পা ঠ প্র তি ক্রি য়া ১
একটা লেখার প্রথম বাক্য আসলে একটা আস্ত গবেষণাগার। একশ’ বছরের নিঃসঙ্গতার কথক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একথা বলেছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সাংবাদিক বন্ধু প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দাসাকে। বহু আগে পড়া একটা কবিতার বই, যার বেশ কয়েকটা কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় পড়ে চমকে উঠেছিলাম বহুবছর আগে। কিন্তু কবির নাম নয়, কবিকে চেনার ইচ্ছে নয়, শুধু মাথার মধ্যে ঘুরত কয়েকটা লাইন-
‘ভিড়ের মধ্যে কে আমাকে বলল- ‘তোর পারগেশন নেই, তুই বাঁচবি না,’ আর আমি ডেরায় ফিরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম অভিধানের ওপর যেখানে অক্ষরবৃন্ত থেকে গড়াতে গড়াতে নামছে অর্থ- যেভাবে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নামে বরাদ্দ।’
আজ সেই কবিতার বইটা হয়ত দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার অথবা চতুর্থবার অথবা তারও বেশিবার পড়তে গিয়ে, পড়ার পরে সেই অক্ষরগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই কথাটাই মাথায় এল। কীভাবে পেলেন কবি এই কবিতার প্রথম লাইন? কীভাবে পেলেন এই ভাষ্য আর গান যা এক অজানা অচেনা পাঠকের চৈতন্যের স্পন্দন আর নৈঃস্পন্দ্যকে মিলিয়ে দেয়? অক্ষরের প্রশাসনে কীভাবে আঁকলেন তিনি এই সময়ের সম্পাদ্য?
‘সময়ের সম্পাদ্য’ না বলে সময়কে একটা ব্যবধানহীন গ্রামে তাঁর অক্ষরে তুলে ধরলেন এও বলা যায়। কবি রচিত প্রতিটা চিত্রকল্প যেন আমাদের ইতিহাস, বেদনা, যন্ত্রণা ও হারাতে হারাতে মানুষের লাশ বয়ে আনা আস্ত একটা ট্রেন। যে ট্রেনের শাদা পোশাক পরা গার্ড তার স্থির দৃষ্টিতে দেখে ফেলছে সমস্ত ‘সময়-অসময়’-
‘দেখছি, সবজি খেতের পাশে টলটলে মুক্তাবৎ পুকুর
শুনছি, ভারী গলার আওয়াজ, ‘না, ওদিকে যায় না খুকু’
খুকুর মধ্যে দেখছি খুকুর অকালমৃতা পিসির চিহ্ন
একান্নবর্তিকায় জ্বলছি; মরে গিয়েও কেউ না ভিন্ন।
গল্পদাদুর আসর থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে এসে
খুঁজছি, তিনটে কুলি কখন রওনা দিল নিরুদ্দেশে।’ …
এ যেন পঙক্তি থেকে উঠে এল কান্না। যে কান্না নিজেই গিলে নিয়েছে কবিতা, রাজনীতি, সেকুলার, সিউডো সেকুলার আর সেই চিরপরিচিত সেলুলয়েডের টানটান উত্তেজনায় দেখা একটা শুয়ে পড়ার গল্প। যার সিংহভাগই সত্য নয় ভেবে আশ্বস্ত হওয়া। পুরোন সব স্লোগান, মন্ত্র তন্ত্র সব গিয়ে মিশেছে সেই এক ধ্বনিতে। যার সুর থেকে ভেসে আসে এক একটা ঘরের শব্দ। সেই শব্দে মিশে আছে কত মা-বোন, কাকা-জ্যাঠাদের লাশ ঘিরে অজস্র চিৎকার! পদ্মা মেঘনার জলে সেই কবেকার চিতাভস্ম থেকে লেখা হবে নতুন ইতিহাস?
