Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

পা ঠ  প্র তি ক্রি য়া  ২

প ল্ল বী   মু খো পা ধ্যা য়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— স্বীকারোক্তিমূলক এক কবির জার্নি

কবিতার কথা ভাবতে বসে বুদ্ধদেব বসুর একটা কথা মনে হয়- “… আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যাবে।” আধুনিক কবিতায় প্রত‍্যেক কলমের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার চরিত্র বদল ঘটেছে। ৪০-৫০এর দশক হল উত্তেজনার দশক। বিশেষ করে ৫০-এর দশক।

 

এ সময় অনুভূতিকে পালিশ না করে সরাসরি কবিতায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গভীর যন্ত্রণা, হতাশা, রোমান্টিকতার সঙ্গে ব্ল‍্যাক রোমান্টিকতা, উত্তরনের কামনা, দেহ কামনার সঙ্গে অতীন্দ্রিয়বোধ, নাস্তিকের সঙ্গে ঈশ্বর, পাপ পুণ‍্য বিভিন্ন পক্ষপাতের মতো প্রচুর চিন্তা চেতনা নিয়ে কবিতার ভাঙা গড়া চলে।

 

৫০এর দশক লিরিকধর্মিতাকে প্রায় বিসর্জন দেয়। শীতলতাময় উচ্চারণের প্রবণতা উঠে আসে। সে সময়ের একজন শক্তিশালী কলমের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলম যেন আরও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। ওঁর ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কাব‍্যগ্রন্থের নামকরণ থেকেই এই সময়ের কবিতার চরিত্র যে আরও একটা স্বাধীন আঙ্গিক খুঁজে পাচ্ছে তা বেশ ভালোই বোঝা যায় কবিতা পড়তে বসলে।

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘বন্দী জেগে আছো’, ‘মন ভালো নেই’, ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ এইসব কাব‍্যগ্রন্থ থেকে সেই অনায়াস স্বাচ্ছন্দ‍্য দেখতে পেয়েছি।

 

প্রতিটা কবিতায় কোনোরকম আড়াল না রেখে সরাসরি কথা বলার কৌশল মুগ্ধ করেছে। অসংকোচ রীতিতে শব্দ সাজিয়েছেন।

 

আমার সামান্য জ্ঞানে মনে হয়েছে স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য এই প্রকরণের হয়তো প্রয়োজন ছিল। যেমন “সপ্তম গর্ভের কন‍্যা” কবিতায় বলেছেন—

 “সপ্তম গর্ভের কন‍্যা, কেন এলি যে বাড়িতে 

উনুন জ্বলে না?”  এইভাবে শব্দকে পালিশ না করে বাস্তবের ভ্রূণ থেকে জল ভেঙে শব্দ এনেছেন। 

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার কোনো এক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের মধ্যে কোনোরকম পরামর্শ না করেই যে নতুন রীতিতে কবিতা লিখতে শুরু করেছে, তাকে বলা যেতে পারে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা…”

 

বেশ কিছু কবিতায় এমন ধর্মও দেখেছি –

 

“আমার নাকি বয়েস বাড়ছে? হাসতে হাসতে এই কথাটা 

স্নানের আগে বাথরুমে যে ক’বার বললুম!”

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা প্রায় ১৭টা কাব‍্যগ্রন্থ থেকে বেছে নেওয়া কবিতা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ফলে বিভিন্ন স্বাদ একসঙ্গে আস্বাদন করার সুযোগ হয়। শিল্পের শুদ্ধতার আধুনিকতাকে আরও কাছ থেকে দেখি।

 

আমার কাছে সুনীল-কবিতা একটা যুগও বটে— যেখানে রয়েছে এক বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠী। আসলে অনুভবকে পুরো মূল্য না চুকিয়ে দিয়ে শুধু মেধা ও মননের চর্চা কিংবা রূপকলা তৈরিতে সচেতন হওয়া— কবির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলে, পাঠক হারাবার ভয় থেকেই যায়। যে ভয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনোদিনই ছিল না। যে কারোর মন পড়তে পারে ওঁর কবিতার শব্দরা—

 

“সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশী, আমায় ভুল বুঝবে?” (সখী আমার)

 

