পা ঠ প্র তি ক্রি য়া ২
“আমি হলাম ককটেল ক্যাবিনেটের নীচে একটা ছোট্ট টিকটিকি, সভ্যতার সমকক্ষ।” হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, সারা পৃথিবীতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ একদিন রাষ্ট্র জানাল, আপনাদের বন্দি হয়ে যেতে হবে ঘরে। বাইরে নাকি মৃত্যুমিছিল শুরু হয়ে গেছে। কাকদ্বীপ থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সবাই আজ সন্ত্রস্ত, ভীত। প্রাত্যহিক জীবনে ঢুকে পড়ছে সংক্রমণ ও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। একে অপরের থেকে সর্বদা দূরে থাকুন কারণ মানুষ এখন এমন এক বাহক, যে অপরকে সংক্রমিত করে দেবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নয়, চিত্র এক, অনৈক্য বিরাট। আমরা জানতেও পারছি না কিছু- শুধু মৃত্যুর সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। শেষের দিনটা আমি কী শুধু একটা পরিসংখ্যান হয়ে বেঁচে থাকব মানুষের মনে! মাথার মধ্যে দুটো লাইন এসে গেল—
“আমেরিকা, মহাচীন এগিয়ে আসছে- গরীবের কী হবে?
আমরা ডাক্তার নই, আমরা মানুষ- ইতি একজন ফুচকাওলা।”
সুবোধ সরকার! ২০০৬ সালের একটি কবিতার বই থেকে লাইন ক’টা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বইয়ের নামটা দেখছি- “যা উপনিষদ, তাই কোরান”। বইয়ের তাক থেকে চোদ্দ বছরের পুরনো একটা বন্দুক হাতে নিলাম, যার প্রতিটি পাতায় বুলেট ছাপানো আছে। এই কবিতাগুলোর সংক্রমণ থেকে তাহলে এখনও মুক্ত হতে পারি নি, আজও।
২০১১ সাল, ২১শে ফেব্রুয়ারী। ভাষা দিবসে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে দুপুর ২টোয় কান পাতা দায়- মঞ্চে একজন কবি উঠছেন। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ার, মেয়েদের কলেজে গেছি কবিতা শুনতে। এটাও হয়! সুন্দরীরা একজন কবির জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে- তাঁর কবিতা শুনবে বলে। আমি কালো টি-শার্ট, জিনস, উনি কালো শার্ট, কটন ট্রাউজার্স। কবি বললেন “আমরা কেউ বাংলায় কবিতা পড়তে ভালবাসি না,” কন্ঠে তাঁর ‘মণিপুরের মা’। একজন তরুণ সংক্রমিত হল কবিকে দেখে, নাম সুবোধ সরকার।
আমি ইনফেক্টেড হলাম কবিতা, প্রেম আর সাহসিকতায়। নিঃসঙ্গ সময়ে ঘরে বসে বসে অতীতের ছবিগুলো দেখছি। ছবি একটা সময়। কবির চোখ দিয়ে সময়কে দেখলে তার পরিসর অনেক বিস্তৃত হয়। ঠিক যেভাবে দান্তে হাত ধরেছিলেন ভার্জিলের, আমার হাত ধরে উনি নিয়ে এসেছিলেন ভাষার নগরে, ভাষানাগরিক হওয়ার আইডেন্টিটি কার্ড দিলেন, কানে কানে বলেছিলেন, “বিড়াল সাদা না কালো, কী দরকার, ইঁদুর ধরতে পারে কী?” (সাদা না কালো)
চারপাশটা যখন ক্লান্ত, অসহায়, অনিশ্চিত- তখন কবিতা কী করতে পারে এই সভ্যতার? পারে, অনেককিছু পারে। কবিতায় “সময়টা থাকেই। কারো লেখায় সময়টা একটু বেশি চেনা যায়, আবার কারো কারো কবিতায় এটা লুকিয়ে থাকে। একটু চিনে নিতে হয়।” (সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, সুবোধ সরকার)
এই ইউনিপোলার বিশ্বের টুঁটি টিপে ধরবার প্রতিযোগিতায় চীন একটা মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনই দাবি নিয়ে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম উত্তাল। ইতালি থেকে নিউইয়র্ক- গণকবরে তছনছ সর্বত্র। সারা বিশ্ব একটি দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে, তখন চীন একেবারে নিশ্চুপ। লা রেসফুকোর একটি ‘ম্যাক্সিম’-এর কথায় বলি- “স্বার্থান্বেষীরা সব ভাষায় কথা বলতে পারে, সব ধরণের লোকের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে, এমনকি উদাসীন লোকের ভূমিকায়। এই সময়ে “কী বললেন, বিশ্বায়ন?”—
“আমি আমেরিকায় গিয়ে শুনে এলাম
লোকে ওখানেও বলছে
দিনকাল যা পড়েছে
তুমি তোমার খাবারের কাছে ঠিক সময়ে
পৌঁছতে না পারলে
অন্য কেউ পৌঁছে যাবে।”
লকডাউনের ফলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। অর্থ যার আছে তার থাকে প্রাণের ভয়, খিদের থেকে বড় সংক্রমণ আর কিছু আছে?
