আ মা র পু জো
‘শ্রাবণ এলে খড়কাঠামোয় সোঁদা মাটির সুখ / সারাটা রাত জাগিয়ে রাখে ঠাকুর ঠাকুর মুখ’
অমরজেঠু যেই না বললেন — “আয় প্রসাদ নিয়ে যা”, আমিও দৌড়ে গিয়ে বারকোশের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাঁ করলাম। ডাকের সাজের দেবীপ্রতিমার সামনে তন্ত্রধারক জেঠুর মণ্ডপকাঁপানো হাসি — “দেখেছ! নির্ঘাৎ এটাকে মা এখনও খাইয়ে দেয়!” সময়টা আটের দশকের একদম শুরুতে, কলকাতার লাগোয়া উপনগরী লবণহ্রদ তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি অধ্যুষিত, সেক্টর ওয়ান আর টু’য়ে বাড়ি আর ফাঁকা জমির সংখ্যা সমান সমান, সেক্টর থ্রি-তে সন্ধেবেলা শেয়ালের মুখোমুখি হওয়া এমনকিছু অসম্ভব নয় আর সেক্টর ফোর বা ফাইভ তখনও মুক্ত বন-বালিয়াড়ির পোশাকি নাম।
আমার দুগ্গাপুজোর শুরু এভাবেই। মাদার ডেয়ারির গুমটির অনতিদূরেই নার্সারি স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজত আর কলেজপড়ুয়া পিসির হাত ধরে কাশঘেরা সি এ ব্লকের তেপান্তর পেরোতে পেরোতে বুঝতে পারতাম রোদটা কেমন যেন খুশির দিকে মোড় নিয়েছে। মনে পড়ে সল্টলেকের মুখে পি-এন-বি বাসস্টপে তখন শালের খুঁটির ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া প্রতীক্ষাগার। তার সামনে বিচিত্র শব্দ করে এসে দাঁড়াত বাঘের হুংকার আঁকা ডাকবাক্স-লাল রঙের সরকারি বাস (রুটগুলো যতদূর মনে পড়ে ন নম্বর, এল ফোর্টিন এ/বি/সি) আর মা বাবার মধ্যমণি হয়ে সেই জাদুশকটের সবুজ রেক্সিনে মোড়া সিটে বসে আমি পাড়ি দিতাম বালকচোখে অন্যরকম মানিকতলা বা হাতিবাগানে। এই দুই জায়গায় চলত সাত ভাই চম্পার পুজোর বাজার। হ্যাঁ, আমরা ছিলাম সাত ভাই এক বোন — অন্তত পার্ক স্ট্রীটের মাঝ বরাবর যে অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একশো ষাট বছর হতে চলল, তার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আগের ইন্টারভিউ রাউণ্ডে ফাদার ওয়েভরেইলকে সেরকমই উত্তর দিয়েছিলাম। জেসুইট ফাদার প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার ফাদারের শশব্যস্ত মুখে ‘অল কাজ়িন্স’ শব্দবন্ধ শুনে যারপরনাই স্বস্তি পেয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্সে অবশ্য লক্ষ্মীপুজোর পরেই আমাদের পুজোর ছুটির ইতি ঘটে যেত। খুব খারাপ লাগত যখন শুনতাম আমার ছয় ভাইবোনের ভাইফোঁটা অব্দি ছড়িয়ে আছে কাশবন আর আমাকে সকাল আটটার সময় উঠে পড়তে হচ্ছে স্কুলবাসে। এই যন্ত্রণা সুদে আসলে পুষিয়ে নিতাম একমাসের শীতের ছুটির মোলায়েম কলকাতায় — যখন ওদের নিস্তারের মেয়াদ হতো সাকুল্যে সাতদিন!
