Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ছো ট  গ ল্প

ম ধু সূ দ ন   রা য়

বন্ধু

এবারের ছুটিটা ভালোই কাটল অম্বরীশদের। স্ত্রী রিমি বলেছিল—  “এবার কাছাকাছি কোনও আদিবাসী গ্রামে চলো। আমার বান্ধবী রমিতা গতবছর যেখানে গিয়েছিল ওই বাংলোটা খুব ভালো। পাশেই আদিবাসী গ্রাম। ওকে বলে বুকিং করে রাখি?” অম্বরীশ বাধা দেয়নি। দূরে যাওয়ার খরচ‌ও বেশি। আট মাস হল চার চাকা কিনেছে। গাড়ির ইএমআই— এর খরচ ছাড়াও বেশ কিছু টাকা খরচ হয় গ্রামের বাড়ির জন্য। মামা— মামীর কাছে মানুষ হ‌ওয়া অম্বরীশ রিমিকে লুকিয়ে বেশ কিছু টাকা পাঠায় ওদের। রিমি হয়তো বাধা দেবে না। তবু ও জানাতে চায় না।

বাংলোটা সত্যিই ভালো। তিনদিন অসাধারণ কাটল ওদের। লোকাল একটি ছেলের সৌজন্যে নিকটবর্তী জঙ্গলে হাতিও দেখতে পেয়েছে। হাড়িয়া খেয়ে আদিবাসী নাচেও মজে গেছে। রিমি খুব খুশি, অম্বরীশ‌ও। ফেরার পথে মন কেমন করছিল অম্বরীশের। তিনটে দিন কীভাবে যে দ্রুত কেটে গেল। লাঞ্চটা সেরেছে আজ রাস্তার পাশের এক ধাবায়। খুব‌ই সাদামাটা খাবার। অম্বরীশ ভাবছিল রিমি হয়তো রাগ করবে। না, রিমি রাগ করল না বরং রমিতাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানালো।

গাড়ি ছুটে চলেছে সাঁই সাঁই করে। রোদ পড়ে আসছে। ওদের বাড়ি ঢোকার আগে মোড়টার মুখে নতুন বাজার বসছে, অম্বরীশ গাড়ি থামিয়ে বলল—  “চলো ডাব খাই।” বাজারটা ছোটো হলেও মোটামুটি সব‌ই পাওয়া যায়। কিন্তু ডাব পাওয়া গেল না। রিমি আঙুল তুলে দেখাল দূরে একটা সবজীর দোকানে কয়েকটা ডাব রয়েছে। অম্বরীশ সেদিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল। সবজী বিক্রেতা জয়ন্ত না ? স্কুলে একসঙ্গে পড়ত ওরা। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কে কোথায় ছিটকে গেল! কী অসাধারণ সব কবিতা লিখত জয়ন্ত। দেখতে হ্যান্ডসাম না হলেও স্কুলে মেয়েরা ওর কবিতার জন্য‌ই ওকে আলাদা চোখে দেখত। অম্বরীশের রাগ হত খুব। বিশেষত সঞ্চিতা, ওকে পাত্তা না দিয়ে জয়ন্তর পাশে ঘুরঘুর করত। তবে আর যাই হোক জয়ন্ত কবিতা লিখত দারুণ। ওর দেখাদেখি অম্বরীশ‌ও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিল, জয়ন্ত দু’একটা কবিতা চেক‌ও করে দিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো সঞ্চিতা পড়ে বলেছিল জয়ন্তর মতো নয়। সেই জয়ন্ত এখন সবজী বেচে! ওদের ব্যাচের মোটামুটি সবাই কমবেশি সরকারি চাকরি নয়তো বড়সড় ব্যবসা করে। জয়ন্তকে এই অবস্থায় দেখেই ও নিজেকে যেন গুটিয়ে নিল।

অম্বরীশ গাড়ির ভিতরে এসে বসল। রিমি বলল—  “বসো তুমি, আমি আনছি।” অম্বরীশ একবার ভাবল সামনে গিয়ে কথা বলবে, তারপর‌ই ভাবল রিমি যদি জানতে পারে ওরা একসময় বন্ধু ছিল, কী যে ভাববে ! এত বড় চাকুরিজীবীর বন্ধু কিনা সবজী বেচে!  রিমি এমনিতেই কবিতা-টবিতা পছন্দ করে না। তাছাড়া কথা বলতে গিয়ে যদি জানতে পারে অম্বরীশ এখন সরকারি বড় চাকুরে, কিছু হয়তো চেয়ে বসবে, চাকরি করিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ‌ও দিতে পারে।

রাতে খেতে বসে রিমি বলল—  “তোমাকে আর কাল থেকে সকালে সবজী কিনতে তেমাথার মোড়ে যেতে হবে না। আমি ডাব কিনতে গিয়ে ওই নতুন বাজারের সবজীওয়ালার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি, ও সকালে বাড়িতে সবজী দিয়ে যাবে। ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।”
— “একদিকে ঠিক‌ই করেছ, অফিস যাওয়ার আগে সকালে ওসবের হ্যাপা না রাখাই ভালো। কিন্তু মাছ— মাংসের জন্য, গ্রোসারির জন্য সেই তো বাজার যেতে হবে।”
— “কাল সকালে ও এলে আমি কথা বলে নেব, লোকটার কথা শুনে মনে হল ওকে বললে কথা শুনবে।”
অম্বরীশ চমকে উঠল। সত্যিই জয়ন্তকে কিছু বললেই কথা শুনত। সেবার সঞ্চিতার জন্মদিনে জয়ন্তকে দিয়ে প্রেমের কবিতা লিখিয়েছিল, টাকা দিতে চেয়েছিল অম্বরীশ, যদিও জয়ন্ত নেয়নি কিছুতেই। সঞ্চিতা কবিতাটা পড়ে বলেছিল, জয়ন্তর লেখা পুরো, টুকে দিয়েছিস মনে হচ্ছে!

