আ মা র পু জো
“নুনশিউলি… নুনশিউলি… পনের টাকায় একশো… আট টাকায় পঞ্চাশ…” আশ্বিনের সকালে ঘুম ভাঙত এই আওয়াজে। ঘুমের ঘোরেই জানতাম আরশাদ কাকুর গলা। নুনশিউলি আসলে অবিকল শিউলি ফুলের মতো দেখতে এক রকমের কুড়মুড়ে মুখরোচক খাবার। একটু নোনতা, আবার একটু মিষ্টি। ডাল দিয়ে বানানো খাবারটা বেশিদিন টাটকা রাখা যেত না। তাই দু-তিনদিন ছাড়াই আরশাদ কাকু বাড়ির গলি পেরিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে নুনশিউলি নিয়ে হেঁকে যেতেন। দু’চারজনের ভিড় জমলেই মাথা থেকে যত্নে বেতের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে দিতেন শিবমন্দিরের চাতালে। পলিথিন কাগজে মোড়া ছোট ছোট নুনশিউলি আর তার চারপাশে ঝুড়ির কানা ঘেঁষে গোল করে সাজানো টাটকা শিউলি ফুল। প্রতিবার আমার বরাদ্দ ছিল পঞ্চাশ গ্রাম। একটা খেলনা দাঁড়িপাল্লার মত ছোট পিতলের দাঁড়িপাল্লায় হিসেব করে ঠোঙায় ভরে তারপর আরও দু’চারটে ফাউ। শেষে উপরে দু’চারটে শিউলি ফুল ছড়িয়ে তবে ঠোঙাটা আমার হাতে দিতেন কাকু। দেবার সময় হেসে বলতেন, “এটা পুজোর প্রসাদ”। টাকা মেটানোর পর প্রতিবার মা আমার হাত থেকে ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে নিয়ম করে সব ফুলগুলো বেছে বেছে ফেলে দিতেন। আমি কিন্তু খাওয়ার সময় প্রতিবার ফুলের গন্ধ পেতাম। বেশ কয়েকবার কয়েকটা পাপড়ি চিবিয়েও ফেলেছিলাম। আলাদা কিছু মনে হয়নি। শুধু একটু কষা! আশ্বিনের সকালেই আরশাদ কাকু নুনশিউলি নিয়ে আসতেন নিয়ম করে। তাই নুনশিউলি মানেই তখন পুজো শুরু।
দুর্গাপুজো নিয়ে সবার উত্তেজনার কারণ আমার অল্প অল্প বোধগম্য হতে শুরু হয়েছে অনেক পরে। পুজো বলতে আমার কাছে একদিন বা বড়জোর দু’দিন নতুন জামাকাপড় পরে ভিড়ের মাঝে প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে ঘোরা। বাকি সব বাচ্চাদের কাছেও হয়ত পুজো একইরকম। মজার ব্যাপার হল পুজোর অনুভূতিটা আজও আমার কাছে খুব বেশি বদলায়নি। আমার কাছে ছোট থেকেই দেবী দুর্গা একটা বেশ সুন্দর দেখার জিনিস। সুন্দর মূর্তি, সুন্দর আলো… সব কিছুই সুন্দর সুন্দর। বড় বড় প্যান্ডেলের মধ্যে বড় বড় মূর্তি খুব সুন্দর করে সাজানো আর প্রচুর লোকের ভিড়। বাবা-মার হাত ধরে এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মূর্তিগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। প্যান্ডেলের মধ্যে অদ্ভুত নরম আলো আর অসংখ্য কারুকার্যে ঝলমল করা সন্ধেগুলো নেশার মত মনে হত প্রতিবার। ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফিরে কাদা হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। প্রায় প্রতি বছরই অষ্টমী কিংবা নবমীতে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। দশমী মানে বিসর্জন শুনে এসেছি বরাবর। আমার কাছে অবশ্য আবাহন বা বিসর্জন সবই ওই এক বা দু’দিনেই। যেদিন ঠাকুর দেখতে যাবো সেদিনই দুর্গাপুজো। সকাল থেকেই বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপার। সুন্দর সুন্দর প্যান্ডেল, ঝলমলে সন্ধে, রাতে রাস্তায় ভিড়… কত মানুষ ! আলাদা করে ষষ্ঠীর বোধন বা দশমীর বিসর্জন কিছুই দাগ ফেলত না। আজও তাই।
