আ মা র পু জো
পুজো বলতেই প্রথমেই একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেক বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া একটা অবয়ব। আমার ঠাকুমা—যার হাত ধরে উত্তর কলকাতার কোম্পানি বাগানে দুর্গা ঠাকুর দেখতে যেতাম। যার চোখ এড়িয়ে এদিক-ওদিক চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। হাতে পুজোর থালা, সাধাসিধে করে পরা পাটভাঙা তাঁতের শাড়ি, চোখে প্রচণ্ড পাওয়ারওয়ালা চশমা। মনে হত ওই অবয়ব থেকেই ধূপ-ধুনোর গন্ধ বেরোয়। মিথ্যে বলব না, তখন একেকদিন ঠাকুমার ওপর খুব রাগ হত। বন্ধুরা সব নিজেরা নিজেরা ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছে আর আমার কপালে ক্যাপ বন্দুক, গ্যাস বেলুন, নারকেল নাড়ু আর খুব সদয় হলে আইসক্রিম। ভাল্লাগে কারো!
ভালো লাগতে আরম্ভ করেছিল অনেক পরে। তখন বেশ লায়েক হয়েছি। পুজোর চারটে দিন চরকিপাক কাটছি বাগবাজার, শোভাবাজার, হাতিবাগান, মানিকতলা। শ্বাসরুদ্ধ অভিযানে দক্ষিণ কলকাতায়—ম্যাডক্স স্কোয়ার, মুদিয়ালি, সিংহি পার্ক। কলেজে পড়ি। সুদূর উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতাম কলেজে। ফলে কিছুটা ছাড় পাওয়া গিয়েছিল। এই ছাড় পাওয়া বা না পাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি নির্ভর করতো ঠাকুমার ইচ্ছের ওপর। মা-বাবার এই নিয়ে খুব বেশি আপত্তি কোনোদিনই ছিল না। শুধু একবার ঠাম্মাকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারলে কেল্লা ফতে। ফলে মহালয়ার দিনে তাকে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়া, পুজোর ফল-মিষ্টির তদারক করা—সব করতাম সোনামুখে। যাতে পুজোর ক’টা দিন অফুরন্ত স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে। একটা সময় এল যখন ঠাকুমা আর কিছুই বলতো না। বোধহয় বুঝতে পেরেছিল নাতি-নাতনিরা ‘বড়ো’ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সব নিষেধের বাধা উঠে গেল। তিনি আরও বৃদ্ধ হলেন।
এইভাবে একদিন ঠাকুমা আমাকে একা রেখে চলে গেল। মনে আছে শেষবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের দেশের বাড়ির মূল দরজার চাবিটা ঠাকুমা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গিয়েছিল। সেদিন প্রথম বুঝতে পারি এই বৃদ্ধা আমায় ভরসা করে। ঠিক সেই বছর থেকেই আমি মহালয়ায় নিয়মিত তর্পণ করতে শুরু করি। অন্য কিছু নয়, শুধু মনে হত ঠাকুমা খুশি হবে।
এখন অবশ্য জীবনটা অন্যরকম। কাজের চাপে পুজোর প্ল্যান আলাদা করে করা হয়ে ওঠে না। পুজো বলতে এখন শুধুই নিখাদ আড্ডা। হ্যাঁ, ঠাকুর দেখি তবে সেই দেখাতেও আড্ডার পরিমাণটাই সবচেয়ে বেশি থাকে। সবটাই নিজের ইচ্ছে মতো—কেনাকাটা, ঘুরতে যাওয়া বা এমনিই বসে থাকা। অলস দুপুরবেলাগুলোয় পুজো সংখ্যার পাতা উলটানো। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-গল্পে কেটে যায়।
অষ্টমীর লুচির গন্ধে, নবমীর হোমের টিপের স্পর্শে আমি এখনও তাঁকে খুঁজি। ছোটোবেলায় পুষ্পাঞ্জলি দিতে গিয়ে ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বকুনি খাওয়া—খুব খুব মনে পড়ে। বুঝতে পারি না কীভাবে এত জটিল হয়ে গেল জীবনটা। পাড়ার কাকা-জ্যাঠাদের ওইসব বকুনি, ওইসব শাসন, সমস্ত চোখরাঙানি—আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। জানি বোকামির মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু এইটুকু বোকামি বেঁচে থাক।
বেঁচে থাক আমার ‘কলাবউ চানের’ দলের পিছনে পিছনে ছোটা, বেঁচে থাক ভাসানের ঢাক, বেঁচে থাক চাঁদার হিসেব, বেঁচে থাক দধিকর্মা মাখা হাত…