ছো ট গ ল্প ১
গ্রামের প্রবেশমুখে প্রথম ধাক্কাটা খেলেন তিনি।
উপত্যকার ছোট্ট গ্রামটির সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে। বিপদে-আপদে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁর কাছে ছুটে আসে, আর তিনিও সাধ্যমতো সাহায্য করেন কিংবা পরামর্শ দেন।
গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি; পশ্চিমে ও দক্ষিণে কাপ্তাই লেকের বিস্তৃত জলরাশি, পূর্বে উঁচু পাহাড় আর উত্তরে বিলাইছড়ি উপজেলা সদর—খুব বেশি দূরে নয়, ইট বিছানো পথটা ধরে মিনিট কুড়ি হাঁটতে হয়।
গ্রামটি দুই ভাগে বিভক্ত। গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে শান বাঁধানো ঘাটসহ একটি পুকুর আছে। পুকুরের উত্তর দিকের বাড়িগুলো আদিবাসীদের আর দক্ষিণ দিকের বাড়িগুলো বাঙালি সেটেলারদের।
গ্রামটি দুই ভাগে বিভক্ত হলেও বাসিন্দারা মিলেমিশেই থাকে। তাদের সম্প্রীতির বন্ধন বিভক্ত নয়। শান্তিচুক্তির আগে অবশ্য একবার একদল বহিরাগত গ্রামের দুই অংশে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিতে এসেছিল। তখন তিনি গ্রামবাসীদের নিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন ওদের অপচেষ্টা। সেই থেকে গ্রামের ছোটো বড়ো সকলেই তাঁকে সমীহ করে।
কিন্তু এখন, এই গোধূলিবেলায় গ্রামের প্রবেশমুখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকা ছেলেপুলেরা তাঁকে দেখেও দাঁড়াল না! উল্টে যেন চিনতে না পেরে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল!
‘মাস্ক পরেছি বলে চিনতে পারল না? তা কী করে হয়? দেশে করোনা শনাক্ত হবার পর থেকেই তো মাস্ক ব্যবহার করছি। সবাই চিনতে পারছে। তাহলে?’ তিনি মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন।
পুকুর পেরিয়ে ওয়াক্ত মসজিদের কাছে এসে তিনি দেখলেন মুয়াজ্জিন ছেলেটা অযু করে দাঁড়াল এবং তাঁকে একপলক দেখে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কালেমা শাহাদত পড়তে লাগল।
তিনি দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলেন। ‘আশ্চর্য! ছেলেটা আমাকে দেখলেই লম্বা একটা সালাম দেয়। আর এখন…!’ তিনি বিড়বিড় করে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
নিজের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়েও শব্দ করতে হঠাৎ তাঁর ভয় হলো- ‘যদি ওদের মতো এরাও না চেনে আমায়!’
পরক্ষণেই মাথা দুলিয়ে সামান্য হেসে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, বাড়ির মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক, প্রতিবেশীরা না চিনলেও এরা নিশ্চয়ই তাঁকে চিনতে পারবে।
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই গেটে শব্দ করলেন তিনি।
তাঁর ক্লাস সিক্স পড়ুয়া ছেলে গেট খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনি? কাকে চান?’
তিনি ভেতরে ভেতরে মুষড়ে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমি, তোর বাবা…।’
‘ও, আপনি বাবার কাছে এসেছেন? বাবা তো বাড়িতে নেই।’
তাঁর স্ত্রী ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে রে খোকন?’
‘মা, এদিকে এস। একজন মুরুব্বি এসেছেন বাবার কাছে।’
‘আমি অযু করেছি, ওঁকে ভেতরে বসতে দে।’
তিনি আগের মতোই কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমি না হয় অন্য সময় আসব।’
আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে তিনি হাঁটতে লাগলেন। পেছনে গেট বন্ধ করবার শব্দ শোনা গেল।
হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে এলেন কাপ্তাই লেকের ধারে, পানির কাছে। তাঁর পায়ে লেগে গেছে আঠালো কাদা। চৈত্র মাস বলে লেকের পানি বেশ নেমে গেছে। তিনি তাঁর জুতো জোড়া রেখে এসেছেন ভরা বর্ষায় লেকের পানি যে পর্যন্ত ওঠে, সেখানে।
মাগরিবের আযান শেষ হয়ে গেলেও আবছা আলোয় লেকের পানিতে যে মুখটা তিনি দেখলেন সেই মুখটা তাঁর নয়! তিনি হকচকিয়ে গেলেন। তাঁর শরীরে এ মুখটা কার? হঠাৎ কেন-ই বা এ পরির্বতন? সহসা কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না এসব প্রশ্নের।
তিনি জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মানুষ। তাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে পেছনের ঘটনাগুলো আরেকবার ভেবে দেখতে চাইলেন। গ্রামে ঢুকবার আগে তিনি বাজারে গিয়েছিলেন, সেখানে সব ঠিক ছিল। তার আগে গিয়েছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, সেখানে তিনি অপূর্ব চাকমা-র শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন পরিচিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জট খুলে গেল! মনে পড়ল, বাজার থেকে বেরিয়ে একা হাঁটতে হাঁটতে তিনি অপূর্ব চাকমা লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দেবার একটা ফন্দি এঁটেছিলেন।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার এড়াতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির প্রথম দিনই অপূর্ব গ্রামে চলে এসেছে। আর এই দু’সপ্তাহে অন্তত তিনবার তাঁর মতের বিরোধিতা করে জনসমক্ষে তর্ক জুড়ে দিয়েছে এবং আড়ালে বিভিন্ন কথা বলেছে কয়েকজনের কাছে। অথচ তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, বছর তিনেক আগে সে সর্বশেষ গ্রামে এসেছিল এবং তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিল। কিন্তু এবার সে তাঁর সঙ্গে কেন এমন বিরোধপূর্ণ আচরণ করছে তা তিনি ভেবে পাননি।
তো, সেই অপূর্ব গতকাল সর্দি-জ্বর নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছে। করোনার উপসর্গ বলে তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে এবং নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যকর্মীর থেকে এ-সব জেনে নিয়ে তিনি বাজারে ঢুকেছিলেন। তারপর বাজার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন অপূর্ব-কে শিক্ষা দেবার জন্য রাতেই কারোর মাধ্যমে গ্রামে রটিয়ে দেবেন যে, সে করোনা আক্রান্ত, ওর বাড়ির আশেপাশে কেউ যেন না যায়!
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার যে কৌশল তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন তার জন্য খুবই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘অস্তাগফিরুল্লাহ!’ তারপর উবু হয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে লেকের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলেন। আর ভাবলেন, অপূর্ব সুস্থ হয়ে ফিরলে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন।
তিনি যখন বিমর্ষচিত্তে লেক থেকে উঠে আসছেন তখন ঘরের জানালা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তাঁর মেয়ে চিৎকার করে জানতে চাইল, ‘এই অসময়ে তুমি ওখানে কী করছ বাবা?’
তিনি বেশ স্বস্তি পেলেন এবং উঁচু গলায় বললেন, ‘মানুষের একটা মুখের আড়ালে অনেকগুলো মুখোশ থাকে মা, তারই একটা লেকের পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম।’
‘তুমি কী সব ভারি ভারি কথা বলো না বাবা! চলে এস।’
তাঁর ছেলেটা তেমনই চিৎকার করে বলল, ‘বাবা, একটা লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।’
‘সে আর কোনোদিন আসবে না।’