Hello Testing

3rd Year | 10th Issue

৩০শে ফাল্গুন, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ | 15th March, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ছো ট  গ ল্প  ২

প্র ত্যূ ষা   স র কা র

নীল ওড়না

 “আচ্ছা তুমি খুব সুন্দরী ছিলে তাই না?”

 “ধ্যাৎ, কী যে বলিস! সর তো…”

 “লজ্জা পাচ্ছো?”

 “তোর মতো ন্যাকা ষষ্ঠী নাকি যে লজ্জা পাবো! কবে থেকে বলছি একটা জামাই আন… আমার কথা শুনলে তো!”

সোহিনী চুপ হয়ে গেলো হঠাৎ। স্টেথিস্কোপটা ডান হাত দিয়ে ডলতে ডলতে দেয়ালের দিকে তাকালো। 

 “ম্যাডাম, ব্যাগটা গাড়িতে রেখে দিয়ে আসবো?”

রাজুর কথা কানেই আসেনি তখন। সোহিনীর ঠিক সামনেই রূপা বসে উল বুনছিলো। এক ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলো,

 “ওই যে রাজু কী বলছে দেখ…”

 “ও ও, খেয়াল করিনি, বল।”

 “ব্যাগটা…”

 “না থাক, আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুই শোন, পিসিকে এই ওষুধটা আজ রাত থেকে চালু করে দে।”

রাজু ওষুধটা হাতে নিয়ে ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে, “ওষুধ?”

 “হ্যাঁ, ওষুধ…”

 “না মানে, আপনি দিয়ে গেলেন… ওঁর ভাইপো তো টাকা পাঠায়!”

 “উফ ছাড় তো! কাউকে বলতে হবে না কিছু। ও আমার পিসি। বুঝলি?”

রূপার চোখে জল চিকচিক করছে তখন। মাথায় হাত বুলিয়ে গালটা টিপে দেয় সোহিনী। তারপর হাসি মুখে গাড়িতে উঠে চেম্বারের দিকে রওনা দিলো। রূপা জানলা দিয়ে হাত দেখাতে ভোলেনি আজও। সোহিনী চলে যাওয়ার পর এভাবেই সারাটা দিন জানলার বাইরে চোখ রাখে রূপা। চোখে আজকাল ভালো দেখতেও পায় না। তাছাড়া এই একা থাকার অভ্যেসটা রূপার বহুদিনের। এখানে বন্ধু বলতেও কেউ নেই ওঁর। গত বছর পুজোর আগে ওঁর একমাত্র ভাইপো এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ভাইপোর ছেলেটা খুব ছোটো, বছর পাঁচেক বয়স। পিসিঠাম্মিকে দেখতে প্রতি মাসে একবার বাবার সঙ্গে আসে। আসলে ওর মা-বাবা মোটেই পছন্দ করে না ওর পিসিঠাম্মিকে। কেই বা চায় সংসারে একটা অকর্মণ্য বুড়ি রেখে উটকো ঝামেলা পুষতে! তাছাড়া রূপার দাদা-বৌদি, দুজনেই বহুদিন আগে মারা গেছেন, দীপু তখন খুব ছোটো। রূপা একা হাতে ভাইপো দীপুকে মানুষ করেছে। সারা জীবন বাড়ি বাড়ি গানের টিউশন করে ওকে পড়িয়েছে। নিজে আধপেটা খেয়ে ভাইপোকে দু’বেলা মাছ ভাত খাইয়েছে। বিয়েটাও দিয়েছে রূপা নিজে হাতে… টিনটিন হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই দুটো পা একেবারে অকর্মণ্য হয়ে যায়। শিরদাঁড়াটা সোজা পর্যন্ত হয় না। এই বৃদ্ধাশ্রমে একমাত্র সোহিনী, যাকে ও ভীষণ ভালোবাসে। আটষট্টি বছরের এই ভদ্রমহিলার কাছে সোহিনী একটা বাচ্চা মেয়ে যেন। 