ফিরে আসা যাক পুজোর বাজার প্রসঙ্গে। অসংখ্য দোকান চষে সাত ভাই চম্পার জন্য বাজারের পর চলত হাতিবাগানের রাধাবল্লভী, মানিকতলার ঢাকাই পরোটা বা কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের মোগলাই পর্ব। আজকের ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর জিভে-জল-আনা পদগুলো সে সব স্বাদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বাবার একটা ছোট্ট বিলাসিতার কথা। মানিকতলার ছায়া সিনেমা লাগোয়া ঘড়ির দোকানটায় তাঁর হাতঘড়িটা অয়েলিং করতে দিয়ে আমরা পার্শ্ববর্তী ঢাকাই পরোটার আশ্রয়ে ঢুকতাম। এই ম্যাজিকযাপন অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সমাজ বদলাতে বদলাতে বদলে দেয় আমাদের মন। কৈশোর আসব আসব করছে এমন সময় বুঝতে পারলাম হাতিবাগান-মানিকতলা-কলেজস্ট্রিটের সেই ম্যাজিকপরিক্রমার দিন ফুরিয়েছে। সাত ভাই চম্পার কারো কারো রুচির বিশ্বায়ন ঘটছে আর আন্তরিকতার বদলে বিনিময় প্রথার লাভ লোকসানের মেঘ ঘনিয়ে উঠছে অভিভাবকোচিত মাথায় মাথায়। এ হেন আবহে একটি সৎ মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সম্মানার্থে আমার মাতৃদেবী হীনম্মন্যতার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে এই লোকাচারটির ইতি টানলেন। আজ বুঝতে পারি মা-র এই সিদ্ধান্তের মূলে অর্থনৈতিক কারণের থেকেও বড় হয়ে উঠেছিল সহবতবোধের দৈন্যতার সঙ্গে আপস না করার জেদ। ভবিষ্যতে শত অনুকূল পরিস্থিতিতেও এই লৌকিক প্রথাটির পুনর্নবীকরণের ব্যাপারে আমার প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্না মা কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি।
সল্টলেকে আমাদের ব্লকের পুজোয় ঠাকুর হতো প্রথাগত ডাকের সাজের একচালার প্রতিমা। চালচিত্রটা হতো যাকে বলে খুব ডিটেইল্ড, আর আমি ব্যস্ত থাকতাম পঞ্চমীর বিকেলে কাঠের পাটাতনের ওপরে দাঁড়িয়ে ওই চালচিত্রে আঁকা গল্পের পাঠোদ্ধারে। তিনখানা অপার্থিব পিঙ্গলবর্ণ দেবীমুখের থেকে ওই বয়সে আমায় পাশের ব্লকগুলোর দুর্গাপ্রতিমার মানুষী মুখগুলো অনেক বেশি টানত। সেইসময় কয়েকটি ব্লকে জোড়ামঞ্চ বাঁধা হত। একটিতে অধিষ্ঠান করতেন দশভুজা, পাশেরটিতে পুজোর দিনগুলোয় সন্ধে হলেই শুরু হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের ব্লকের বড়দের অবশ্য মত ছিল পুজোটা নিষ্ঠাভরে হতে হবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ থাক বিজয়া দশমীর পরের তিনদিন। এতে লাভ হত আমাদেরই — পুজোর আনন্দ এবং সেইসঙ্গে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার বাহাত্তরঘণ্টাব্যাপী অফিসিয়াল সম্প্রসারণ। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় মহালয়ার সকাল থেকেই পাঠ্যবইয়ের জায়গাটা একটু একটু করে দখল করে নিত সদ্য কিনে রাখা আনন্দমেলা আর শুকতারা। সেই দখলদারি তারপর এমন জায়গায় পৌঁছত যে একসন্ধ্যাব্যাপী কুরুক্ষেত্র না ঘটলে বিসর্জনোত্তর পর্বে পাঠ্যবইদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাই থাকত না। এভাবেই জঙ্গলমহলে গোগোল, বিজয়নগরের হিরে, টিটিচিকোরি, পাগলা সাহেবের কবর, মিতুল নামে পুতুলটি আর ইতি পলাশের মায়া ছড়িয়ে গেল আমাদের কৈশোরে — পেপার ক্রোম্যাটোগ্রাফির ফিল্টার পেপারে মিশকালো বিন্দু থেকে গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়া ভিজে রামধনুর মত।