ছোটবেলায় মনে হত ঠাকুর দু’রকমের হয়। একরকম ঠাকুরকে পুজো করা হয় আর একরকম ঠাকুরকে দেখতে হয়। পুজো করতে হয় যে ঠাকুরকে, সেই ঠাকুর আবার মূর্তি নয়। কারণ বাড়িতে মূর্তিপুজোর চল নেই। পূর্বপুরুষ নিষিদ্ধ করে গেছেন মূর্তিপুজো। ছোট থেকে দেখে আসছি বাড়ির তিনটে মন্দির। কালীমন্দিরে তামার ঘট। শিবমন্দিরে পাথরের শিবলিঙ্গ আর মহাপ্রভুর মন্দিরে তুলসীগাছ। যে ঠাকুরকে পুজো করতে হয় সেই ঠাকুরের আবার মানুষের মত চোখ, নাক, কান, হাত, পা থাকে, এটা কখনো মাথাতেই আসেনি। বন্ধুদের বাড়িতে সরস্বতী মূর্তি আসত। আমার বাড়িতে একটা তামার ঘটে আমশাখা। সুন্দর আলপনা এঁকে ঘট রাখা হতো। ঘটের সামনে বিস্তর বই, হারমোনিয়াম, গান-এর যাবতীয় সরঞ্জাম। সরস্বতী পুজোর সকাল থেকে তাই স্কুলে যাওয়ার তাগাদা বেশি ছিল। কি সুন্দর টানা টানা চোখ, সুন্দর শাড়ি পরা একটা ছোটখাটো মূর্তিকে পুজো করতো স্কুলে। আমিও বসতাম সবার সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দিতে। সেই আমার পুষ্পাঞ্জলির একমাত্র অভিজ্ঞতা। বাড়ির আশেপাশে দুর্গা ঠাকুর বলতে বেশ খানিক দূরে জমিদার বাড়ির পুজো আর রায় বাড়ির পুজো। কিংবা আরও খানিকটা দূরে বাসস্ট্যান্ডে বাজারের পুজো। কোনও পুজোর শব্দই আমার কানে এসে পৌঁছত না। ষষ্ঠীর দিনটা আমার কাছে বিশেষ ছিল কারণ প্রতিবছর মামাদাদু ষষ্ঠীতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। হই হই ব্যাপার ! নতুন জামা, মিষ্টি। মাকে সারাদিনই দেখে মনে হত উৎসব লেগেছে। যে চারদিন দাদু আমাদের বাড়িতে থাকতেন মা’র মুখটা জ্বলজ্বল করত। আমারও তাই যাবতীয় দুষ্টুমির সাতখুন মাফ। আমার কাছে সেটাই পুজোর আনন্দ। দাদু মারা যাওয়ার পর ষষ্ঠীর দিন থেকে পুজো শুরু হয়না আর।
আমার কাছে দেবী দুর্গা একটা অদ্ভুত ভাললাগার গল্প, এক পছন্দের প্রতীকী। প্যান্ডেলে ঢুকে আজও প্রণাম করতে পারিনা। কারণ কোনদিনই ওই প্যান্ডেলের দুর্গা আমার ঈশ্বর হননি। যেমন ঈশ্বর হননি প্যান্ডেল বা মন্দিরের সরস্বতী, কালী, গণেশ, কার্তিক বা ফটোতে জটাধারী শিব। আমার কাছে ঈশ্বর কখনো মূর্তি হয়ে আসেননি। না, আমি নাস্তিক নই একেবারেই। শিবলিঙ্গের পুজো আমার বেশ পছন্দের। শিবের গল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা ধারণা বা দর্শন আমাকে বারবার টানে। যেমন টানে কালী বা দুর্গার সঙ্গে আটকে থাকা ধারণা আর দর্শন। কিন্তু আমার গল্প ওই ধারণাতেই শুরু আর শেষ। বড় হবার পর দেবীমূর্তি দেখে মনে হয়েছে মূর্তির গঠন এক অদ্ভুত ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু পুজো করার কথা মনে হয়নি তখনো। এখনও একবারও মনে হয় না যে আশ্বিনের কোন এক আগমনীতে সমস্ত অশুভ নাশ হবে। তেমনই কোন বিসর্জনের বাজনায় মন কাঁদেনা আমার।
তবে দুর্গাপুজো আমার কাছে এরকমই কিছু কারণে বিশেষ হয়ে থেকেছে। পঞ্চমীর সকালে আমার হাত দিয়ে মা গরিব বাচ্চাদের নতুন জামা দিতেন। এখন নিজের হাতেই দেন। কারণ, পঞ্চমীতে আমি বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারিনা। বাকি তিনদিন আমার হাতে শুধু বিভূতিভূষণ… জানিনা কেন পুজোর কয়েকটা দিন বিভূতিভূষণ ছাড়া আর কিছু মনে আসেনা আজও। আর অষ্টমীর দিনে বাবার আনা মাটির ভাঁড়ে ক্ষীর।
আরশাদ কাকু মুম্বাইতে ছেলের কাছে চলে গেছেন অনেক বছর হল। নুনশিউলির স্বাদটা এখন আর বর্ণনা করার মত করে মনে করতে পারিনা। তবে জিভে টাটকা স্মৃতি লেগে আছে। আশ্বিনের কোনও এক সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙে। মনে হয় কে যেন হেঁকে গেল “নুনশিউলি… নুনশিউলি… পনের টাকায় একশো…” কে জানে এতদিনে নিশ্চয়ই দামটা একটু বাড়াত আরশাদ কাকু! মুম্বাইতে কোন এক গলিতে এই আশ্বিনের সকালে কি কেউ অপেক্ষায় থাকে নুনশিউলির? মুম্বাইতে সেই গলিতে শিউলি ফোটে নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই তারা বোঝে আরশাদ কাকুর নুনশিউলি নামকরণের মাহাত্ম্য! হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙলে ওই রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়াই বারান্দায়। গলির রাস্তায় হাওয়ায় নাকে এসে লাগে শিউলির গন্ধ! ওপরের আকাশটাকেও কি নরম মনে হয় এই ক’দিন! আহা… বছর বছর দুগগা আসুক… বড় ভাল দুগগাঠাকুর…