রাতে চেম্বার সেরে বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে সোহিনী প্রতিদিন একবার করে ফোন করে রূপাকে। সে খেলো কী না, শুলো কী না, সব চিন্তা যেন ওর একার। ভীষণ স্ট্রিক্ট একজন ডাক্তার হয়েও রূপার প্রতি একটা আলাদা ইমোশন। সোহিনীর বাড়ি দমদমে, ছোটোবেলা থেকে এখানেই থাকে। মাঝখানে মাত্র ক’টা দিন শ্বশুর বাড়িতে থাকতে পেরেছে। তারপর নিজেই বেরিয়ে এসেছে সব কিছু ছেড়ে। ক্লাস ওয়ানে পড়তে পড়তেই মা মারা যায়। বাবার একমাত্র সম্বল সোহিনী। এনআরএসে পড়াকালীন অভিষেকের সঙ্গে পরিচয়। তারপর এমবিবিএস কমপ্লিট করার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে। অভিষেক রানা তখন এনআরএস-এর প্রফেসর। নিপাট ভদ্রলোক। পশ্চিম মেদিনীপুরে তার পরিবার, চল্লিশ জন সদস্য। ছোটোখাটো জমিজমা, মাঠঘাট, খালবিল ছাড়াও আছে পূর্বপুরুষের মাছের ব্যবসা। বিয়ের আগে যদিও সবটা স্বাভাবিক ছিলো। বিয়ের পর সোহিনীকে নিয়ে গিয়ে মেদিনীপুর রেখে অভিষেক লণ্ডনে পাড়ি দেয়। অভিষেকের মা কিছুতেই সোহিনীকে কলকাতায় ফিরতে দেননি। বিয়ের পর এক বছর নাকি শ্বশুরবাড়িতেই থাকতে হয়, তাঁদের নিয়ম। এভাবেই প্রত্যেকটা নিয়ম মানতে মানতে ডঃ সোহিনী হালদার নিজেকেই চিনতে পারছিলো না তখন। এক মাথা সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা হয়তো অভিষেকের কথা মনে করাতো, কিন্তু সেখানে পুরোনো সোহিনী ছিলো না কোথাও। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ওর বাবা গিয়ে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। দু’বছর পর অভিষেক যখন ফিরে আসে তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে আসলে। রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনেছে অভিষেক। একজন বিদেশী ভদ্রমহিলাও থাকা শুরু করেছে ওর সঙ্গে। সবটা জানার পর সোহিনী ডিভোর্স ফাইল করে। অভিষেক যেন খুশি হয়েই পেপারে সাইন করে দেয়। দমদমে এই বাড়িতেই বাবার সঙ্গে আবার একভাবে থেকে যাওয়া তারপর। সোহিনীর বাবা ইন্দ্রজিৎ হালদার একটা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। সোমার সঙ্গে বিয়ের একবছর পর সোহিনী হয়। সবটা ওপর ওপর ঠিকঠাক চলছিলো।

সেদিন সকাল থেকেই ভীষণ দুর্যোগ। সোহিনী ক্লাস ওয়ান তখন। ঝড় বৃষ্টিতে কিছুতেই স্কুল যাবে না। রোজ বাবার সঙ্গে সাইকেলে করে স্কুল যেতো আর ফেরার সময় সোমা নিয়ে আসতো। প্রায় অনেকক্ষণ বায়না করার পরেও সোমা জোর করে ওকে স্কুলে পাঠায়। ইন্দ্রজিতের কোনও কথা বলার জো থাকতো না বাড়ির সোমার ওপর। তাই সারাক্ষণ স্কুল আর স্কুলের পর থিয়েটারের দল। এভাবেই চলছিলো বেশ। সোমা সারাক্ষণ বিরক্ত থাকতো। খিটখিট করতো। যখন তখন সোহিনীর গায় হাতও তুলতো। ইন্দ্রজিৎ কিছু বলতে গেলেই চূড়ান্ত গালিগালাজ শুরু হতো বাচ্চা মেয়েটার সামনে। পরিবেশ সুস্থ রাখতেই চুপ করে থাকতো ইন্দ্রজিৎ। সেদিন চারটে বেজে কুড়ি হয়ে গেছে, সোমা আনতে যায়নি সোহিনীকে। স্কুল থেকে ইন্দ্রজিতের কাছে ফোন যায়। তারপর বাবার সঙ্গে ফেরে সোহিনী। হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে বাড়ির দরজায় আওয়াজ করে। 

 “বাবা, মা দরজা খুলছে না তো।”

  “খুলবে খুলবে। শিওর ঘুমাচ্ছে। দাঁড়া দেখছি।”

  “আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারচ্ছি না। গলে যাচ্ছে আইসক্রিম।”

  “আচ্ছা তুই তোরটা খা। আমি দেখছি পেছনে গিয়ে।”

বাড়ির পেছনে গেলে বেডরুমের জানলাটা পাওয়া যায়। ইন্দ্রজিৎ যাওয়ার আগেই সোহিনী দৌড়ে পেছনে গেলো… জানালাটা হালকা ভেজানো। 

