কী করে?”
এই কথাগুলো লেখা আছে মলয় রক্ষিতের একটি বইয়ে, ‘রক্তকরবী, পাঠ ও পাঠান্তরের ভাবনায়’ । নাও বইটা তোমাকে দিলাম পড়তে ।
বিকেলের শেষ সূর্যের আলো এসে মিশে যায় নন্দিনীর কাজল ঘন চোখে ভেসে ওঠা জলে। – সবার কাছে আমি শাসনের বিপরীতে এক প্রতীক মাত্রই রযে় গেলাম!
তার উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে ভেঙে যায় আমার নির্বাক বোধের কাছে। নন্দিনী মাঠের ওপাশে কান পেতে শোনে বিশু ভাইয়ের কথা – “পাগলি, শুনতে পাচ্ছিস ওই ফসলকাটার গান?”
নন্দিনী – শুনতে পাচ্ছি, প্রাণ কেঁদে উঠছে।
জানো নন্দিনী ,আমার কবি শঙ্খ ঘোষ কি বলে – “মনে মনে বলি : অন্যের কাছে যে আচরণ আশা করো, তেমনিভাবে গড়ে তোলো নিজের চলাফেরা। তাই বলে এর উল্টোটা কিন্তু ঠিক নয় । যেমন আচরণ করতে চাও তুমি ঠিক সেইটেই যেন আর আশা কোরো না অন্যদেরও কাছে । তেমন আশা করলেই আহত আর আক্রান্ত হবে মন।
এই বিবেচনাটা হলো মন ভালো রাখবার উপায় । উপায়টা কতদিন ধরে শেখাচ্ছি নিজেকে; শিখছি না তবু! মন কি অত সহজ ব্যাপার!”
লাইনগুলো পড়া হয়ে গেলে বইটা, শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’, ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলি। নন্দিনী আপন মনে গোধূলি আকাশের দিকে চেয়ে বলে,
– সবাই শুধু বাস্তব বিপ্লব আর স্বাধীনতা দেখল গো, এই কান্নার পাশে কখনও কি একমুহূর্ত বসা যায় না, বলো?
চিত্র ঋণ: বিকাশ সরকার
(চলবে)