কে লিখবে এই আত্মঘাতী ইতিহাস? কোন কলম? যা কিনা পিতার মতো, গুরুর মতো সমস্ত নিয়ম অনিয়মের ব্যবধানে এক নির্মম অথচ নির্ভেজাল সত্যের সামনে এনে দাঁড় করাবে। কিন্তু কবি কি তাই করলেন? তিনি লিখলেন,
‘জ্বলন্ত প্রজাপতির ডানায় লিখলাম, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’
নীচে সমুদ্র, ওপরে পাহাড়; না, আমি এখনও আদেশ পাইনি।’
‘মাটির মালসায়’ সমস্ত শহীদের রক্ত আর নিজের দীর্ঘশ্বাসকে ভরে রেখেও কবি বিশ্বাস হারাননি। কারণ,
‘মানচিত্রে মাথাই উধাও তবুও টিকি বাঁধা
গ্রাম- রাজাপুর, বাখরগঞ্জ থানা
ঘর বেঁধে দিই লক্ষ লোকের, না বাঁধি না ছাঁদা
বংশ পরম্পরায় ওইটে মানা
সাতমন তেল পুড়িয়ে যদি না-ই নাচলেন রাধা
বাজাই অশ্রু-সম্বরণের সানাই
দেয়াল ভাঙছে ‘ছত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ’ ধাঁধার
আমার কাজ তো ইট কুড়িয়ে আনা।’
ক্ষতর মধ্যেও জেগে আছে এক অনন্ত আশ্রয়। যে আশ্রয় কখনও ‘জীবনধারা’। আর এই ধারার সমস্ত জল বয়ে যায় ‘চণ্ডালের মেয়ের ঘটি থেকে সন্ন্যাসীর হাত অবধি’। আর কোনও এক অনামা অপরিচিত আলিম্মানের বুকে জেগে থাকে সেই স্বপ্নদৃশ্য। যেখানে এক যুবক পুত্রের বুকে তার বাবা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এত ক্ষত কেন? এত কষ্ট কেন?’ আর কবির সেই অমোঘ পঙক্তি উত্তর হয়ে সবহারাদের কন্ঠনালিতে মিশে যায়-
‘পথে যদি বিপদ বড় বাবা আমার হাতটা ধরো
নচিকেতার হাত ধরবেন মৈত্র মহাশয়।’
সময়ের সম্পাদ্য আঁকতে আঁকতে কবি যেন কখন নিজেই ক্যালেণ্ডার হয়ে গেছেন। সাল তারিখের মতো সেখানে ‘নবান্নের স্বাদ’, ‘গোধুলির হারিয়ে যাওয়া সাইকেল’, পুকুরে ফলিডল দিয়ে মেরে ফেলা মাছের লাশ, বিশ্বায়নের সুখ, দখল আর পুনর্দখলের আখ্যান। প্রতিটা প্রহরের নগ্নতা আর অস্বস্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে কবি লেখেন,
‘অন্যের অস্বস্তিকে মাথায় ধারণ করে
অন্যের যন্ত্রণায় মিশে কদম কদম বাড়াতে বাড়াতে
নিজেকে ভালবেসে মারা গিয়ে অন্যের ভালবাসায় জন্মাতে জন্মাতে
ঘাসে লেগে থাকা অন্যের রক্তকে
নিজের বলে ভাবার মধ্যে
পাপ নেই, কোনও পাপ নেই।’
এই যে অখণ্ড একটা বোধ। যা কেবলমাত্র কবিকেই মানায়। তাই কোনও এক আদিকবির শ্লোকই হয়ে ওঠে কবিতা- ‘অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরচরম’।
কবিমাত্রেই এই অখণ্ডতার প্রতীক। যাঁর ব্যপ্তি সমস্ত চরাচর জুড়ে। একাল থেকে সেকাল, আদি থেকে অনন্ত এক সীমাহীন শেষহীন যাত্রা নিজের মধ্যে একমাত্র কবিই অনুভব করতে পারেন। কোলরিজ তাই বলেছেন,
‘The Primary Imagination I hold to be the living power and prime agent of all human perception and as a repetition in the finite mind of the eternal act of creation in the infinite I am.’ (Coleridge, Biographia Literaria. Ed. Shawcross, Oxford, vol.I, p. 202)
বিনায়কের কবিতায় এই অখণ্ডতাকে বুঝতে হলে তাঁর ‘ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা’ কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তির কাছে ফিরে যেতে হবে-
‘পাথর মেলে ধরুক বিষদাঁত
তুলুক ফণা নিথর কালো জলও
বর্তমান তবু ঘটমান
আমাকে প্রভু শিকাগো যেতে বলো…’
অথবা,
‘মাটির নীচে প্রাচীন কোনও খনি
আকাশে লাঠি ঠকঠকায় শনি
ইতিহাসের দু’পায়ে অভিশাপ
কপালে তবু নাচতে থাকে মণি
সীমা থেকে সীমাহীন এই যাত্রা বুঝতে গেলে ভরসা তাঁর এই পঙক্তিগুলো-
‘ঘুমের কাছে চলে না অভিনয়
তাই তো জল মিশিয়ে খেতে হয়
লুপ্ত, অবলুপ্ত হতে হতে
জানাতে হয় নিজের পরিচয়
যখন নীচে পুড়তে থাকে স্টোভ
একলা কথা ছুঁড়তে থাকে ক্ষোভ
দ্রাঘিমা আর অক্ষরেখা নিয়ে
অন্ধকারে ঘুরতে থাকে গ্লোব।’
‘ঘটমান-বর্তমান’ যেভাবে তাঁর কবি মনে ব্যবচ্ছেদ হয়ে চলেছে ক্রমশ সেই বীক্ষণ ও ব্যবচ্ছেদের ভাষা তাঁর দীর্ঘকবিতায় কখনও ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ কখনও ‘পৃথিবীর পথে’ ঘুরে ঘুরে পাঠককেও পরিক্রমণ করায় আর মনে করিয়ে দেয় অতীত আসলে বর্তমানের এক পণ্যমাত্র নয়। সে আসলে শুধু স্মৃতিও নয়। কবির উচ্চারণে,
‘জড়ভরত করল বিধি
দোষ ধোরো না গুণনিধি
নিজের পথে পথে বিছোই নিজের মৃত্যুফাঁদ
আশমানে ওই যায় দেখা যায়- ঘর-সোহাগি চাঁদ।’
ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা | আনন্দ | প্রথম সংস্করণ ২০০৯