 “ও বাবা, হাত পাচ্ছি না তো…”

ইন্দ্রজিৎ এসে জানলাটা খুলে দেয়। চমকে যায়। কয়েক মুহূর্ত একদম চুপ।

 “ও মা আইসক্রিম এনেছি, ঘুম থেকে ওঠো। বাবা, মা কোথায়? আমি দেখবো।” 

ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে সামনে গিয়ে তালাটা ভাঙার চেষ্টা করছে তখন। এদিকে সোহিনী ইটের ঢিবির ওপর উঠে ঘরের দিকে তাকালো। মায়ের জন্যে রাখা আইসক্রিমটা দুম করে হাত থেকে পড়ে গেলো। ঢিবি থেকে নামতে গিয়ে নরম হাঁটু দুটো ভালো মতো ছড়েওছিলো সোহিনীর। একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি মুখে। ব্যথা চেপে রেখে মায়ের কাছে ছুটলো। দরজা ভেঙে ইন্দ্রজিৎ সবে তখন ঘরে ঢুকেছে।

 “ও মা নিচে এসো। ফ্যানে কেন তুমি! শাড়ি পরোনি কেন? ইস! লজ্জা!”

 বলে বাবার পেছনে লুকিয়ে পড়লো সোহিনী। ইন্দ্রজিৎ ফ্যান থেকে ওড়নার প্যাঁচটা খুলে লাশটা নামিয়ে নিচে শোয়ালো। ডাক্তার এলো, পুলিশ এলো… চারিদিক নিস্তব্ধ! শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছিলো ইন্দ্রজিতের। সোহিনী ওর দিদার কাছে ছিলো। দিদা এভাবেই সোহিনীকে সারা জীবন নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। শ্যামনগরে নিয়ে গিয়ে নতুন স্কুলে অ্যাডমিশন করিয়ে দিতে বলেছিলেন ইন্দ্রজিৎকে। কিন্তু সোহিনী এখান থেকে যেতে নারাজ। ওকে শেষ পর্যন্ত ছুঁতে দেওয়া হয়নি মা’কে। ফাঁস লাগা নীল ওড়নাটাও পুলিশ নিয়ে গেছে। এখন নিজের বলতে মায়ের পুরোনো জিনিসপত্র। আলমারির জামাকাপড়ে মায়ের গায়ের গন্ধ। ইন্দ্রজিৎ থিয়েটার ছেড়ে দেয়। স্কুল থেকে ফিরে রান্নাবান্না করে মেয়েকে নিয়েই কেটে যায় দিন। আর রাতেরবেলা সিগারেট ধরিয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়ের পাশে। সোহিনী এখন আর বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো অভিষেককে। লজ্জায় ঘেন্নায় সমস্ত শরীর রি রি করতে থাকে। তবু কোনওদিন এ বিষয়ে কোনও কথা শোনায়নি ইন্দ্রজিৎ। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরৎ এনে মেয়েকে এমএস কমপ্লিট করিয়েছে। আর এই সোহিনীই এখন শহরের অন্যতম নাম। সরকারি হসপিটালের একজন নামকরা নিউরোলজিস্টের পাশাপাশি সমাজসেবীও। এ চত্বরের সমস্ত অনাথ আশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রমে বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা ছাড়াও ওর যাবতীয় ইনকামের চল্লিশ শতাংশ এখানেই ডোনেট করে। 

এই পঁয়ত্রিশে পৌঁছে বয়স্ক বাবাকে নিয়ে একা একটা জীবন দৌড়ে চলেছে কলকাতা শহরে। ডিভোর্সের পর প্রায়শই দেখা হয়েছে অভিষেকের সঙ্গে। অভিষেক কথা বলতে এগিয়ে এলেও প্রফেশনাল কথার বাইরে অন্য কোনও কথা শোনার থেকে বিরত থেকেছে সোহিনী। তাই রূপা পিসির কথায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে মাঝেমাঝে। যদিও রূপা সোহিনীর ব্যাপারে কিছুই জানে না। 

 “বাবা, এটা কার ছবি গো?”

 “তরকারি কাটছি, এখন জ্বালাস না সোনা।”

 “বলো না, বলো না, এটা কার ছবি?”

