স্মরণ । নাসের হোসেন
ঈশ্বরও ঈর্ষা করতেন নাসেরকে, কেননা তিনি চেষ্টা করেও যা হতে পারেননি, নাসের প্রকৃতিগতভাবেই ছিল ঠিক সেরকম। ওর মুখ ছিল প্রসন্ন, দ্যুতিময় স্ফটিকের মতো। প্রথমবার যে সামনে এসেছে নাসেরের, সে ওর সাদা আত্মায় পৌঁছে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। অনেক বছর আগে বুড়ো একজন ভিক্ষুককে দেখেছিলাম বিস্ময় নিয়ে ওর মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে। তাকে টাকা দিয়ে নমস্কার করে অন্যমনস্ক ভাবে ধীরে ধীরে হাঁটছে নাসের, আর সেই মানুষটি মুখ ফিরিয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছে তাকে।
ধীরে সুস্থে হাঁটত নাসের। ওর শরীরের ভঙ্গিতে কোনো দ্রুততা ছিল না কোনোদিন। একজন শান্ত ধ্যানস্থ মানুষ সুদূর প্রসন্ন চোখে হেঁটে যাচ্ছে— এভাবেই সবাই দেখেছে ওকে হাঁটতে। সম্ভবত বছর ৪৫ আগে প্রথম দেখেছিলাম ওকে। ও সাইকেল চালাতে জানত না। সব জায়গায় ধীরে সুস্থে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত। কাঁধে সবসময় থাকত ভারী ভারী বই আর পত্রিকায় ঠাসা বড়সড় একটা ব্যাগ। সবার জন্য পত্রিকা বা বই রাখা আছে সেখানে। শান্তভাবে ও ব্যাগ থেকে বের করবে ‘কবিতা পাক্ষিক’ বা কোনো বই। সামনে বসে যত্ন করে লিখবে “প্রিয় অমিতাভদাকে/ নাসের” তারপর তারিখ লিখে হাতে তুলে দেবে। কলকাতা, বহরমপুর ছাড়াও সারা পশ্চিমবং যখনই যার সাথে দেখা হয়েছে, সবাইকে ঠিক এভাবেই যত্ন আর সম্মানের সঙ্গে কিছু দিয়েছে ও। কতো হাজার বই-পত্রিকা সারা রাজ্য জুড়ে যে ছড়িয়ে থাকল এভাবে কতো বছর ধরে! কতো “নাসের” যে ছড়িয়ে থাকল!
যেদিন থেকে ও চাক্রিতে এসেছে, প্রতি সপ্তাহশেষের সন্ধ্যায় ও বহরমপুরের জন্য বেরিয়ে পড়ত। আর প্রতি সোমবার ভোরে কলকাতায় ফেরার ট্রেন ধরতে ও প্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকত বহরমপুর স্টেশনের পেপার স্ট্যান্ডে।
ট্রেনে বসে প্রথমেই বেশ কয়েকটা কাগজের শব্দছক একাগ্রভাবে সম্পূর্ণ করে, কোনো কবিতার বই বা পত্রিকার ঢাউস সব প্রুফ দেখতে শুরু করতো। কতো হাজার বই বা পত্রিকার প্রফ দেখা আর তা যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজ যে করে গেছে ও সারাজীবন ধরে তার ইয়াত্তা নেই। এক শীতের সকালে লালচে চোখ আর কাশি নিয়ে ওর স্বাভাবিকের থেকে ভারী গলায় ডাকল আমাকে। পত্রিকা দিল ঘরে এসে। জানলাম আগের রাতে ট্রেন লেট ছিল। সাড়ে বারোটায় স্টেশ্নে নেমে ও আর বাড়ি যায়নি। বয়স হয়েছে মায়ের, রাত্র ঘুম থেকে উঠে এসে দরজা খুলতে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়! স্তব্ধ হয়ে শুনেছিলাম। পড়ে জানলাম আগেও এরকম করেছে নাসের। সজহভাবে সম্পূর্ণ ফাঁকা স্টেশনে একটা খবরের কাগজ পেতে বসে সারারাত জেগে অন্যদের জন্য প্রুফ দেখে যায় তখন।
বছর পঁচিশ আগে এরকমই রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরছে নাসের। খুব শীত পড়েছে। বেথুয়াডহরীর পর কামরায় একা নাসের। নির্বিকার কাজ করে চলেছে ও। হঠাৎ খেয়াল হয় ওর সামনে তিনজন দাঁড়িয়ে ওকে তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ আর যা কিছু আছে দিয়ে দিতে বলছে। তারপর নাসেরর মাথা পিস্তলের বাট দিয়ে মেরে ফাটিয়ে রক্তস্নাত নাসেরকে কামরায় রেখে সবকিছু নিয়ে চলে যায়। রক্তমাখা শরীরে বহরমপুরে নামার পর চেনাজানা কয়েকজন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। চারটে সেলাই পড়েছিল মাথায়। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন ওঁরা। নাসের এড়িয়ে যায় এবং সারারাত স্টেশনের বাইরে এক বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে মাচায় বসে কাটায়। ওর মনে হয়েছিল স্টেশনের ভেতরে গেলে ওকে হয়তো জোর করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।
সবখানেই ওর উপস্থিতি ছিল অনুচ্চকিত এবং মধুর। নিচু মুখে আত্মমগ্ন হয়ে বসে থাকত খুব উচ্ছ্বাসপূর্ণ চায়ের দোকানের আড্ডায় বা অন্য কবিতাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে। নিজেকে নিয়ে, নিজের লেখা নিয়ে একটা শব্দও কখনো মুখ ফসকে বলেনি নাসের। সারা জীবনে একবারের জন্যও কোনো নেশার জিনিস হাতে নেয়নি। কোনো মদের আড্ডায় কেউ লাগাম হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পরিচর্যা করার দায়িত্ব ছিল ওর। ন্যূনতম কোনো বিরক্তির আভাস জীবনে কখনো কেউ দেখতে পায়নি ওর মুখে।
সময় নাসেরকে হারাতে পারেনি কখনো। সময় যেন গতিহীন হয়ে যেত ওর সামনে এসে। কোনো তাড়া ছিল না ওর। বেলা বারোটায় খুব শান্তভাবে আমার বাড়ি থেকে চলে যেত তিন কিলোমিটার দূরে অন্য কোনো বন্ধুর কাছে। সেখান থেকে দু’কিলোমিটার দূরে আরেক বন্ধু অপেক্ষা করছে ওর জন্য। নাসের যাবে তার কাছেও। রাত দুটোর সময় ফোন করলে, যদি ধরতে একটুও দেরি হয়, নাসের অপরাধীর মতো মার্জনা চাইবে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য।
ঈশ্বর কি পারতেন এরকম? মনে হয় না। এই সুদূরতা, এই উচ্চতাকে ঈশ্বরও দেখতেন ঘাড় উঁচু করে- যেভাবে পাহাড়ের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে তার উঁচু চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা।
বিদায় আমাদের সান্তাক্লস! আমরা বোধহয় বড়ো হয়ে গেলাম।