“যারা মঞ্চে ওঠেন না তাদের বলি, জল নয়
ওটা মদ
মন্ত্রী
কবি
আমলা
ভাইস- চ্যান্সেলর
সবাই ওই মদ পান করেন।“ (মঞ্চ)
কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন বইটা পড়ব- এই নির্বাচনকে বলে বোধ। অনর্গল টিভিতে আতঙ্কের প্রচার, সন্ধ্যা নামলেই আলো করে কবিদের খামখেয়ালী বিলাপ। কবিতা, গল্প- সৃষ্টির আপন আত্মপ্রচার একটি জাতির অলস কূপমণ্ডুকতার ছবির বাইরে বিরাট আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস, জাতীয়তাবাদী বিষ, উদারভাবনার ঐক্য থেকে সরিয়ে রাখা গণবিচ্ছিন্নতা নিয়ে আমরা কি সামান্য ভাবিত! নির্বোধ আত্মঅহংকার ও স্বল্পবিদ্যার অস্ত্র দিয়েই একটা দেশ কি সুন্দর আমাদের একে অপরের থেকে দুরে সরিয়ে দিল- এই বিষয়ে ভারতীয় কবিরা কতটা সজাগ! এই উত্তর অধরা। সুবোধ সরকারের কবিতা ঠিক এইখানেই বিশ্ববোধের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কবিতা তার সোনার কাঁকন খুলে রেখে – একটি আখ্যানের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে, এক হাতে রাইফেল, আরেক হাতে সংবিধান বই ধরে প্রশ্ন করে—
“কপালে আজ যা থাকে
মুণ্ডু যার উড়তে গেছে
বন্ধ্ ডেকেছে আজকে যার ধড়…
পুলিশ যদি কখনও মারে চড়
কে তাকে ভার দিয়েছে চড় মারার?
(মাফিয়া)
কবির মধ্যে যখন চলতে থাকে “গল্প না থাকলে আমি ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারি না। উড়তে পারি না। বাস্তব আমাকে উড়তে বলে। যেভাবে মাটি থেকে একটা বিমান শুরু করে তার উড়ান। ন্যারেটিভ আমার কাছে একটা রানওয়ে।” তখনই সেই সাহিত্য মানুষের জন্য হয়ে যায়। “সে মানুষ যেরকমই হোক, সাহিত্য শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য। … সাহিত্য তা সে যত কম লোকই পড়ুক বা যত বেশী লোকই পড়ুক, আসলে শেষ পর্যন্ত সেটা মানুষের জন্য। ( “আমি বিশ্বাস করি রাজনীতি থাকুক, পলিটিক্স বন্ধ হোক।” )
“বাঙালী সমাজের এরকম হিপোক্রেসি আছে, যে তারা মুখে খুব সুশীল, বাইরের আচরণে খুবই ভদ্র। কিন্তু ভিতরে তারা একটু অন্যরকম। ভেতরে তাদের মধ্যে ভায়োলেন্স আছে, সেই ভায়োলেন্সটা লুকানোর একটা কায়দা আছে।” (‘কথায় কথায়’) বাঙালির জীবনে এখন সবচেয়ে বড় মারণ ভাইরাসের নাম ফেসবুক। এই বন্দিদশায় শুধু তাদের টয়লেটের আপডেট বাদ দিয়ে সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। একটা দেশের কি বিপুল বৈচিত্র্য ভাবলে গা শিউরে ওঠে। যে মা ‘সন্তান প্রসব করে দু’ঘণ্টা পর হাঁটতে শুরু করে’ – সেই দৃশ্যের পরেই দেখতে পাওয়া যায় বাহারী খাদ্যসামগ্রী। পসরা সাজিয়ে আয়োজন দেখানোর আত্মপ্রচার। এর নামই বোধহয় ‘বিশ্ব’- “মাওবাদীদের সঙ্গে স্নান, আমেরিকায় বিয়ার খান।”
গোটা বিশ্বজুড়ে মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে— তখন কী করে প্রাণের আরামে সেজে নিজেদের এত আত্মপ্রচার করতে পারে মানুষ! সামান্য ক’টা জিনিস গরিবের হাতে তুলে দিয়ে ৭০টা ছবি আপলোড হয়ে যায়- কেন? ফিরে দেখেছে কেউ, ক’জনের পেট আরও আছে খালি? কতজন গলায় দিল দড়ি, রেলে দিল মাথা, হাতে তুলে নিল বিষ- “বসে ভাগচাষি, হাতে ফলিডল / গণতন্ত্র মূষিকের স্বপ্নে পাওয়া ফল।” (সুজলাং সুফলাং একজিটপোল)
“যাও ধর্ম, যাও রাজ, ভণ্ড আর.এস.এস.
