বি শে ষ র চ না
আষাঢ় যখন এসে মিশে যায় শ্রাবণে, তখন পুরুলিয়াই আমাদের শান্তিনিকেতন। কাঁসাইয়ের উপর থেকে আষাঢ়ের ভারী মেঘ ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়ে পুরুলিয়া শহরে… পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে। বাঁকজোড় নদীর ধারে একজন অচিন্ত্য মাজি… কিছুটা দূরের একজন সোমেন মুখোপাধ্যায় রাজীব ঘোষাল নিবিড় রায়ের সে সময় ময়ূর-জন্ম শুরু হয়। তারা ছটফট করে। তাদের কাছে বারবার ছুটে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোনও পরিত্রাণ থাকে না।
বেশ কয়েক বছর আগের এক শ্রাবণ। সস্তা-ট্রেনের সস্তা কামরায় চেপে এক সন্ধ্যায় পৌঁছে গেছি পুরুলিয়ায়। হাসি মুখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কবি নির্মল হালদার… আমাদের নির্মলদা। বৃষ্টি নেই; কিন্তু আকাশে মেঘের আনাগোনা তুমুল। মেঘের কোলে চাঁদও আছে। কোদালে কোপানো মেঘের কথা পড়েছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। পুরুলিয়ায় শ্রাবণমাসে একা ঘুরতে আসেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আমার বিশ্বাস। চাকা-নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। কালো পাথরে বসে পা ডুবিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে থাকেন পাগলের মতো। শাল আর পলাশের জঙ্গল কান পেতে শোনে সে গান। এই কারণেই পুরুলিয়ার শাল আর পলাশের এত রহস্যময় রূপ।
শহরের মধ্যে সত্যি সত্যি ‘সন্দেশ গলি’ পেরিয়ে নির্মল হালদারের এক চিলতে ছাদে গোল হয়ে বসে আছি আমরা কয়েকজন। নির্মলদা স্বয়ং, সঙ্গে সুমিত পতি অচিন্ত্য মাজি সুপ্রিয় দেওঘরিয়া সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় নিবিড় রায়…
মেঘের ফাঁক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে চাঁদ। মাথার উপর আয়ুর মতো ঝুঁকে থাকা একটা নিমডালের ফাঁক দিকে গুঁড়ি মেরে ঢুকে চাঁদের আলো ঘিরে ফেলছে আমাদের।
স্তব্ধতার এক লাভার মধ্যে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ছে গান।
অন্ধময়ূরের নাচ পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ও পবিত্র দৃশ্য। কারণ সেখানে দৃশ্য থেকে দৃশ্যের জন্ম হয় না; শ্রুতি থেকে জন্ম নেয় দৃশ্য। এমনকি এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে যে কোটি কোটি ‘চোখ’, অন্ধময়ূরের নাচ সেই দৃষ্টি-নিরপেক্ষ। দৃশ্যের মধ্যে যে temporality আছে তাকে অতিক্রম করে সে ধ্বনি ও সুরের কাছে ছুটে যায়। তার শিখীবিস্তার গূঢ়, রহস্যময়।
হায়, তাঁরা কী দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন যাঁরা শুধু প্রমিত বাংলার কেতাবি সংজ্ঞার মতো সংজ্ঞায়িত এক ডায়ালেক্টে হুগলী-নদীর দু’পাড়ে (কলকাতা-নদিয়া-হাওড়ায়) গীত হওয়া রবীন্দ্রসংগীত শুনে গেলেন। উচ্চারণের শুদ্ধতা নিয়ে তারা হারমিট-ক্র্যাবের মতো এক খোলসে ঢুকে রইলেন চিরকাল। মহাকালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ব্রহ্মপুর-লোকাল ছেড়ে চলে গেল তাঁদের। দিকশূন্যপুর স্টেশনে নামা হল না তাঁদের।
যাঁরা উচ্চারণের শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন, তাঁদের কাছে একটি প্রশ্ন, ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে’ গানটি দু’জন প্রণম্য শিল্পীর কণ্ঠে বারবার শুনেছেন? একজন ‘বিজন’ শব্দটিকে প্রান্তে রুদ্ধদল হিসাবে গাইছেন। আরেকজন গাইছেন ‘বিজনওওওও…’। প্রমিত বাংলার নিরিখে একজনকে অতি অবশ্যই অস্বীকার করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত ভাবে হেমন্ত’র ‘বিজনওওওও…’ বেশি পছন্দের। কিন্তু অন্যজনকে অস্বীকার করবার মতো মতিভ্রম যেন জীবনে না-হয়। প্রমিত বাংলার এই ফারাকটুকুকে যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূম-দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতকেও আপনাকে মেনে নিতে হবে। ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার সঙ্গে অনেকে পৃথক ডায়ালেক্টে রবীন্দ্রসংগীত গাইবার প্রশ্নটিকে গুলিয়ে দিতে চান। বিষয়টি পুরোপুরি আলাদা।