সারারাত জয়ন্তর কথা মনে পড়েছে। কাল কি একবার ফেরার সময় কথা বলবে?  দরকার নেই, রিমি তো সবজী ওর থেকেই কিনছে, এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেছে সেদিন।  

পরদিন অফিসে কাজের চাপে সব ভুলে গেছে অম্বরীশ। ফেরার পথে এসে দাঁড়িয়েছে জয়ন্তর দোকানের ঠিক পাশের চায়ের দোকানে। না, এক‌ই আছে জয়ন্ত, সেই ইনোসেন্ট লুক, মুচকি মুচকি হাসি। তবে ওকে চিনতে পারেনি। অম্বরীশ অবশ্য আগের থেকে কিছুটা মোটা হয়েছে। চোখে চশমা। মনে মনে খুশিই হল ও, যাক চিনতে পারেনি বেচারা।

সপ্তাহখানেক হলো রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না অম্বরীশের। চোখ বুজলেই জয়ন্তর দুটো চোখ যেন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, সঞ্চিতার প্রতি আলাদা একটা অনুভব ছিল অম্বরীশের, বিভিন্নভাবে বোঝাতেও চেয়েছে, সঞ্চিতা একদম‌ই পাত্তা দেয়নি সেসবে। উল্টে জয়ন্তর সঙ্গে মেলামেশা করেছে নিবিড়ভাবে। এই কারণেই কি জয়ন্তর উপর প্রতিহিংসা গড়ে উঠেছে মনে মনে ?

একদিন পুরনো বন্ধু সুমনকে ফোন করে জয়ন্তর খবর জানতে চায় অম্বরীশ। সুমন বলে, জয়ন্ত তো বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে, কিন্তু ওর বাবা মারা যাওয়ায় পড়াটা চালাতে পারেনি। কোথায় একটা চালকলে কাজ করত শুনেছিলাম।  তারপর আর জানি না। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আমাদের বন্ধু অনির্বাণ দেখি জয়ন্তর নতুন ব‌ইয়ের ছবি পোস্ট করেছে। এটুকুই।

সকাল থেকেই চরম ব্যস্ত রিমি। আজ অম্বরীশের জন্মদিন। রিমি অনেকবার আবদার করেছিল অম্বরীশকে অফিসে না যাওয়ার জন্য, কিন্তু জরুরি মিটিং— এর কারণে ওকে যেতেই হবে।  রিমির মোবাইলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করছে আত্মীয়রা, ওদিকে রান্নার ব্যস্ততা, নাজেহাল অবস্থা। অম্বরীশের ভালো লাগছে খুব, রিমি ওর পছন্দের অনেকগুলো পদ রান্না করছে। ও কথা দিয়েছে রিমিকে, দুপুরে বাড়ি ফিরে লাঞ্চ করবে।

অফিস থেকে ফিরতে বেশ কিছুটা দেরি হয়েছে অম্বরীশের।  ফ্রেশ হয়ে যখন খেতে বসল, রিমি বলল—  “একটা খারাপ খবর আছে, কাল থেকে সকালে সবজী আনতে বাজার যেতে হবে তোমাকে। মোড়ে যে বাজার বসত ওখান থেকে বাজার তুলে দিচ্ছে।”
— “সে কী, কেন?”
— “রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে যে। জয়ন্ত আর ওর বৌ সঞ্চিতা দেখা করতে এসেছিল আমার সঙ্গে, বলে গেল দোকান আর থাকছে না, ওরা গ্রামের বাড়ি ফিরে গেল। তবে না খাইয়ে ছাড়িনি ওদের, প্রথমের দিকটায় খেতে চাইছিল না, তোমার জন্মদিন বলায় তবে খেলো দু’জনে। খাওয়ার পর অপেক্ষা করছিল তোমার জন্য, দেরি দেখে একটা ব‌ই রেখে গেল ওই টেবিলে।”
অম্বরীশ ছুটে টেবিলে গিয়ে ব‌ইটা হাতে তুলে নিল, জয়ন্ত‌র লেখা কবিতার ব‌ই। দ্বিতীয় পাতায় লেখা—  ‘শুভ জন্মদিন। না চিনে ভালোই করেছিস অম্বরীশ, রিমির বন্ধুত্বটা মাথায় তুলে রাখব।’
অম্বরীশের চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে ভীষণভাবে।

রিমি অম্বরীশের কাঁধে হাত রেখে বলল—  “লুকিয়ে গেলে সব কিছু?”
অম্বরীশ নিশ্চুপ। রিমি আবার বলল—  “নতুন করে শুরু করো, ফোন নাম্বার তো আমার কাছে আছেই।”
রিমি ফোন করল জয়ন্তকে, ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল—  ‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড ইজ সুইচড অফ।’

আরও পড়ুন...