দাও পুত্র, ঢালো বিষ, মধুপাত্র শেষ।
যাও ধর্ম, জাতে ওঠো, যাও জল অচল
চন্ডাল লিখুক কাব্য বিন্ধ্য হিমাচল
যাও থুতু, যাও বিষ্ঠা, যাও ক্যাবিনেট
ভুল অর্থনীতি যাও ঋণং দিবেত।” (সুজলাং সুফলাং একজিটপোল)
একটা ভয় আর হতাশা কত মানুষকে পিশাচ করে তুলেছে গোটা দেশ জুড়ে। কিন্তু গোটা দেশ বা বিশ্বের টুকরো টুকরো ছবি দেখতে দেখতে আর নিজের শহরের এক একটি অঞ্চলের ‘মুখোশ’ পরা মানুষগুলোর বাঁচার জন্য উগ্র চেহারা যেভাবে প্রকট করে তুলছে, আর সেই সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র একটি দানবে পরিণত আজ। একটা গেরিলা মন চিৎকার করে—
“রিভলবার যদি কখনও ছোটে
ছুটবে গুলি এ-কান থেকে ও-কান
দুপুরবেলা কলেজ ষ্ট্রীটে আমরা হব দুজনে খান খান।”
(রিভলবার)
ভাইরাস কোনও ধর্ম দেখে না, বিপদের কোনও জাত হয় না। ১৪ বছর আগের একটি বই খুলে বসে আছি। কবিতাগুলোর সামনে বসে ভাবছি- দেশ, বিশ্ব, মানবজাতির আপাত অবস্থা তাহলে একই জায়গায় রয়ে গেল। চেক রিপাবলিকের কম্যুনিস্ট সুন্দরী যেভাবে সব হারিয়েছিল, উহানের গ্রামের মানুষ সংক্রমণের মিথ্যা সন্দেহে একইভাবে দেশছাড়া হয়। শ্রমিক, চাষি, মজুরদের রাজনীতির শিকার বানানো হত, তাদের ঘাম রক্ত দিয়ে লেখা হত সরকারের নাম। না খেতে পেয়ে তখনও মারা যেত, এখনও মারা যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ তো আরও অন্ধকার। আমার সেকেণ্ড সেমেস্টারের ছাত্রী অয়ন্তিকার ঘর ঝড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে গেলে ক্লাবের লোকেরা তাদের পরিবারকে সিঁড়ির নিচে স্থান দেয়, ক্লাবঘরটুকু পর্যন্ত দিতে পারে না- যদি তারা ভাইরাসের বাহক হয়! আমি আসলে সুবোধ সরকারের কবিতা পড়ছিলাম, না আলোচনা করছিলাম জানি না- তবে কবিতাগুলো একটা নতুন রক্তাক্ত জীবন দেখাচ্ছিল বার বার, যে ভণ্ডামি, হিংস্রতা “কত চালাকি ধরা পড়ে না/ যখন পড়ে, বামাল সহ পড়ে/ পড়েই উঠে দাঁড়ায়”।
যা উপনিষদ, তাই কোরান | সুবোধ সরকার | আনন্দ পাবলিশার্স