 “উফ! বললাম তো… পরে বলছি। হাত কেটে যাবে। সর সর।”

 “ও বাবা… ড্রয়ারে পেলাম।”

ইন্দ্রজিৎ সবে পেঁয়াজের মধ্যে ছুরিটা বসাতে যাচ্ছিলো। সোহিনীর বায়নায় ঘুরে তাকালো। আঙুলের ওপর ছুরিটা বসিয়ে দিলো তারপর। গলগল করে রক্ত পড়ছে হাত থেকে। সোহিনী চমকে গিয়ে ছবিটা ছুঁড়ে ফেলে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। সোহিনী তখন ক্লাস এইট। খুব একটা ছোটো না। একটু স্থির হয়ে গলা নিচু করে ইন্দ্রজিৎ বললো,

 “ও মা, ভয় পেলি নাকি? কিছু হয়নি রে সোনা। একটু রক্ত বেরিয়েছে।”

সোহিনী যখন রক্ত মুছে ব্যান্ডেড লাগাচ্ছে, ইন্দ্রজিৎ হাঁ করে তাকিয়ে মেয়ের মুখের দিকে। সোমাও তো এভাবেই ওর যত্ন নিতো… রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা সাদা কালো ছবিটা রক্তে ভিজে গেছে ততক্ষণে। 

 “বাবা, ছবিটা ভিজে গেছে…।”

 “আমি সরিয়ে রাখছি, তুই যা।”

 “না, আমি ফেলে দিচ্ছি।”

 “ফেলে দিবি?” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্দ্রজিৎ।

সোহিনী আবার প্রশ্ন করে, “ছবিটা কার বললে না তো?”

 “তোর মা… মায়ের বান্ধবী।”

সেদিন যে মুখটা দেখেছিলো ছবিতে, অস্পষ্টের মতো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সোহিনীর চারপাশে। আর ওই নীল ওড়নাটা স্বপ্নের মধ্যে এখনও তেড়েফুঁড়ে ওর দিকে এগিয়ে আসে। খুব কষ্টের সময়গুলো সোহিনী মায়ের সঙ্গে কথা বলে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। কী জন্যে ওর মা উলঙ্গ হয়ে শুধুমাত্র একটা ওড়না গলায় দিয়ে সব্বাইকে ছেড়ে চলে গেলো আজও জানতে পারেনি ও। আর বাবার চুপ করে থাকাটা আরও কৌতূহলী করে তোলে সোহিনীকে। আজকাল তো রাতে ঘুমও আসে না ওষুধ ছাড়া। মাঝেমধ্যে দরজা বন্ধ করে ড্রিংক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তীব্র ঘুমে কিচ্ছু মনে পড়ে না, ঘুম হালকা হতেই ওড়নাটা এসে ওর গলা আটকে ধরে। ঘামতে থাকে সোহিনী। প্রচণ্ড অস্থিরতায় হাত পা ছুঁড়তে থাকে। বোবার মতো আওয়াজ করে মুখে। আবার কখনও সখনও ‘অভি অভি’ বলতে বলতে কোলবালিশটা জাপটে ধরে। হঠাৎ হঠাৎ সেই হাসিমুখও আসে, সাদাকালো ছবি থেকে আস্তে আস্তে রঙিন হয়। এখন এক মাথা পাকা চুল। নাকের পাশে ছোট্টো তিল। ইদানিং স্বপ্নটা বারবার বিরক্ত করছে সোহিনীকে। ইন্দ্রজিতের পুরোনো অ্যালবামের এই মুখটা আগেও উঠে এসেছে অনেকবার।

আজ হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে রূপা পিসির কাছে গেছে সোহিনী। মাথার যন্ত্রণাটা বেড়েছে, একদম অথর্ব হয়ে যাচ্ছে দিন দিন মানুষটা। সোহিনীর ওষুধে শরীর রেসপন্স করছে ঠিকই তবে মনটা তো আর সোহিনীর হাতে নেই। প্রায় দু’মাস হল বাড়ি থেকে কেউ একবারের জন্যেও আসেনি রূপাকে দেখতে। এমনকি খবর পর্যন্ত নেয়নি। রোজ একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে ফোন এলো কিনা। সবাই চুপ করে যায়, কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। ক্রমশ চোখ দুটো স্থির হয়ে আসছে রূপার। টপটপ করে জল পড়ছে। সোহিনী এসে মাথার কাছে বসে, চোখ মুছিয়ে দেয়। ডান হাতের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে পিসি?”

