আ মা র পু জো
দুগ্গাচাতালের ফাটা মেঝে ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে জানি ঝিকিয়ে উঠত !
বোধনের বাজনা বাজার আগেই আমরা ফ্রকপরা দুইবোনে মাথায় ঝোড়া ভর্তি স্থলপদ্ম আর শিউলি নিয়ে গিয়ে হাজির হতুম। শিশিরে ভেজা ঘাসে বসে সোঁদা গন্ধময় চাতালের দিকে তাকিয়ে থাকতুম। সেন বাড়ির বিমলা, সবাই যাকে বিমলদা ডাকে পুজোর আগে চাতাল ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলত। ভোরের হালকা আলোয় তার শাড়ির মতো করে পরা ধুতি থেকে কেমন কুয়াশা কুয়াশা আলো বেরতো। বিমলার কাজলপরা চোখগুলো যেন তার গোয়ালভর্তি গরুর মত মায়াবী। চন্দনবাটা হলে সে নিজের কপালে বড়ো করে ফোঁটা কেটে শান্তস্থির ঠান্ডা আঙুল বাড়িয়ে দিত আমাদের কপালে। ততক্ষণে রাস্তার এক উটকো পাগলি আঁজলা ভরা শিউলি নিয়ে… চাতালের সিঁড়িগুলো শিউলিতে সেজে উঠত। এইক’টা বেহেড বাউন্ডুলে নিয়ে জৌলুসহীন একটা পুজোর ভোর হত। আমাদের হলুদ ফ্রক ভিজে যেত শিশিরে, গলাসাধার হারমোনিয়ামে ভিজে যেত পাড়া।
পুজো এলেই আরেকজনের কথা অবধারিত ভাবে আসে, বজপন ! আসল নাম কি ছিল মনে নেই। সে নিজেই নিজের নাম দিয়েছিল বজপন।
তখন যারা বুঝেছিল পড়াশোনা করে কিছু হবে না, তারা হঠাৎই একদিন বোম্বে চলে যেত। ফিরত বেশ কয়েকবছর পরে রীতিমতো ফর্সা হয়ে ! গলায় মোটা বাইশ ক্যারেট। এসেই বাইক কিনত একটা। পুজোয় ফেরা তেমনই এক দাদার নাম বজপন। আমাদের ফড়িং ধরার খেলা থামিয়ে সে বোম্বের হিরোইনদের গল্প বলতো; যেন তাদের সঙ্গে তার নিত্য যাপন !
মাইকে সেই সব হিরোইনদের সিনেমার গান হলে আমরা বজপনদার গল্পের সঙ্গে তাদের মেলাতুম। সবার আলাদা আলাদা গল্প তৈরি হতো। মনের ভেতর নিজস্ব রঙিন ফানুস।
ঘষা কাঁচের এপার থেকে বিশাল চোখের কিছু ফেলে আসা মোজাইক উড়িয়েছি কর্মজীবনের একাংশে। অরফানেজ হোমের ওল্ড এজ বিভাগ অন্য এক পুজো চিনিয়েছে বেশ ক’বছর। স্নেহকাঙালের বোধ হয় শেষ আশ্রয় ওল্ড এজ হোম। তাদের স্নেহপাত্র কই ? এদিকে আমি কাঙাল ! বাটি হাতে মিসেস গোমসের থেকে শিখে নিই ফিশ গ্রিল করার পদ্ধতি। দাপুটে সান্যাল জেঠুর চোখ ভিজে যেত নবমীর ঢাকের বাদ্যিতে। ওগো নবমী নিশি না হইও অবসান।
একঘর বুড়োবুড়িকে তাদের প্রেসার ঘুম আরো নানা ওষুধ দিয়ে বাইরের আলোসচল নগরীকে আমার কখনো মায়াবি মনে হয়নি, হৃদয়হীন মনে হয়েছে। পরে অবশ্য দেখেছি সমস্ত পৃথিবীতেই দুরারোগ্য হৃদয়হীনতার ব্যাধি আছে। নবমী নিশি আসে, যে নিশিতে আরতির ধোঁয়ায় চোখে ধাঁধা লেগে যায়। ঠাকুরমা প্রতিমার চোখে দেখেন জল, অশ্রু !
অশ্রু বন্দনার আরেক নামই দুর্গাপুজো।
এসেছে তো যাবে বলেই।
এখন দুগ্গাদের জন্য লক্ষ্মী-সরস্বতীর জন্য হাতে গয়না বানাই, পোশাকে আঁকি, বেশ মজার কাজ। অনেক মানুষ সামান্য হলেও উপকৃত হন। যাঁরা থান কাটেন, সেলাই করেন, বোতাম ঘর বানান, গয়নার নানান অংশ তৈরি করে দেন যিনি, কাঁথার কাজ করেন যিনি, তাঁদের এক বেলার ভাত বা একটা ওষুধ আমার দুগ্গা কাত্তিকরা জুগিয়ে দেয়। এই-ই বা কম কি ?
কোভিডে পলিমাসিকে আয়া সেন্টার বসিয়ে দিয়েছিল দু-তিন মাস। পলিমাসি আমায় মাস্ক তৈরি করে দিয়ে অনেক সাহায্য করেছে।
আসলে তো দুগ্গা কোনও মূর্তি নয়। দুগ্গা বিমলা, যাকে সমাজ বিমলদা বলে ডাকে। দুগ্গা মিসেস গোমস। দুগ্গা আমার বড়দিদুন, যার কাছে শুয়ে শুয়ে অবিরত শুনেছি সাবেকি রান্নার শিল্প, রবি ঠাকুরের রাজা-চিত্রাঙ্গদা। দুগ্গা পলিমাসি।
আর দুগ্গা সেই সুন্দরীরা যাদের দৃঢ় লাবণ্যময় মুখের দিকে চেয়ে গয়না বানাই।
এবছর প্রথম বাবাকে ছাড়া পুজো। মাকে আগলে রাখার দায়িত্ব বাড়বে ক’দিন আরেকটু বেশিই। দশমীর দিন পিঠোপিঠি ভাই বোন হাত ধরে বসে থাকব দিম্মার বসানো বৃদ্ধ কামিনী গাছটার নিচে, যতক্ষণ না ঝরে পড়া ফুলের পাপড়িতে সম্পূর্ণ ডুবে যাই।