অ নু বা দ
১
বাগানের মধ্যে সাদা একটা গোলাপ পুড়ে যায়। কিছু কি বলার আছে এটা নিয়ে? কোট না পরেই আমি দাঁড়াব এখানে আর কথা শুনবো অন্যদের। একজন অভিযোগ করে তার খিদে পেয়েছে। কিন্তু আগেও তো দেখেছি ক্ষুধার্তদের। আজ রাতে আমি এসবের মধ্যে থাকব না। ক্ষুধার্ত, মরীয়া, উন্মাদ— এরা তো কার্বন হয়ে যাওয়া সেই সব হাড় যাদের ছেড়ে এসেছি আমরা। বাদ দাও। কালো আকশ এখনও মাথার ওপড়ে ওঠে আমাদের।
২
এবং আগুন নেভে। ফুলে ওঠা জিভ গড়ায় মুখের ভেতরে। দাঁতগুলো পরস্পরকে মেজে চকচক করে তোলে। সাদা পাতলা চামড়া উঠে আসে গলা থেকে। মেঝের ওপর গড়াচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী আমাদের কাছেই। বিশ্বাস করা যাবে না আর। যে বিষ ওকে দিয়েছিলাম সেটা কি ভাল নয়? বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া খুলির চোখ কাঁপছে। কী চাইছিল ও তোমার কাছে? খাবার?
৩
বসার ঘরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়। তার শিকারের চামড়া দিয়ে বানানো পোশাক পড়ে জানলার কাছে বসে সিগারেট ধরাচ্ছে পরিচালক। টেবিলের ওপর মাটির পাত্রে সেই শিকারের হৃৎপিণ্ড আর আঙুল। ডিশের ওপর ঝকঝক করছে বিয়ের আংটি। হাতের মুঠোয় থুতনি রেখে পরিচালক চিন্তা করছে অপেক্ষা করছে। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ হয়। এবার হাড়গুলোকে রাখা হয় রুপোর বাক্সে— বড় একটা মঞ্চের ওপর।
৪
নরক থাকে সবসময়। তলোয়ারের মতো আকাশে উঠে যাওয়া গাছে খুব সাবধানে উঠি আমরা। তবু ধারালো ব্লেডে আমাদের পা আমাদের বীজের থলে কেটে যায়। বাতাস উঠলে খুরের মতো ধারালো পাতায় ক্ষতবিক্ষত হয় আমাদের চোখ আর কান। অন্ধকারে আমরা আলগোছে পড়ে যাই যেখানে নদী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমাদের মুখ ভিনিগারে ভরে ওঠে।
৫
খিদে পেল আমারও। সৈন্যরা যখন নদী থেকে তুলে এনেছিল, খাবারের জন্য তাদের পায়ে পড়েছিলাম। আগুনে লাল হয়ে যাওয়া শাবল আমার মুখে ঠেলে ঢুকিয়ে তারপর জ্বলন্ত আগুনের গোলা পুরে দিল আমার ভেতরে। আর্ত চিৎকারে নেমে যাচ্ছিল আগুন আমার জিভ গলা আন্র বুকের ভেতর দিয়ে। আমার দিন রাত্রি একইরকম। নরক থেকে লিখছি এই কথাগুলো, হ্যাঁ।
৬
তুমি যা তাই থাকবে। আগুন একটু চকচকে করে দিতে পারে, কিন্তু সামান্য স্মরণিকাই শুধু সে। চারপাশে যেন নানা মৃত মানুষের স্বর— যারা ভালবাসত যারা ঘৃণা করত একদিন। অন্ধকারে যখন আমরা কাছে আসতে পারতাম না, ছুঁতে পারতাম না, যখন খিদে আর যন্ত্রণার কোনো মানে হতো না, বেঁচে থাকাও ছিল না কোথাও— আর এসব ছিল সেই শাস্তির মধ্যেই।
যদি বলো আরও বড় শাস্তিও আছে, আমি বিশ্বাস করব না। কিন্তু যদি বলো আরো বড় যন্ত্রণা আছে, আমি মেনে নেব, আমি ডেকে নেব তাকে।
১৯৬০ সালে বেরিয়েছিল জেরোম রথেনবার্গের ( জন্ম-১৯৩১) প্রথম কবিতার বই ‘White Sun Black Sun’. সেই বইয়ের শুরুতেই টেলিগ্রামের মতো মিতকথনে তাঁর কবিতাভাবনা জোরালোভাবে জানিয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁর একা রাস্তার শুরু। আগের এবং সমসময়ের সমস্ত চিহ্ন ও লক্ষণ আত্মস্থ করেছেন তাঁর এই যাত্রাপথে। বিভিন্ন জনজাতির verbal এবং non-verbal poetics এর বিপুল বৈচিত্র্য, তার সঙ্গে উত্তর-মার্কিনি ভারতীয় সংস্কৃতি, জাপানি সাহিত্য, দাদাইজম, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রত্নপরিচয়- সব মিলিয়ে ‘Ethnopoetics’ নামে একটি অখণ্ড ভাবনা তিনিই প্রথম এনেছিলেন, যার সাহায্যে সারা বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া লিখিত ও অলিখিত সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে তুলে এনে তাকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে বেরিয়েছিল ‘Technicians of the Sacred’ নামের একটি সংকলন যেখানে আফ্রিকান, আমেরিকান, এশিয়ান ও ওশিয়ানিক কাব্যতত্ত্ব ছাড়াও সেইসব দেশের ধর্মীয় আচার ও প্রথার মূল পাঠ, চিত্রনাট্য, দৃশ্য ও শ্রাব্য সাহিত্য তুলে এনেছিলেন তিনি। ‘Alcheringa’ নামের প্রথম Ethnopoetics পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শে উজ্জ্বীবিত হয়ে পরবর্তী সময়ে আরো পত্রিকা বেরোতে থাকে এবং Ethnopoetics নিয়ে চিন্তায় এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়।
১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জার্মানিতে, একজন মার্কিন সৈনিক হিসেবে। নিউইয়র্কে ফিরে তিনি অনুবাদ করতে শুরু করলেন দু’হাতে। পাউল সেলান এবং গুণ্টার গ্রাসের প্রথম ইংরেজি অনুবাদক তিনিই।
লেখালেখির প্রথম দিকে তিনি এবং রবার্ট কেলি স্প্যানিশ শব্দ ‘Cante Todo’- এর ছায়ায় লোরকাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে সামনে রেখে শুরু করেছিলেন ‘Deep Image’ আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে ‘Sound Poetry’ বা ধ্বনি কবিতা তাঁর অন্বেষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অর্থহীন শব্দাংশ (syllable), ধ্বনি, সুর, বিকৃত উচ্চারণ সবকিছু নিয়ে এমন কবিতা তিনি ভেবেছিলেন যেখানে কবিতা, গান, অর্থহীন জড়ানো শব্দ সবকিছুই একসঙ্গে চলেছে। এই কবিতা কোনো নির্দিষ্ট ভাষার নয়। একে লিখে বোঝানো যায় না, লেখাও যায় না সেই অর্থে। অর্থ খুঁজে পাওয়ার কোনো দায়িত্ব নেই। অর্থের বেড়া ডিঙিয়েই এখানে পৌঁছানো যায়।
অমিতাভ মৈত্র
অনুবাদক