কবির কলমে | ছো ট গ ল্প ১
প্রথমেই মনে পড়ে লুচির কথা। লুচি, মানে লুচি বেলা। রান্নাঘর লাগোয়া জাল দেওয়া বারান্দার অর্ধেকটা জুড়ে বাসন মাজার জায়গা, ওখানে বসে জয়াম্মা আর মায়া বাসন মাজে, আর পাশে বসে আমি লুচি বেলি, পাঁচটা দশটা নয়, চল্লিশ পঞ্চাশটা রাশি রাশি লুচি। বেলতে বেলতে আমি জামগাছের দিকে তাকাই, বুঝতে পারি অন্ধকার গাছতলায় অনেক থেঁতলানো জাম পড়ে আছে। জাম থেঁতলে মাটির সঙ্গে মিশলে যে রঙ হয়, আমার রঙ নাকি সেইরকম।
বাড়িতে কোন কালো লোক এলেই আমার শাশুড়ি ডেকে বলেন, ‘দেখো দেখো তোমার থেকেও কালো! কিংবা তোমার মতই কালো, কিংবা তোমার চাইতে একটু কম কালো।‘ অর্থাৎ আমি হয়ে উঠি কালোর রেফারেন্স পয়েন্ট। আমার নিরিখে ত্বকের পিগমেন্টেশন মাপা হতে থাকে আর আমি আমার পৃথিবী জোড়া কালো ভাই বোনদের ডাকি মনে মনে- এসো একটা লুচি খেয়ে যাও, আমার হাতের লুচি। ভালো ফোলে না, কখনও নিমকির মতো হয়ে যায়, তাই নিয়ে দুপুরে ঝড় ওঠে পুবের বারান্দায়। আমি তখন সেই বারান্দায় ঝোলানো শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে গঙ্গা দেখি আর শুনি আমার লুচির অক্ষমতার কথা।
গঙ্গার পশ্চিম কূল তো বারাণসী সমতুল শুনেছি, কিন্তু এখানে বই খুলে বসলে মহা অশান্তি। সবুজ ফাঁক ফাঁক কাঠের রেলিং দেওয়া এল শেপের বিশাল বারান্দা, এল-এর দু বাহুর জোড়ে একটা জাল ঘেরা মস্ত খাঁচা। খাঁচার মধ্যে একটা বনসাই বট রাখা, তাকে ঘিরে একরাশ বদ্রি পাখির কিচিমিচি। এই খাঁচাটা আমার পড়ার অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দু যেন, আমি অদৃশ্য একটা রেখা টানি বারবার, আর বারবার ছিঁড়ে যায়। আমি কত জায়গায় যে বই খুলে বসি কিংবা ডায়েরি খুলে। কিছু পড়ার চেষ্টা করি বা লেখার। আর বারবার গঙ্গার দিকে চাই। গঙ্গা যেন রুপোলি কালি ভরা একটা মস্ত দোয়াত। আমি আমার পেনটা ওই দোয়াতে চুবিয়ে নিলেই যেন জাদু অক্ষর লিখতে পারব। পারি না। জলের দাগ যেমন ফোটে না, ফুটলেও মিলিয়ে যায় নিমেষে, তেমনি।
পুণ্য অনেকদূর থেকে আসে, ওর বাগান করার ডিউটি। ও ভালো ভালো আলু বীজ আনবে আর কত্তা ভাবেন সেই আলু বেচে ওঁর বাজার খরচ উঠবে। বড় মেয়ের বিয়েও তিনি এখানে থাকতে থাকতেই দিয়ে যেতে চান, কারণ এখানে ডেকরেটরের খরচা নেই, ভালো গিফট পাওয়া যাবে। আমার রবীন্দ্রনাথকে মনে না পড়ে পারে না। তিনি দেবেন ঠাকুরের বিবাহ ভাতার লোভে তড়িঘড়ি সব মেয়েদের উল্টোপাল্টা বিয়ে দিয়েছিলেন। এ বাড়ির কত্তাটিও সেইরকম। শুধু যা তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। আমাকে লিখতে দেখলেই বলেন, ‘ কবিতা লিখে কী হয়?’
এইভাবে তিনি আমাকে একটি মৌলিক প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেন।
বাথরুমের বিশাল জানলার সামনে দাঁড়িয়ে পুণ্যের আলু চাষ দেখতে দেখতে আমি নবকুমারের মতো ভাবি, ‘এই কবিতা লইয়া কী করিতে হয়? এই কবিতা লইয়া আমি কী করিব?’