পাড়ার ফুলছাপ ফ্রক-স্কার্ট রূপকথা দিদিদের ভিক্টোরীয় মিথ সবে ভাঙতে শুরু করেছে এমনই একটা সময়ে সল্টলেকের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে আমরা উঠে এলাম উত্তর কলকাতার প্রান্তিক লোকালয় বরানগরে আমাদের নিজস্ব ঠিকানায় — আর একটি চল্লিশ ঘর পাড়ার কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠার সাক্ষী হতে। খান চল্লিশেক একতলা বাড়ি দিয়ে ঘেরা একটা পুকুরের পাশেই ছোট্ট একফালি জমিতে সামান্য আয়োজনের দুর্গাপুজো। নতুন বাড়ি করে আসা মাষ্টারমশায়, অধ্যাপক বা সমমনস্ক চাকরিজীবীদের কতটুকুই বা সম্বল! তার মধ্যেও একটু বেশি অঙ্কের চাঁদার দায়ভার হাসিমুখে মেনে নিয়ে ছোট পাড়ার একটা নিজস্ব দুর্গাপুজোর অনাবিল সংস্থান। অনেক নিবিড় হল শিউলির গন্ধ আর কার্তিকের হিম। শিখলাম স্থলপদ্মেও কীভাবে ঘনিয়ে ওঠে রঙের বোধন। ঘুচে গেল মহালয়ার সকাল থেকে কোজাগরী লক্ষ্মীপ্রতিমার বিসর্জন পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সমস্ত সংস্রব। কাঁসর পিটিয়ে আলমবাজারের গঙ্গার ঘাটে কলাবৌস্নান থেকে ছোট ম্যাটাডরের আনত হেডলাইটের আলোয় প্রতিমাবিসর্জন — সে এক মিনাকারি লন্ঠনের জাদুপর্ব বটে! নয়ের দশক জুড়ে ছড়িয়ে পড়া উচ্চমাধ্যমিক মুখগুলো কেমন যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে থাকত যে পুজোর পাঁচটা দিন তারা কেউ পাড়া ছেড়ে নড়বে না — অবসেশন এমন জায়গায় পৌঁছল যে একবার টিভি ক্যামেরার বুমের সামনেই ঘটে গেল স্পর্ধিত উচ্চারণ — “এটাই আমাদের কলেজস্কোয়ার, এটাই আমাদের বাবুবাগান” (পঞ্চমীর রাতেই যে শহরের বিখ্যাত মণ্ডপগুলো চষে ফেলে প্রায় দেয়ালে দেয়াল আর কার্নিশে কার্নিশ দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরা হয় সেটা উহ্য রাখা হত)।
আরোপিত পরিমণ্ডল-ই যে কাম্য পরিমণ্ডলের ওপর সর্বনাশের কুঠারাঘাত নামিয়ে আনতে পারে সে বিষয়ে দূরদৃষ্টি থাকা জরুরি। নব্বই দশক জীবিকার প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশান্তরে, পুজোর দায়ভার কেন্দ্রীভূত ও কুক্ষিগত হল মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের মধ্যে। বাড়ির আন্তরিকতায় টইটম্বুর বারোয়ারি আয়োজন কাদের যেন পরিবারিক পুজোয় পাল্টে গেল — বাকিরা পরিণত হল অঞ্জলিদাতা ও প্রসাদপ্রার্থীতে। আস্তে আস্তে দেখলাম পাড়ার বিজয়া সম্মিলনীতে এসে বসা প্রণম্য পায়ের সংখ্যায়ও কেমন ভাটা পড়ছে। পাড়া ছেড়ে না নড়তে চাওয়া একসময়ের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখগুলোই এখন ক্রমশ ছোট হয়ে আসা নিয়মরক্ষার মৃন্ময়ীর দিকে একঝলক তাকিয়ে সপ্তমী পড়তে না পড়তেই বেরিয়ে পড়ে ডেস্টিনেশন ট্যুরে, কোজাগরী পূর্ণিমার ভিনদেশি চাঁদ না দেখে ফেরার নাম করে না। তিলোত্তমা মহানগরী মুখর হয়ে ওঠে হাজার হাজার মুখ ও হাত সম্বলিত দুর্দান্ত সব ভোজবাজিতে। চাঁদার বিলবইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, ভুবনমোহিনী এখন সাজেন কর্পোরেট বিনিয়োগ আর দিনে দিনে মহার্ঘ হতে থাকা স্বর্ণের সত্যি অলঙ্কারে। মা-র লাগানো শিউলি গাছের তলায় কখনো বেখেয়ালে চলে গেলে দেখতে পাই না-কুড়োনো শিউলির সাদা পাপড়িতে বাসা বেঁধেছে জলবর্ণ স্বচ্ছ বিষাদের ক্ষয় আর তার উজ্জ্বল কমলা বোঁটায় লগ্ন হয়ে উঠছে অ্যানিমিক কুমড়োর পাণ্ডুরতা। এই মধ্য চল্লিশে এসে পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো খুলতে খুব ভয় হয়, মনে করিয়ে দেয় ঢাকবাদ্যি রাতটা শেষ হয়ে আসছে — বোঁটা আলগা হয়ে নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে পিতৃপক্ষের শিউলিভরসারা…