রূপার মুখে কোনও কথা নেই। রাজুও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে। আস্তে আস্তে সোহিনীর কানে কানে বলে, “বুড়ির ভাইপোর বউটা এসছিলো সকালে। এক ট্রাঙ্ক মালপত্র দিয়ে গেছে। বলেছে আর না জ্বালাতে। ম্যাডামের ঘরে ঢুকেছিলো, টাকা পয়সাও দিয়েছে শুনলাম।”

রূপা হুট করে শক্ত করে চেপে ধরে সোহিনীর হাত। সোহিনীর সারাটা শরীর শিউরে ওঠে। রাজু দৌড়ে গিয়ে ভারি ট্রাঙ্কটা টানতে টানতে নিয়ে এসে খাটের কাছে রাখে। রূপা ছটফট করতে থাকে। ট্রাঙ্কটা খোলা মাত্র ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সোহিনীর চোখে জল। ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রূপা কাঁপা গলায় বলে, “আমাকে দেখতে দারুণ ছিলো, জানিস?”

সোহিনী চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বিয়ে করোনি?”

 “বিয়ে! ধুর… ভেবেছিলাম তুই বিয়ে করলে জামাইকে বলবো আমার জন্যে একটা পাত্র দেখতে।”

  “আমি? আমি তো…”

বলে থেমে যায় সোহিনী। রাজু বসে বসে ট্রাঙ্কের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে তখন। পুরোনো বই, জামাকাপড় আর সাজগোজের প্রচুর জিনিসে একেবারে ঠাসা। হাসতে হাসতে সাজের জিনিসগুলো হাতে নিয়ে রাজু জিজ্ঞেস করে, “ও ঠাম্মা, এগুলো সব তোমার?”

সোহিনী ঘাড় ঘুরিয়ে ট্রাঙ্কের দিকে তাকায়।

 “হ্যাঁ রে, আমি তো থিয়েটারে গান করতাম। নানা দলে কাজ করেছি। আজ এই দল তো কাল ওই দল। আমাকে নিয়ে কত ঝগড়া হয়েছে মালিকদের মধ্যে। সুন্দরী ছিলাম তো।”

  “তুমি অ্যাকটিং করতে পিসি?”

সোহিনীর কথায় রূপা হেসে ফেলে। 

  “ওরে না না, গান করতাম শুধু… ওসব অভিনয়ের দিকে কোনও দিনই ঝোঁক ছিলো না।”

  “কখনও ইচ্ছে করেনি তোমার?”

  “জানিস, আমার এখনও কী মনে হয়?”

  “কী?”

  “যারা অভিনয় করে, তারা বাস্তবেও সত্যিকারের অভিনেতা। মিথ্যেরকম ভালোবাসতেও পারে তারা…”

সোহিনী লক্ষ্য করে, রূপার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনায়াসে। এদিকে মুখে একটা ম্লান হাসি। এই হাসিটা রূপার চেনা। কোথায় যেন দেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না। এদিকে রাজু তো গল্প গিলছে আর ট্রাঙ্ক অগোছালো করছে। হঠাৎ মেঝে থেকে উঠে পড়ে। ভীষণ উৎসাহী হয়ে একটা চুড়িদার এনে রূপার হাতের কাছে রাখে। রূপা জাপটে ধরে চুড়িদারটা। রাজু জিজ্ঞেস করে, “এই চুড়িদারটা তোমার? তুমি এসবও পরতে?”

রূপার চোখেমুখে একটা লাজুক হাসি। সোহিনী হুট করে রূপার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় চুড়িদারটা। চোখের সামনে এনে ভালো করে দেখতে থাকে। তারপর গন্ধ শোঁকে। অস্থির হয়ে ওঠে।

 “পিসি, এটা কার চুড়িদার?”

 “উফ! এতো অস্থির হোস না বাপু… আমার। আমার নীল রং খুব পছন্দ জানিস!”

 “কে দিয়েছিলো গো? এখানে তো অন্য গন্ধ পাচ্ছি।” বলতে বলতে হেসে ফেলে রাজু।

 “খুব পেকেছিস বলে রাখলাম। এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়। ধ্যাৎ! তোদেরই শুধু প্রেম হয় বল?”

রূপার চোখ চকচক করে ওঠে। খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে, যেন প্রথম প্রেমে পড়ছে বাচ্চা মেয়ে। সোহিনীর সারা শরীর তখন কাঁপছে, “এটার ওড়না নেই?”

রূপা সোহিনীর হাত থেকে চুড়িদারটা নিয়ে মুখ নিচু করে বলে, “ওড়নাটা হারিয়ে গেছে…”

 

আরও পড়ুন...