Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

বি শে ষ  র চ না

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি   পর্ব ৩

ঝাড়বাতি

ঈর্ষাপরায়ণ বা পরশ্রীকাতর কবিদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে। অগ্রজ বা অনুজদের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, তখনও তাঁদের কারো কারো কথাবার্তায় পারস্পরিক হাল্কা বিদ্বেষের আস্তরণ দেখে মনখারাপ হত খুব। ফলে, এখানে কিছু লেখার জন্য যখন তাড়া দিচ্ছিল সম্পাদকদ্বয়, তখনই ‘বিদ্বিষ্ট কবি’ শিরোনামে টইটম্বুর স্মৃতি থেকে ছোটো ঘটনাগুলো তুলে নিয়ে আসার ইচ্ছা হল। কিন্তু সম্পাদকদ্বয় বুদ্ধি করে পুরো কলামটির শিরোনাম দেয়- ‘বাংলা কবিতার আলো-আঁধারি’। সত্যিই তো স্মৃতির অধিকাংশ প্রাঙ্গণই আলোকিত হয়ে আছে। তাই, সামান্য তিমিরপুঞ্জের ছবি না হয় আবার পরে কখনো!

 পঞ্চাশের দশক থেকেই বাংলা কবিতার জগতে দুই কবির নাম একইসঙ্গে উচ্চারিত হতে দেখেছি আমরা। সুনীল-শক্তি বা শক্তি-সুনীল। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল তা ওঁদের বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠজনেরা নানাভাবে জানেন বা ব্যাখ্যাও করবেন হয়তো। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁদের দু’জনের পরস্পরের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসামিশ্রিত টান অনুভব করতাম। একটা ঘটনার কথাই উল্লেখ করব। ১৯৭৬ সাল। আমার শিলং বসবাসের আয়ু তখন মাত্র ছ’বছর। এর আগে ১৯৭৩ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একা এসে তিনদিন কাটিয়ে গেলেও সেবার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সারাদিন চেরাপুঞ্জি আর মফলঙের ক্যাপ্টেন হান্টের সরাইখানা ঘোরার পর বিকেলে শিলঙের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মঞ্চে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য ওঁদের নিয়ে পৌঁছোলাম। এমন সময় পাক্কা সাহেবি পোশাক পরা এক বাঙালি ভদ্রলোক আমার কাছে এসে জানালেন যে, তাঁর স্ত্রীর খুবই ইচ্ছে তাঁর বাড়িতে ডিনারে যেন সবাইকে নিয়ে যাই। আমি এক ফাঁকে সুনীলদার কাছে গিয়ে সেই ভদ্রলোকের ইচ্ছের কথা জানাতেই তিনি বলেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই। অনুষ্ঠানের পর কোথাও তো বসতে হবে!’ শক্তিদাও রাজি। ভদ্রলোককে সে কথা জানাতে তিনি অত্যন্ত আপ্লুত হলেন। পরে জেনেছিলাম তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো এক সংস্থার উঁচু পদে চাকরি করেন এবং মাত্র কয়েক মাস হল বদলি হয়ে এসেছেন শিলঙে। এবং তাঁর স্ত্রী কবিতা সিংহের বান্ধবী। তাঁরই ইচ্ছেয় আমরা সেদিন ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম।

এ পর্যন্ত লিখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সেই সন্ধ্যার জমায়েতে যাঁরা আমন্ত্রিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত। সাক্ষী হিসেবে বেঁচে আছি শুধু আমি ও শীর্ষেন্দুদা। হ্যাঁ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও আমাদের সঙ্গে ছিলেন সেদিন। নেই পঞ্চাশের অবহেলিত শক্তিমান কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত এবং সদ্যপ্রয়াত বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সৌমেন সেন-ও। এঁরা দু’জনেই তখন শিলঙে থাকতেন। এঁদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আঁতের টান ছিল ভয়ানক। তো, সেদিন সেই  ভদ্রলোক বিপুল পানাহারের আয়োজন করেছিলেন। শীর্ষেন্দুদা কেবল আড্ডাতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন, অন্য কিছুতে নয়। এক সময় সুনীল-শক্তির দ্বৈত কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আড্ডার মেজাজ তুঙ্গে তুলে দেয়। আমরাও গলা না মিলিয়ে থাকতে পারিনি। মাঝে মাঝেই আসর ছেড়ে ওয়াশরুমে যেতে হচ্ছিল। তো একবার প্রায় মধ্যরাতে আমি আর শক্তিদা একসঙ্গেই ওয়াশরুমের দিকে এগোই। তখন কারোরই সোজা, স্থির হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। মনে আছে, আমি ওই অল্প বয়সে শক্তিদাকে বলেছিলাম, ‘শক্তিদা, রবীন্দ্রনাথের পরে আপনিই বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড়ো কবি।’

ওই অবস্থাতেও শক্তিদা সঙ্গে সঙ্গে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলেছিলেন, ‘না না, আমি নই। সুনীল,সুনীল।’ এমনই ছিল তাঁদের পরস্পরের সম্পর্ক। আমি জানি না এখন কোনো এক সমসময়ের কবি অন্যের সম্পর্কে এমন দরাজ হবেন কিনা! হলে বাংলা কবিতার অঙ্গন জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয়ে উঠবে নিশ্চিত।

আরও পড়ুন...