নতুন বইয়ের আগাম খবর
অনিন্দ্য রায়
কোনও কোনও বই পড়বার পর মনে হয় হয়তো না-পড়লেই ভালো হয়।
সেলিম মণ্ডলের ‘কাঁচা মাংসের বাড়ি’ বইটির পাণ্ডুলিপি পড়বার সুযোগ হল আমার। আর প্রাথমিক পাঠের শেষে মনে হল, কোনও কোনও বই হয়তো না-পড়লেই ভালো হয়, যেমন, এই বইটি।
৬৪ পৃষ্ঠার একটি বই, বাংলা কবিতার একটি বই যে এমন অব্যর্থ আয়ুধ হয়ে উঠতে পারে, পাঠকের ভাবনার স্থিতাবস্থাকে এমন টলিয়ে দিতে পারে, ভেতর থেকে ফালাফালা করে দিতে নিরাপদ খেলার প্রতিভা তার প্রমাণ হয়ে রইবে এই বই, বইয়ের কবিতাগুলি। এবং আমাদের তাড়িত করবে, এবং আমাদের নিরন্তর ভালো-থাকার অভিলাষকে বিঘ্নিত করবে।
প্রবেশক কবিতায় সেলিম আমাদের সঙ্গে বাড়িটির পরিচয় করিয়ে দেন।
‘দু-কামরার বাড়ি
এক কামরায় মা-বাবা, আরেক কামরায় থাকে মুনাই
আমি থাকি বারান্দায়
আমি অভিজ্ঞ কসাই
একবার এ-ঘর থেকে কাঁচা মাংস কেটে আনি, আরেকবার ও-ঘর থেকে
মাংস ফুরোয় না, কাঁচা মাংসের বাড়িতে হয়ে উঠি সফল ব্যবসাদার’
কার শরীর থেকে কাঁচা মাংস কেটে আনার কথা বলেন কবি? মা-বাবার? মুনাইয়ের? না কি তাদের ঘরে পুষে-রাখা কোনও পার্থিব জন্তুর? না কি তাদের ভেতরে পুষে রাখা সম্পর্কের টুকরো, কাঁচা, কেটে এনে তিনি, কবি ও কসাই, কবিতা লেখেন? আমরা তা পড়ে চমকে উঠি, তবে কি প্রিয়জনের শরীর কেটে, অনুভূতি কেটে, বিক্রি করে কবিরা সফল ব্যবসাদার?
কিন্তু এই পারিবারিক ঘেরাটোপে বদ্ধ থাকে না কবিতা, উড়ান দেয় মহাকাশে।
‘মা আমাকে রোজ চাঁদ রান্না করে খাওয়ায়
আমি ঘনঘন জ্যোৎস্নাঢেকুর তুলি
একদিন মা চাঁদের পরিবর্তে সূর্য রেঁধে খাওয়াল
নিভে গেল সমস্ত আলো
তবুও আকাশ বাটিতে চিবোতে লাগলাম সূর্য
দাঁতের বিরাট ফাঁকে দাউদাউ করে উঠছে গ্রহণ
মা ফুঁ দিচ্ছে, মা তরকারি জোগাড় করছে
দূর থেকে ঘোষণা হচ্ছে—
সৌরকেলেঙ্কারি
সৌরকেলেঙ্কারি’
(সৌরকেলেঙ্কারি)
এ কোন খাদ্যের মহাজগতে আমাদের নিয়ে আসেন সেলিম! শব্দের আড়ালে ঝলসে ওঠে মিথ আর মিথের আড়াল থেকে অবনির্মিত কবিতার মুখোমুখি হই আমরা। ক্ষুধা— সকল প্রাণের এই প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাঠের ভেতর।
‘দ্যাখো— গলাকাটা সাদা হাঁসের বিষণ্ণ লাল
ভোরের পায়চারি সেরে
কীভাবে কোনো আমিষ সকালের পিঠে লাফাচ্ছে
ভাত
ভাত
ভাত
আধখানা থালায়— রাহু খাওয়া চাঁদের মতো
কোথাও অমোঘ ডুব নেই
শুধু, ছেঁড়া পালকের প্যাঁক্ প্যাঁক্ প্যাঁক্
ক্ষুধাভিক্ষুককে ঈশ্বর বানিয়ে দেয়!’