এক নিঃশ্বাসে কবিতা পড়ে শুধু উত্তাপকে অনায়াসে উপলব্ধি করেছি। ক্লান্তি দূর দূরান্তেও অনুভব করিনি। অনুবাদও তাঁর সাবলীল, নরম, মোলায়েম— “তখন তোমার বয়স আশি, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায় / নিজেই বিষম চমক যাবে, ভাববে এ কে? সামনে এ কোন্ ডাইনী?” ( ফরাসী কবিতার ভাব-অনুসরণে)। তাঁর কবিতায় রসবোধের তীক্ষ্মতাও অসাধারণ— “গাঁয়েতে এয়েছে এক কেরামতি সাহেব কোম্পানি/ কত তার ঢ‍্যাঁড়াকাড়া…” ( হাসান্ রাজার বাড়ি)

 

কি অদ্ভুতভাবে শরীরের উপর যৌবনের তৃষ্ণা এঁকেছেন। যেন এক ঘুমন্ত নারীর যৌবন স্পর্ধা হয়ে গ্রীবা তুলে শরীরী আকুলতাকে জানান দিচ্ছে। আজ ২০২০তেও আধুনিকতার পারদ, স্মার্টনেসের দিক দিয়ে ভীষণ প্রসঙ্গিক —

 

” ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি

উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু”

 

এমন কলমের সান্নিধ্য পেয়ে মনে সাহস পাই। সবাই নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে বাস্তব লিখলেও হাত খুলে লিখতে সঙ্কোচে পড়েন। শব্দ যে ব্রহ্ম সেটা প্রতিটা শব্দ প্রয়োগে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সমাজের যে চাপ আসতে পারে সেটা জেনে নিজেকে গুটিয়ে বুদ্ধি প্রয়োগ করেননি শব্দে–

 

“বাবরের সঙ্গে দেখা! তিনি হাঁটু গেড়ে 

সোনালি উষ্ণীষ খুলে নামাজ আদায়ে

বসেছেন। আমি কোনো ধর্মেরই প্রকাশ‍্য 

উদ্দীপনে অবিশ্বাসী।..”

 

বাস্তবের কথা ভাবতে গিয়ে কিন্তু রোমান্টিকতা বা প্রকৃতিকে বাদ দিয়েছেন তাও না। প্রকৃতিকে দৈনন্দিন বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। চলাফেরার পথে বা ভালো খারাপ অনুভূতি নিয়ে যাতে প্রকৃতির গায়ে ঠেস দিয়ে বসতে পারি সে ব‍্যবস্থা সজাগ হয়ে করেছেন।

 

“স্তব্ধ নীল আকাশের দৃশ্য অন্তহীন পটভূমি 

চক্ষুর সীমানা– প্রান্তে বেঁধে দিয়ে তুমি 

এঁকে দিলে মাঠ বন বৃষ্টি– মগ্ন নদী…”

 

কবিতায় শিশু সুলভ আবেগ থাকে– প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেমে মগ্ন এমন ছবি আধুনিক তো বটেই, যাঁরা কবিতাপ্রিয় নন এমন পাঠকবর্গকেও এই সাবলীলতা আকর্ষণ করে—

” নীরা, তোমার মনে পড়ে না স্বর্গ নদীর পারের দৃশ্য?

যুথীর মালা গলায় পরে বাতাস ওড়ে…”

 

বিদেশি দর্শনকে আপন করে বাংলা সাহিত্যকে আরও সাজিয়েছেন। গুরুপাক হয়ে হজমে, অর্থাৎ আত্মস্থ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে এমন বিপদেও পড়তে দেননি।

” চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় 

আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে…”

 

অথবা,

 

” ফ্রয়েড ও মার্ক্স নামে দুই দাড়িওলা

বলে গেল, মানুষেরও রয়েছে সীমানা “

 

এককথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার জন্য নতুন কাব‍্য আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর কবিতাকে বলেছেন স্বীকারোক্তি মূলক।

আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পর আধুনিকতার কান্ডারী জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের ঘরানাকে অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু ঘরানা নন, তিনি স্বয়ং এক আধুনিক যুগ যার শতাব্দী কোনো দিনই শেষ হয় না।

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা
দেজ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ – মাঘ ১৩৮৪, জানুয়ারি ১৯৭৮

 

আরও পড়ুন...