হাঁসের প্রিয় গুগলি
পর্তুগিজদের হুগলী
গানের প্রিয় তানপুরা
ওলন্দাজদের চিন্সুরা
একদিন আবিষ্কার করি আমার শোবার ঘরে কোন জানলা নেই। একদিন আবিষ্কার করি ওটা আমার শোবার ঘরই নয়। ১৮ বাই ৩০ ফিটের এই ঘরটি বহুবিধ উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটা কখনো ঠাকুরঘর, কখনো ননদের পড়ার ঘর, কখনো প্রসাধনের। কারণ ঠাকুরের সিংহাসন , পড়ার টেবিল চেয়ার এবং ড্রেসিং টেবিল পর পর রাখা আছে। ঘরটা খুব বড় বলে তাদের মধ্যে অবশ্য যথেষ্ট দূরত্ব, এছাড়া একটা ৩০ বছরের সংসার যত বাড়তি জিনিস জমাতে পারে, তার সবকিছুই এখানে জায়গা পেয়েছে। তার মানে এটি এমন একটি ঘর, যেটি প্রায় মানুষের জাগরণের প্রতিটি মুহূর্তে কারো না কারো দরকার হচ্ছে। কেউ পুজো করতে আসছে, কেউ পড়তে আসছে, কেউ সাজতে, কেউ ঘর মোছার পুরনো কাপড় বা শীতের লেপ বার করতে। আর এ সবের মধ্যেই এক কোণে আমার বিয়ের নতুন খাট সসঙ্কোচে পড়ে। সেখানে বসে আমি একদিন আবিষ্কার করি এই ঘরে জানলা নেই একটাও।
ঠিক ক’টা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এসেছিলাম কে জানে। কিন্তু সংখ্যাটা ইম্পর্টেন্ট নয়, আসল কথা কত উঁচু। আর কতটা চওড়া। একটা হাতি অনায়াসে উঠে আসতে পারে। কোন একজন মুঘল সম্রাট সরু সিঁড়ি দিয়ে পড়ে মারা যান। এই সিঁড়ি দেখে প্রথমেই আমার অদ্ভুতভাবে তাঁর কথা মনে হয়। দুধে আলতায় পা চোবানোর আগে কেন যে মনে হয় এসব কথা। সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আমি হাঁপিয়ে যাই। এটা তো সবে আমার প্রথম দিন!
হাজিম কত্তার বাজার করে দ্যায় আর আমার রুটির সমালোচনা করে। আমার পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন শেপের রুটি। সে বলে বড়দির রুটি গোল গোল, ছোড়দির রুটি কাঁচা কাঁচা আর বউদির রুটি পোড়া পোড়া । আমি ইউনিভার্সিটির তিনতলায় লাইব্রেরির সামনে বসে মাথা নিচু করে টিফিন বাক্স খুলে ঐ পোড়া রুটি দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি খাই।
আমি ওখানে আটমাস ছিলাম। যেন প্রচ্ছন্ন গর্ভ। কেউ জানত না আমাকে। গঙ্গা পার হয়ে কলকাতা গেছি রোজ রোজ, কিন্তু কেউ আমায় চেনেনি। শুধু একবার অজন্তা মজুমদার, স্কুলে পড়ত একসঙ্গে, হঠাৎ দেখা, বলেছিল ও ধুবুলিয়া টিবি কলেজে নার্স। সেই থেকে ধুবুলিয়া শব্দটি আমার কাছে খুব নিঃসঙ্গতার ছবি। আমার মনে ভেসে ওঠে ধু ধু নির্জন প্রান্তরে নার্স কোয়ার্টার। সেখানে সংসার না পাওয়া কয়েকটি মেয়ে কেমন উদাসীনতার ঘোরে বেঁচে আছে। আমি আর কখনো অজন্তাকে দেখিনি।
সবাই বলে গঙ্গা, আমি বলি নদী। গঙ্গা বললে আমি ভেসে যাওয়া শুকনো ফুল, লাশ আর থ্যাবড়ানো জ্যাবড়ানো সিঁদুর দেখতে পাই। ঠিক আমার বিয়ের মতো। অন্য দিকে নদী এক উদাসী বালিকা, সারাদিন সে আপন মনে ফুল তোলে, মালা গাঁথে, জানলায় বসে মেঘ দেখে বৃষ্টি দেখে, কেউ তাকে বিরক্ত করে না। এই নদী পার হয়ে আমি নৈহাটি যাই, পঁচিশ পয়সা ভাড়া। জেটিঘাটে নেমে খানিকটা হেঁটে নৈহাটি স্টেশন, প্লাটফরমে পা রেখে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। যাক, কলকাতার খানিকটা কাছে চলে এলাম। কলকাতার কাছে, মা’র কাছে। একদিন এই নদী পার হতে গিয়ে শোভন মামার সঙ্গে দেখা। শোভন মামা মা’র রাশি পিসিমার ছেলে। তাই কি? ওর কি একটা বোন ছিল? সেই বোন খুব পাকা, পড়াশোনায় মন ছিল না, অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করে? সেসব ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধু কয়েকটা জিনিস মনে আছে। শোভনমামা দেখতে সুন্দর ছিল, গজ দাঁত, হাসিটা দারুণ। ও একবার আমাকে একটা অংকের ধাঁধা জিগ্যেস করেছিল, আমি পারিনি, তাতে ওর ধারণা হয় আমি অংকে খুব কাঁচা, ওর ওপর আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম, আর তিন – ও একবার আমাদের বাড়ি এসেছিল, এক শীতের রাতে। শীত এই কারণে মনে আছে কারণ মা ওকে রাতে রুটির সঙ্গে বিট গাজরের তরকারি দিয়েছিল, সঙ্গে একটা অমলেট। এত সাধারণ খাবার দেখে আমার ধারণা হয় মা শোভনমামাকে পছন্দ করে না।
বড় ননদের বিয়ের আগের দিন রবীন্দ্র ভবনে ম্যাজিক শো। কেউই যায় না, শুধু ও। কত্তার ধারণা ও কোন কাজ করছে না, তাই ওকে ম্যাজিক দেখতে পাঠানো হয়। দুপুরে ও সেলুনে যায় চুল ছাঁটতে, একটা বিচ্ছিরি অচেনা লোক সেলুনে। রাতে দেখে স্টেজে সেই লোকটাই ম্যাজিক দেখাচ্ছে।সেদিন রাতে ও আমাকে ভ্যানিশ করে দিতে চেয়েছিল!