রাত বাড়ছে, এক সময়ে তরুণ কবি অচিন্ত্যর গলায় উঠে আসতে শুরু করেছে রবীন্দ্রনাথের গান। একের পর এক গান ঘুরে চলেছে গোল হয়ে। গান এসে বসছে আমাদের পাশে, অন্ধকারে। প্রায় মাঝরাত, অচিন্ত্য গাইছে, ‘তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ…’
প্রমিত বাংলার থেকে অনেকটা দূরের এক বাংলা… বাঁকজোড়-হাড়াই নদীর ধারে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা এক বাংলাকে আশ্রয় করে রবীন্দ্রনাথের গান উঠে আসছে অচিন্ত্যর গলায়। কী দুর্ভাগ্য তাঁদের, যাঁরা বাঁকজোড়-হাড়াই’এর কাছে লুকিয়ে থাকা বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনলেন না মাঝরাতে।
এক সময় অচিন্ত্য ছেড়ে দেয় গানটিকে, লুফে নেন নির্মল হালদার। অকল্পিত ভাঙনের কিনারায় বসে নির্মলদা গাইছেন, ‘তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে…’
ছায়াপথের এক কোণে ঝলমল করে উঠছে অন্ধ-ময়ূরের নাচ, অন্ধকারে একা।
২
বারো লাইনের এই গানটিতে একটি লাইনই চারবার ফিরে ফিরে এসেছে।
গানটি শুরু হয়েছে একটি assertion এর মধ্য দিয়ে, আমি তোমায় ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে ফেলছি, কিন্তু কোথাও কোনও সংশয় নেই তোমাকে ফিরে পাবার প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথের গানের মহাজাগতিক ম্যাজিকের একটা বড় উপাদান তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা juxtaposition। নতুন করে পাবার আনন্দে এক হারবার বেদনাকে শিখীবর্ণ রহস্যে বন্দনা করছে অন্ধময়ূর।
কিন্তু এ ‘নতুন’ কি পুরানোর বিপ্রতীপ ধারণা থেকে উঠে আসা? প্রেম-পর্যায়ের একটি গানের কথা বিদ্যুৎলতার মতো ঝলসে ওঠে মাথায়… স্নায়ু থেকে স্নায়ুতে ছুটে যায়, ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্যমনে।’
পৃথিবীর প্রখরতম শারীরিক বোধের মৃদুতম প্রকাশ সম্ভবত রয়ে গেছে এই গানটিতেই, ‘মোর দানে নেই দীনতার লেশ, যত নেবে তুমি না পাবে শেষ-’। যেন পবিত্রতম লুন্ঠনের অপেক্ষায় অবলুন্ঠিত হয়ে আছে কেউ।
রবীন্দ্রনাথের এক গান থেকে আরেক গানে ভেলা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক অপার্থিব অনুভূতি বয়ে আনে। সে রহস্যে না-ঢুকে আপাতত আবার সেই গানটির কাছে ফিরে যাই, দেখি ‘সে’ পুরানো নয়। সে নতুন এবং তাকে অধিকতর নতুনভাবে পাবার জন্য এই ‘সর্বনাশ’ ও ‘হারানোর’ আয়োজন। রবীন্দ্রনাথ এটিও বলে দিলেন, গানটির প্রথম লাইনে এ প্রসঙ্গে কিছু না-বলেও বলে দিলেন – আমি তোমাকে আগেই পেয়েছি। না-পেলে হারানোর অধিকার জন্মায় না।
এরপর গানটিতে এক ছায়া পড়ে। শেষ শ্রাবণের মাঝ-দুপুরে কাঁসাইয়ের উপর ভেসে থাকা এক-টুকরো মেঘকে আমি ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যেতে দেখেছিলাম। থাকা না-থাকার মাঝখানে এক লীলা-চঞ্চলতা। মুহূর্ত ও মুহূর্তকে অতিক্রম করে অনাদি। শিকলের একটি বালার মতো মুহূর্ত পড়ে রয়েছে লীলা-চঞ্চলতার কাছে।
রবীন্দ্রনাথের গানের অধিকাংশ জুড়ে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ উচ্চারণ ছেয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে একই সঙ্গে পুরুষ-মনোজগত ও নারী-মনোজগত বহন করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রেমিকাকে (poet persona-র ধারণা অনুসারে প্রেমিকা বলা হল) ও নিভৃত-প্রাণের দেবতাকে একই রকমভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সম্বোধিত করলেন। ইংরেজির you ও বাংলার ‘তুমি’র মধ্যে এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে বারবার হারাচ্ছেন, তিনি যে আত্মার একটি টুকরো সেটি বোঝাতে ‘তুমি’ শব্দটির কোনও বিকল্প হয় না।
