বি শে ষ র চ না
‘হালকা অবিক্লিব স্বর্ণবর্ণ ঘোড়ায় চড়ে সূর্যকে দক্ষিণ দিকে দেখতে দেখতে’ আজীবন কোনো পুরস্কার বা প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে, জীবনযাপনের সমস্ত বাহুল্যকে চরম বিদ্রূপ করে, প্রকৃত রাজার মতো মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন মহাপৃথিবীর বাসিন্দা, বিশিষ্ট কবি শম্ভু রক্ষিত। তিনি ‘কেরর না অসুর’ তা আমাদের জানা নেই, তবে তিনি যে একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবী নয়, ‘মহাপৃথিবী’— একটি পত্রিকার নাম নির্বাচনের প্রবণতাই ইঙ্গিত করে মানুষটির মনোজগতের ব্যাপ্তিকে।
কবি শম্ভু রক্ষিতের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট, স্বাধীনতার ১বছর ১দিন পর। বিপ্লবীযুগে জন্ম না হলেও বিপ্লব ছিল তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ১৯৭৫ সালের ২৬শে জুন ভারতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি হলে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আরও অনেকের সঙ্গে কলম ধরেন তিনিও, এই সময় অনেক কবিতাও লেখেন। কবি জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকা এরকম সময়ে প্রকাশ করে বিশেষ রাজনীতি সংখ্যা। শম্ভু রক্ষিত ছিলেন পত্রিকার বিশেষ সহযোগী সম্পাদক। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই প্রকাশ ঘটে সংখ্যাটির। ‘রাজনীতি’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয় তাঁর। ১৯৭৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। ১৯৭৭-এর ৮ই ফেব্রুয়ারি জরুরি অবস্থা শিথিল হলে তিনি মুক্তি পান। কাজী নজরুল ইসলামের পর তিনিই কোনো বাঙালি কবি যিনি জেল খাটেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
কবির জীবনের প্রথম পর্ব কাটে হাওড়ায় মামাবাড়িতে। পরবর্তী সময়ে তিনি পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়াই হয়ে ওঠে তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ পরিচালনার ও যাবতীয় কাজকর্মের কন্ট্রোলরুম। কলেজস্ট্রিট থেকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসতেন কাগজ। দারিদ্র ছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। কিন্তু কোনোদিন তিনি পাত্তা দেননি তাকে। বিশিষ্ট কবি সুজিত সরকারের একটি লেখা থেকে জানা যায়, তিনি একবার তাঁকে দেখেছিলেন একটি প্রেসে কমপোজিটারের কাজ করতে। সম্ভবত সেই মালিকও জানতেন না তাঁর কর্মচারীটির আসল পরিচয়। ধরাবাঁধা কোনো কাজের গণ্ডিতে কোনোদিন বেঁধে রাখেন নি নিজেকে। দারিদ্র, বোহেমিয়ান জীবনযাপন, ধোঁয়াশা ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ। কবি সুজিত সরকার একবার বাস থেকে তাঁকে দেখেছিলেন, তিনি রাস্তায় কাগজ কুড়োতে কুড়োতে হাঁটছেন। এমনই খামখেয়ালি ছিল তাঁর যাপন। সাহিত্যের আড্ডায়, বইপাড়ায় হঠাৎ হঠাৎ হাজির হতেন, আবার সেখান থেকে বেরিয়ে মিলিয়ে যেতেন অন্ধকারে।
সম্ভবত ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’ তাঁর প্রথম বই। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’। এই বইটিই তাঁকে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয় কবিমহলে আর বাঙালি পাঠক পরিচিত হয় তাঁর ‘ঈশ্বরকন্যা’র সঙ্গে। ‘তুমি ঈশ্বরকন্যা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে…’ — কি আশ্চর্য পঙক্তি! ২০০৪-এ প্রকাশিত হয় তাঁর ‘‘আমি কেরর না অসুর’ কাব্যগ্রন্থটি। ২০০৫-এ পাঠক পায় তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বইটি প্রকাশ করে ‘দি সী বুক এজেন্সি’। ২০১৫ তে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ।
তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর কবিতাগুলির কোন চরিত্র বা বয়স নেই। প্রকৃতপক্ষে ধুতি-শার্ট, পায়ে কাবলি জুতো, কাঁধে ঝোলা, কথা বলার বিচিত্র ভঙ্গি আর হঠাৎ হঠাৎ খ্যা খ্যা শব্দে হেসে ওঠা নিয়ে ট্রেডমার্ক হয়ে থাকা কবি শম্ভু রক্ষিত নিজেও ছিলেন বোধহয় সমস্ত বয়স আর চরিত্রের উর্ধ্বে। কবি সুজিত সরকার তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, ‘আশ্চর্যের কথা, প্রথম যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যখন তাঁর কোনো কবিতাই আমি পড়িনি, আমার মনে হয়েছিল তাঁর কোনো বয়স নেই। তিনি আমার সমবয়সী হতে পারেন, কিংবা আমার বাবার সমবয়সীও হতে পারেন।’ একমাত্র প্রাজ্ঞই মানুষকে বয়সোত্তীর্ণ করতে পারে।
আচ্ছা এমন মানুষও কি প্রেমে পড়েন না? পড়েন। স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর টলে যান তো মানুষ কোন ছার! তারপর সেই মানুষ যদি কবি হন। সুজিত সরকারের লেখায় আমরা তারও উল্লেখ পাই— ‘সম্ভবত শ্রীরামপুর থেকে রমা ঘোষ ‘মহাপৃথিবী’-র জন্য কবিতা পাঠিয়েছিলেন। শম্ভু রক্ষিত সেই কবিতা ছেপে রমা ঘোষকে পৌঁছে দিতে যান হাওড়া থেকে শ্রীরামপুরে। সম্ভবত রমা ঘোষ তাঁকে চা মিষ্টি খাইয়েছিলেন। ব্যাস, শম্ভু রক্ষিতের ধারণা হ’ল রমা ঘোষের সঙ্গে তাঁর প্রেম জমে উঠেছে। তাঁর জীবনযাপন ও কবিতার মতোই অদ্ভুত এক চিঠি রমা ঘোষকে লিখে পাঠিয়েছিলেন পোস্টকার্ডে। রমা ঘোষের বাবা ছিলেন কলকাতা পোর্টট্রাস্টের ডক্টর। সম্ভবত পোস্টকার্ডটি তাঁর হাতেই পড়ে। এরপর শম্ভু রক্ষিত যখন শ্রীরামপুরে রমা ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে যান বাড়ি ঢোকবার মুখে রমা ঘোষের বাবা তাঁর নাম জিজ্ঞেস করেন এবং শোনার পর গম্ভীরভাবে তাঁর দিকে চেয়ে থাকেন। শম্ভু রক্ষিত সেখান থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন নাকি রমা ঘোষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তা অবশ্য আমার জানা হয়নি। তবে তাঁর কাছ থেকে এটুকুই জেনেছিলাম যে তিনি একটি সুদীর্ঘ দড়ির খোঁজে রয়েছেন। সেই দড়িতে রমা ঘোষকে বেঁধে তিনি হাওড়া থেকে রোজ একটু একটু ক’রে টান দেবেন। তাহলেই তাঁর রমা ঘোষকে পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। একথা বলার সময় তাঁর কন্ঠস্বর প্রেমিকের মতো কোমল হয়ে আসতো।’
তিনি বিয়ে করেছিলেন। তবে রমা ঘোষকে নয়। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে বর্তমান। ছেলের নাম কীর্তিকর, মেয়ের নাম দিওতিমা। কি অদ্ভুত নাম। অদ্ভুত শব্দের প্রতি কবি শম্ভু রক্ষিতের ঝোঁক ছিল বরাবরের। যেমন, ‘ঙাপি’, ‘ৎমীসিস’, ‘ছেরি’, ‘কেরর’, ‘হিমাধারা’ প্রভৃতি। এই সব অদ্ভুত শব্দদের দিয়ে তিনি রচনা করতেন তাঁর কবিতার চিত্রকল্প। দেশি-বিদেশি, ইংরেজি, ফার্সি, হিন্দি, মাগধী, পালি-সহ বহু শব্দের ব্যবহার অলংকৃত করে ছিল তাঁর কবিতাকে। তাঁকে প্রণাম। বাংলা কবিতা মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে রাখবে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে।
কবি সুজিত সরকার তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন একটি সুন্দর কবিতা—
শম্ভু রক্ষিতের লেখা কোনো পত্রিকাই ছাপতে চায় না, তাই তিনি নিজে নিজেই ছাপার উদ্যোগ নেন। শম্ভু রক্ষিতের লেখা কোনো কমপোজিটরই কমপোজ করতে চায় না, তাই, প্রেসমালিককে অনেক বুঝিয়ে, এখন নিজের লেখা তিনি নিজেই কমপোজ করেন। শম্ভু রক্ষিত যা লেখেন, তা কবিতা কিনা নিজেও জানেন না, কিন্তু তিনি না লিখেও থাকতে পারেন না।
তিনি প্রতিবারই আমাদের সাথে কফি খান, অসম্পূর্ণ বাক্যে কথা বলেন, হঠাৎ হঠাৎ খ্যা খ্যা শব্দে হেসে ওঠেন, প্রতিবারই কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গল্প করতে করতে কিছু দূর হেঁটে আসেন, তারপর প্রতিবারই হাওয়ায় মিলিয়ে যান। তিনি কোথায় থাকেন তা আজ আমরা কেউই জানি না। তিনি লেখেন: ‘আমি পৃথিবীর কত বাইরে, কত উপরে আছি।’
বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
সুজিত সরকার, শুভদীপ সেনশর্মা
তথ্যসূত্র:
কবি শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে দু-চার কথা: সুজিত সরকার,
শম্ভু রক্ষিত স্মরণে: চন্দ্রদীপা সেনশর্মা (আলোপৃথিবী পত্রিকা)
চিত্র ঋণ:
লিটল প্রচার লিটল প্রসার ফেসবুক গ্রুপ, পৃথ্বী বসু, দীনেশ কর, শংকর রায়