একটা ঘড়িমোড় আছে। তার পেছনে একটা গির্জা। আমরা গেছিলাম এক শীতের সন্ধেতে। মানে ২৫ শে ডিসেম্বর। বাইরে অনেক বেচা কেনা, ভেতরে বেশ একটা ঘিনঘিনে শান্তি। আমি একটা পাতলা বাইবেল তুলে আনি। লেট দেয়ার বি লাইট। আলো, আলো কই? আলো?
এই শহরটাকে আমি চিনি না। আমি এর ওপর দিয়ে যাই আসি, জেটিঘাট দিয়ে লঞ্চে করে নৈহাটি যাই, নৈহাটি থেকে ট্রেনে শিয়ালদা। আবার ফিরে আসি। এসে তিনতলা সমান দোতলায় উঠি, বুঝতে পারি আমার গর্ভ হয়েছে। খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাই। একটা লাল বল আমার দিকে ছুটে আসে। আমার ঘুম ভেঙে যায়।
সার্কিট হাউসের বাঁদিকে বাগান, বাগান পেরিয়ে সরকারি অফিসারদের নিজস্ব ঘাট। ছোট্ট, বিশেষত্বহীন, নির্জন। কারণ বাবু বিবিদের কারো গঙ্গায় নাইবার অবসর নেই, এ ডি সির বুড়ি পিসি যায় মাঝে মাঝে আর সি এইম ও এইচের আধপাগলা ছেলেটা। কিন্তু এই প্রবল প্রতাপান্বিত ঘাটের পাশে বাইরে দিয়ে ঘুরে একটা ঘাট আছে। তার নাম কস্তুরমঞ্জরীর ঘাট। সেখানে আমি কখনো যাইনি।আমার না যাওয়া জায়গাগুলোই ইতিহাসে থাকে বরাবর। এই ঘাটকে বাঁয়ে রেখে রাস্তাটা ষণ্ডেশ্বরতলার দিকে বেঁকে গেছে। হাজি মহসীন কলেজের সামনে দিয়ে কিছুটা হেঁটে যাবার পর একটা বাঁধানো বটতলা। বড্ড টানে আমাকে। এর কিছুটা আগে প্যান্ডেল বেঁধে দুর্গা পুজো হয়। অষ্টমীর দিন ওখানে অঞ্জলি। ফিরে এসে রান্নাঘরের সামনে জাল বাঁধানো বারান্দায় বসে আমি চল্লিশখানা লুচি বেললাম। বেলতে বেলতে তলপেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা প্রিয় গানের মতো বারবার। আমি তখন নিঃশ্বাস নেবার জন্যে জামগাছটার দিকে তাকাচ্ছিলাম। দিদিশাশুড়ি এসে লুচির গুলি পাকিয়ে দিল। ছোট ননদ ওদিক দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, ‘এই কটা লুচি বেলতে এতজন লাগে?’ লুচি ভাজা শেষ করে আমি প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে বাথরুমে গেলাম। রক্ত রক্ত! অষ্টমীর রাত কাটল কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে। সকালে বাথরুমে যেতে সে বেরিয়ে এল, আমার সন্তানকে দেখলাম কমোডে ভাসছে। কে তাকে জামগাছতলায় পুঁতে রেখে এসেছিল? আমি না পুণ্য? মনে নেই। শুধু মনে আছে সোয়াবিনের স্বাদ। আমার জন্যে একটা সোয়াবিনের তরকারি আর ভাত রেখে ওরা নবমীর খাসির মাংস ভাতের নিমন্ত্রণ খেতে বেরিয়ে গেছিল। আমি জানলাহীন ঘরে বিয়ের খাটে একা শুয়ে মনে মনে একটা নিখুঁত গোল লুচি বেলার চেষ্টা করছিলাম!