অনেবার ভেবে দেখেছি এই গানটিতে একটি মাত্র অতি মৃদু অভিমানে ম্লান লাইন আছে, ‘ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন।’ কোথাও যেন মনে হয় তাঁর ভালবাসার ধনের ‘অদর্শন’ মেনে নিতে পারছেন না রবীন্দ্রনাথ। বারবার তিনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, ‘তুমি আমার নও আড়ালের।’ ভালোবাসার ধর্মতো এই’ই। ক্ষণকালের ‘অদর্শন’ ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এখানেও একটি খেলা রয়ে গেল। গানটির চলন এমনই যে মনে হতে বাধ্য ক্ষণকালের লীলার স্রোতে আসলে তাকে হারিয়ে ফেলছেন কবি নিজেই। মুহূর্তের লীলা যতটা না তাঁর , তার থেকে অনেক বেশি ব্যক্তির।
এই গানটির প্রতিটি লাইনে অকল্পিত রুদ্ধশ্বাস এক সমর্পণ রয়ে গেছে। স্থির হ্রদের পৃষ্ঠতলের মতো শান্ত এক স্বরে প্রথমে তিনি বলছেন, ‘আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন-।’ কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
ঠিক তার পরেই লাইনেই যেন সে হ্রদে এসে পড়েছে এক কক্ষচ্যুত নীল তারা। ঝিরঝির করে কেঁপে উঠছে হ্রদের জল, ‘প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।’ এই ঢেউ গানটিতে আমাদের ভিস্যুয়ালাইজ করতে বাধ্য করালেন তিনি। গানটির প্রথম লাইনে যে assertion ছিল সেটি কিছুটা হলেও ভেঙে যায়, এক ‘প্রেমের কারণেই’ ভেঙে যায়। সম্ভাব্যতার সূত্র অনুসারে সব খোঁজের শেষে ব্যর্থতার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়।
প্রেমে ঢেউ লাগার এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ মাইক্রোর পরিসর ছিন্ন করে ম্যাক্রোর দিকে ছুটে গেলেন। এই জায়গাটিতে এসে লালন শাহের একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়, ‘সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা। জীবের কি সাধ্য আছে তাই বলা।… কখন ধরে আকার কখন হয় নিরাকার কেউ বলে সাকার সাকার অপার’ ভেবে হই ঘোলা।’
এবার গানটি শেষ হয়ে আসছে। এবং ঘনিয়ে আসছে গানটির সব থেকে ঘাতক লাইনটিও, ‘তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে-’। এই জায়গাটিতে এসে উপনিষদের সেই মহাশ্লোকটিও মনে পড়তে বাধ্য,
‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’
(… সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন)
শুধু তাই নয়, এই লাইনটির দিকে তাকালে এক ব্যাকওয়ার্ড টাইম-ট্রাভেল ঘটে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে বিগ-ব্যাং ঘটে যাওয়া মুহূর্তটিকে। যেন মহাকাল আর মহাকালী দু’জন দুজনের দিকে চেয়ে বসে রয়েছেন, চোখের পলক ফেলছেন না কেউ। এক পূর্ণ, এক অশেষ তার পূর্ণত্ব ও অসীমের অহংকারেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। কারণ তার কাছে পূর্ণ ও শূন্য বলে পৃথক কোনও অবস্থা নেই। সে নিজে পূর্ণের ভিতর অনন্ত শূন্য ও অনন্ত শূন্যের ভিতর মহা-পূর্ণ।
‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বইটিতে শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন, ‘সর্বত্রগামী এক প্রেমের বাঁধনে বাঁধা না পড়লে কি এ সবের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ দেখা দিত? একই প্রেমের আন্তরিক প্রকাশ নানাভাবে আমরা দেখি, তাঁর পূজা প্রেম প্রকৃতি সব পর্যায়ের গানে।’
শান্তিদেব ঘোষ আরও বলছেন, ‘সেইরূপ গুরুদেবের পূজা পর্যায়ের গানেও তিনি যাকে উদ্দেশ করে প্রেম নিবেদন করে গেছেন, তার সঙ্গে মানবিক অর্থাৎ লৌকিক প্রেমের আবেগের রূপ ও রস যদি এক হয়, তবে তাতে বিরোধ কোথায়? গুরুদেবের পূজা পর্যায়ের গানের মধ্যে এমন সব প্রেমের কথা আছে, যাকে মানবিক প্রেমের গান হিসাবে ব্যবহার করতে কোনও বাধা দেখা দেয় না।’
যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের পর্যায়গুলিকে অটল অনড় চিনের প্রাচীর মনে করেন তাঁদের উচিত শান্তিদেব ঘোষের আত্মাকে রবীন্দ্রবিরোধী বলে দেগে দেওয়া।
সে রাত্রিতে পুরুলিয়া শহরের একটি নির্জন ছাদে বসে মনে হচ্ছিল এই গানটিতে ‘ও মোর ভালোবাসার ধন’ লাইনটি চারবার ফিরে ফিরে এসেছে।
একজন্মে ঠিক কতবার কত হাজার লক্ষ বার আমাদের এই কথাটি বলতে বলতে ধুলোয় মিশে যাবার তীব্র ইচ্ছা বুকের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে!
উত্তর জানেন একমাত্র তিনি, একমাত্র রবীন্দ্রনাথ…