বি শে ষ র চ না
সমস্যাটা ভবঘুরের মতো প্রান্ত বদল করে শুধু। গত জন্মের এক নিরীহ কচ্ছপের পিঠেও সে সমস্যার দাগ স্পষ্টই থেকে যায়। আমরা কী করি? যারা দু’চার লাইন কবিতা লিখে মনকে স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করি, তারা? অজান্তে নাকি সজ্ঞানে সমসাময়িক প্রকৃত ভালো কবিকে অবজ্ঞা বা অল্পবিস্তর হিংসা করতে শুরু করি। কেন করি? তার কারণ অন্য কিছু নয়, অনেকেই নিজেদের ওপর আর আস্থা টিঁকিয়ে রাখতে পারি না। যেন নিজেরই তৈরি করা এক অলংকৃত ভার্চুয়াল সিংহাসন হারানোর ভয়। আমার এই পঞ্চাশ বছরের নগণ্য কবি-জীবনের অভিজ্ঞতায় যাঁদের সঙ্গ বা সান্নিধ্য পেয়েছি, বিশেষ করে অগ্রজ যাঁরা- তাঁরা প্রত্যেকেই স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তাতে কোনো দ্বিমত নেই। তাঁদের অবাক করা পঙক্তিগুলো আমাকে মানসিকভাবে পূর্ণতার দিকে এগোতে সাহায্য করেছে। অথচ ব্যতিক্রমী দু’তিন জন বাদে তাঁদের অধিকাংশই নিজেরই তৈরি করা সিংহাসনটি হারাবার আশঙ্কায় অন্যের প্রতি অবজ্ঞা কিংবা কখনো সখনো বিষোদগারও করতে দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথও নাকি এমন আক্রমণের আড়ালে নিজেকে রাখতে পারেননি। বারবার আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাতে অবশ্য তাঁর পাঠকের তৈরি সিংহাসনটি বিন্দুমাত্র টলে যায়নি। তবে ব্যতিক্রমী যে ক’জনের সঙ্গ পেয়েছিলাম, তাঁদের কখনোই কারও প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতে শুনিনি। এর বেশি আর কিছু নেই। পুরোটাই জটিল, বাসি মাঞ্জাসুতোর প্যাঁচ।
প্রথম প্রথম অবাক হতাম। রাগ হত খুব। বিশেষ কারোর ওপর রাগ নয়। অথচ প্রত্যেকের ওপরেই। চাকরিসূত্রে প্রায় ত্রিশটা বছর শিলং বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকতে হয়েছিল আমাকে। সত্তরের দশকের গোড়া থেকে। তখন সমসাময়িক কবিরা নতুন আন্দোলনের ঢেউ তুলছে বাংলা কবিতায়। আমি বহুদূর থেকে তার উত্তাপ টের পেতাম। আর চোখ বন্ধ করে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সমস্ত শ্রেণির কাগজেই লেখা পাঠাচ্ছি। অজানা কারণে সেসব ছাপাও হচ্ছে। ভেবেছিলাম বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যটা সত্যিই শোভন-সুন্দর। সত্যিই কি তাই? শিলঙে পঞ্চাশের দশকের এক অবহেলিত, ব্যতিক্রমী শক্তিমান কবির সঙ্গ ছিল যেন আমার পূর্ব নির্ধারিত। তিনি একটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতার কাছেই তাঁর একটা বাড়ি আছে। প্রত্যেক শীতের সময় যখন স্কুল-কলেজ ছুটি থাকত, তিনি সপরিবারে শিলং থেকে চলে যেতেন সেখানে। তাঁকে তখন প্রায় সর্বক্ষণই ঘিরে থাকত তরুণ কবিরা। তাঁরা অধিকাংশই আমার সমসাময়িক বন্ধু-কবি। প্রায় দেড়-দু’মাস পর তিনি ফিরে আসতেন নতুন পত্র-পত্রিকা সমেত নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো এক আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন আমাকে- ‘আপনার বন্ধুরা আপনাকে হিংসে বা অবজ্ঞা করে যে সে কথা বুঝতে পারি। এর কারণও আছে। ওরা প্রত্যেকেই আপনাকে ওদের একজন প্রতিযোগী ভাবে।’ একেবারে দূরদূরান্তের প্রবাসে পাহাড়ের কোল-সংলগ্ন থেকেও আমি যে কারও প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারি, এটা ভেবে পুলকিত হয়েছিলাম বলাবাহুল্য। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে পরবর্তী সময়ে সেসব চিত্র যে আরো ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করব, তা কল্পনাতেই ছিল না, যদি না বরাবরের জন্য কলকাতায় ফিরে আসতাম।
তবে আমার কলকাতা-পর্ব নিয়ে লেখার সময় আসেনি এখনও। কারণ এখনও নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে প্রতিদিন। কোনো পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তো অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও ভরপুর হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি কোন কবিকে তরুণ কবিরা ফোনে অন্য একজনের থেকে বেশি যোগাযোগ করলেন তাও হিংসায় ঝিলমিল করা কোনো কবির জ্বলে ওঠার কারণ হয়ে ওঠে। সেসবই পরবর্তী কোনো সময়ের আলেখ্য হিসেবে বিবেচনার অধীনে থাকুক বরং।
অতি পুরনো একটা সামান্য ঘটনার উল্লেখ করেই আপাতত ইতি টানব এবার। একবার বইমেলায়, তা ১৯৮০-৮১ সাল হবে হয়তো, শিলং থেকে এসে শীতের পাখি হয়ে প্রতিদিন ‘কৌরব’-এর স্টলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম নিয়মিত। একদিন পঞ্চাশের দশকের প্রয়াত এক কবি-শিল্পী ‘কৌরব’-এর স্টল থেকে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁকে সঙ্গ দেবার জন্য। ‘পরিচয়’-এর স্টলের সামনে তখন অগ্রজ কবিদের জমজমাট আড্ডা। তিনি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে স্টলের ভিতর ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বেরিয়ে আমাকে নিয়ে আবার এগোতে থাকলেন। তাঁর মুখটা তখন রাগে থমথম করছিল। কিছু হয়েছে কিনা আমি জানতে চাইলাম। তিনি ম্লান হেসে বললেন, ‘এবারের মেলায় একটা কবিতার বই বেরিয়েছে আমার। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সেটা ডিসপ্লে করে এলাম। আবার একটু পরে গিয়ে দেখব সেটা অন্য একটা বইয়ের পেছনে চলে গেছে।‘ তিনি তাঁরই সমসাময়িক এক কবির নাম উল্লেখ করছিলেন বারবার। প্রতিবারই নাকি ওই কবি নিজের প্রকাশিত বইটি দিয়ে এই কবির সদ্য প্রকাশিত বইটিকে আড়াল করে দিচ্ছিলেন। এ তো নেহাতই মিষ্টি-মধুর গল্প। তিক্ততার পর্যায়ে ওঠার কিছু কাহিনিও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে হাত ঢোকালেই উঠে আসবে সহজে। সেসব এখন নয়, বরং অন্য কোনো সময়ে।