(ক্ষুধাভিক্ষুক)
খাদ্যের সামনে খাদককে একইসঙ্গে ভিক্ষুক ও ঈশ্বর বানিয়ে তোলেন কবি।
বইটি থেকে উদ্ধৃতি শেষ হতে চায় না, প্রতিটি কবিতাই উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ। প্রতিটি কবিতাই একই সঙ্গে অন্তর্মুখী ও কেন্দ্রাতিগ, যা কবিতাভাবনার ঘুর্ণনপথকে ব্যালেন্স করে আর একটি লুপের মধ্যে নিয়ে আসে আমাদের; একেকটি কবিতা মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে... এতটাই আক্রান্ত হই আমরা এই হ্রস্ব অথচ ধারালো কবিতাগুলির সংস্পর্শে।
ভালো-থাকার প্রচেষ্টা ও অভিনয় আমাদের টলে যায়। পারিবারিক যাপনের ক্ষত ও মায়া ফুটে ওঠে।
‘আমাদের পরিবারের একটিই আয়না
এই আয়নাতে আমরা সকলেই মুখ দেখি
কী আশ্চর্য, একটিই, একটিই মুখ সেখানে ধরা পড়ে’
(আয়না)
অপরার ভেতর এভাবেই আলো বিচ্ছুরিত হয়। ‘আমি’ ও দেখা-না-দেখার চরাচর আলোকিত হয়ে ওঠে। যে খিদে ও খাবারের পথ দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ‘পেরেক’ দিয়ে ‘সূর্যাস্ত সেলাই’ করা ‘জলন্যাকড়া’য় মুছিয়ে দেয় ‘চোখ’, ‘শিয়ালদা’ থেকে ‘উচ্ছেক্ষেতের কবিতা’ ‘নিজস্ব শ্মশান’ পার হয়ে ঘুরতে যায় ‘তিনের দেশে’— এই ‘নিরুদ্দেশ’, এই ‘প্রিয় অসুখ’ ছিঁড়ে ফেলে সব ‘অবরোধের পতাকা’।
অতিরিক্ত শব্দ নেই, খুব আস্তে উচ্চারিত কবির একান্ত মোনোলগ স্পর্শ করে আমাদের। ভাবায়। আবার পড়িয়ে নেয় কবিতাগুলিকে। বারবার।
আমরা ভালো থাকি না। যে ভালো-না-থাকায় বাঁচতে চান পাঠক, কবিতার পাঠক।
পাঠককের মনোরঞ্জনের জন্য লেখেন না সেলিম। লেখেন নিজেকে, সেই নিজের সেলিম এতদিন অচেনা ছিল আমার।
কিছুটা কি পারলাম চিনতে এই বই পড়ে? দেখতে পেলাম বাংলা কবিতার ভবিষ্যতের রাস্তা?
কোনও কোনও বই পড়বার পর মনে হয় হয়তো না-পড়লেই ভালো হয়।
সেলিম, লিখুন আরও, ভানসর্বস্ব ভালো-থাকা ধ্বংস হোক। আয়নার মুখোমুখি আমরা চিনে নিই আমাদের কসাই সত্তাটিকে।
ইতিকথা পাবলিকেশন
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় পরিসরে শ্রীচৈতন্যর ভূমিকা সর্বজনমান্য। তুর্কী আক্রমণ পরবর্তী বঙ্গদেশে আচার, আচরণসহ সমস্ত দিকেই যে বিজাতীয় বৈপরীত্য জোর ক'রে চাপিয়ে দেওয়ার উদগ্র প্রয়াস, শ্রীচৈতন্য তাঁর বিপ্রতীপে মূর্তিমান বিপ্লব। আধ্যাত্মিক প্রেক্ষিতে দেখলে, বৈষ্ণব রসতাত্ত্বিক শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদর যা উল্লেখ করেছেন তা হ'ল -- ' রাধার প্রণয়-মহিমা, শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের মাধুর্য এবং সে মাধুর্য আস্বাদনে রাধার পরিতৃপ্তি কিরূপ ' এই ত্রিবিধ রস আস্বাদনে শ্রীভগবানের, শ্রীচৈতন্য রূপ পরিগ্রহ। আর সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যর পরোক্ষ ভূমিকা স্বীকৃত কিন্তু তাঁর রচিত শিক্ষাষ্টকসহ অন্যান্য কিছু স্তোত্রের কাব্যমূল্য নিতান্ত সামান্য নয়। শিক্ষাষ্টকের মূল উপজীব্য যদিও গৌড়ীয় বৈষ্ণবের জীবনসাধনার মূল প্রতানকে চিহ্নিত ক'রে তবু সেই যাত্রাপথে শ্রীচৈতন্যর যে কবিত্বের দ্যুতি তা অসামান্য। জগন্নাথ-অষ্টকের উপজীব্য জগদীশের সঙ্গে একাত্ম হবার আকুতি -- ' জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে। ' এছাড়াও বেশ কিছু কবিতার ভাবানুবাদ সন্নিবেশিত হয়েছে এই প্রয়াসে৷
ইতিকথা পাবলিকেশন