বি শে ষ র চ না
প্রতি রোববার সকালে আমি গড়িয়াহাট বাজারে যাই হাতে দুটো থলে নিয়ে। এবং জানি বাজারের দু’পাশে কয়েকটি বহুতল আবাসনে পঞ্চাশের দশকের অন্তত চার-পাঁচ জন কবি থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতেই আমাকে যেতে হত বিভিন্ন প্রয়োজনে। এমনকি রোববারের মাছের বাজারেও তাঁদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যেত কখনো-সখনো।
একদিন ব্যতিক্রমী ঘরোয়া পোশাক পরা পঞ্চাশের দশকের এক কবি, ওই মাছের বাজারে আমাকে দেখতে পেলেন। দেখে, দূর থেকেই উচ্চকন্ঠে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। মাছ বাজারের ওই বিচিত্র হল্লার ফাঁকে যতটুকু শুনতে পেলাম, তাতে মনে হল তিনি কয়েক বছর আগে রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়া কোনো এক কবি সম্পর্কে তাঁর আপত্তির কথা জানাবার চেষ্টা করছেন, সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্যগুলিও সাজিয়ে দিচ্ছেন। তাও সেটা মাছের বাজারের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এবং মানুষের ধাক্কা সামলিয়েও। আমি সন্তর্পণে তাঁর হাত ধরে টেনে এনে ভিড় থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেদিন তিনি অনেক কথাই বলছিলেন প্রসঙ্গ পাল্টে পাল্টে। তাঁর পুরোনো অভিজ্ঞতার কথা। পরে কথা বলতে বলতে তাঁর আবাসনের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। এবং তাঁর বাড়ি গিয়ে বাকিটুকু শুনে আসার জন্য কথা দিতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এরপরেও তাঁর বাড়ি যেতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। বলতে দ্বিধা নেই, প্রায় প্রতিবারই দু’একটি কাজের কথার শেষে তিনি চলে যেতেন তাঁর নিজস্ব ভালো লাগার প্রসঙ্গে। তিনি কীভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, বা তাঁর সমসাময়িক কোন কোন কবি কীভাবেই বা প্রভাব বিস্তার করতেন সাহিত্যজগতে ইত্যাদি। যাঁদের সঙ্গে আমার ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল বা যাঁদের সান্নিধ্য তেমনভাবে পাইনি কখনো- তাঁদের প্রসঙ্গ উঠলে আমি প্রত্যুত্তরের তথ্য না পেয়ে চুপচাপ সবটুকু শুনে ফিরে আসতাম। কিন্তু যখনই বাংলা সাহিত্যের দুই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাঁদের স্নেহ ও সান্নিধ্যে অনেকেই ধন্য হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলতে শুরু করলেই আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বিদায় নিতাম। মুচকি হেসে তিনি বলতেন, ‘শুনতে ভালো লাগছে না, না?’
আসলে ১৯৯৮ সালে শিলং-এর দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষ করে যখন বরাবরের জন্য কলকাতায় ফিরে আসি, আমার ভালোলাগা সমসাময়িক ও অনুজ কবিদের সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে- পরস্পরের প্রতি এক ধরণের গোপন ঈর্ষা ও দ্বেষের আবহ টের পাওয়ামাত্রই, অচিরেই একটা দূরত্ব তৈরি হতে থাকে কারো কারো সঙ্গে। ব্যাপারটা এতটাই সূক্ষ্ম যে স্বাভাবিক ব্যবহারে তার কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়ে না। অগোচরে স্থায়ী ব্যথা রেখে যায় অন্দরে। এ সব কিছুই অমরত্বের অলীক বাসনায় ওই চিরকালীন ভার্চুয়াল সিংহাসনটি অন্ধকারে খুঁজে না পাবার ভয়ে। তাঁদেরই মধ্যে কারো কারো অসাধারণ কবিতাগুলি পড়ার পর, বলাবাহুল্য ওই মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই তাঁদের কবিতার বাইরের মুখ ভিতরে ঢুকে তোলপাড় করে মনখারাপের রেশ রেখে যায়। মন থেকে কিছুতেই আলাদা করতে পারি না। এ বড়ো অসহায় অবস্থা, কষ্টেরও।