গ ল্প
১
মাফিয়া ডনদের জীবনে ধর্মের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। ফাটাকেষ্ট যে কারণে কালীপুজোয় কম্বল বিলি করে, আলতাফ সেই কারণেই ইদের দাওয়াত দেয়। কারণটা প্রথমত জনসংযোগ এবং দ্বিতীয়ত নিজের একটা রবিনহুড ইমেজ তৈরি করা। কিন্তু তার বাইরেও একটা কিছু থাকে। দিনভর চুরি-ডাকাতি-খুন-তোলাবাজি করে বেড়ানো লোকগুলো অজানা কোনও সুতোর টানে সাকার বা নিরাকার ঈশ্বরের সামনে বসে একটা বোঝাপড়া সেরে নিতে চায় হয়তো বা।
আলতাফ নিজের ধর্মের প্রায় সব নিয়ম-কানুন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলত। তবে ধর্মের নামে কসম খেলেও তালাককে ও ঘোর অধর্ম বলে মনে করত। বিশেষ করে তিন তালাকের কথা উঠলেই মাথা গরম হয়ে যেত ওর। তিনবার একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই একটা মেয়েকে নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে এটা আলতাফ সহ্যই করতে পারত না। এই প্রসঙ্গে ওর সাফ জবাব ছিল যে কোন পণ্ডিত কী বোঝাচ্ছে ওর জানার দরকার নেই; ও নিজে যেটা বোঝে তা হল, এতবড় না-ইনসাফি কোনওদিনই ওপরওয়ালা পছন্দ করতে পারেন না। “হিন্দু হো ইয়া মুসলিম, কোই লড়কি কো ঘর সে নিকালনা জুর্ম হ্যায়।” আলতাফের লব্জ ছিল।
লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বম্বে গিয়ে। একটা বাই-লিঙ্গুয়াল ছবি হবে হিন্দি আর বাংলায়। তার বাংলা চিত্রনাট্য লেখানোর জন্য এক প্রোডিউসার আমাকে থাকা-খাওয়া আর পঞ্চাশ হাজার টাকার কড়ারে মাস দুয়েকের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তার ভিতরেই লিখে ফেলতে হবে স্ক্রিপ্ট। ব্যাপার এরকমই সহজ-সরল কিন্তু মুশকিল হত প্রতিদিন সকালে যা লিখতাম, রাতের মিটিঙে সেটাই ক্যানসেল হয়ে যেত। হিন্দিতে যে সিনটা যেভাবে আসছে, বাংলায় নাকি ঠিক সেভাবে জমছে না। আরে মোলো যা! হিন্দি আর বাংলা তো দুটো আলাদা ভাষা শুধু নয় দুটো আলাদা পরিমণ্ডল। সিন বাই সিন একই জিনিস চাই তো আমাকে নিয়ে গিয়ে লেখানোর কী দরকার! দুটো ভাষাই জানে এমন কাউকে দিয়ে কপি-পেস্ট করিয়ে দে!
ঝামেলা না করলে এই যুগে কোথাওই নিজের মত প্রকাশ করা যায় না। এখানেও আলাদা হবে কেন? তাই বলে ঝামেলা করতে তো যাইনি, কাজ করতে গিয়েছিলাম। যে গেস্ট হাউজের একটা ঘরে আমায় রেখেছিল সেটা ভারসোভাতে। সামনেই সমুদ্র। জেলেরা মাছ ধরত আর সেই মাছ অনেকসময় পাড়ে জমা করত বলেই হয়তো খোলা জানলা দিয়ে ভোরবেলা কীরকম একটা মেছো হাওয়া ঘরে ঢুকে আসত। তার অর্ধেকটা মিষ্টি, অর্ধেকটা লোনা।
বম্বের গলা-কাটা কম্পিটিশনের জগতে অবশ্য নুন-মিষ্টির চল ছিল না তত। ঝাঁঝ আর ঝালটাই চলত।
সেদিন রাতে আমাদের ছবির বাংলা ভার্সনের ডিরেক্টর প্রতীকদা আমায় একটা ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটা বার কাম রেস্তোরাঁ, কিন্তু তখন আমি মদ একেবারেই স্পর্শ করতাম না বলে আমার কাছে যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন ছিল।
ঘটনা হল, মাতালরা সাধারণত মদ খায় না এমন কাউকে পাশে বসিয়ে মদ্যপান করে না। কিন্তু আমি হিন্দি গানটা মোটামুটি গাইতাম বলে ফ্রিতে গান শোনার জন্য আমাকে মাঝেসাঝেই বগলদাবা করে এদিক-ওদিক নিয়ে যেত প্রতীকদা। একবার লোখণ্ডওয়ালার সেই ওপেন এয়ার বার কাম রেস্টুরেন্টে বসে আছি। হঠাৎ প্রতীকদাই আড়চোখে একজনকে দেখিয়ে বলল, এই লোকটাকে চিনিস? বিরাট ডন, নাম আলতাফ। কম সে কম তিরিশ-চল্লিশটা মার্ডার করেছে। বম্বেতে ওরকম কত ডন ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কুড়িটা মার্ডার করেছে তো কেউ চল্লিশটা। তাদের ভিতরে একজনকে চিনে লাভটাই বা কী? আমি তাই তত কিছু পাত্তা না দিয়ে মাংসের পকোড়া খেতে খেতে পরের গানটা ধরলাম।
কিন্তু গানের মাঝখানেই আলতাফ সামনে এসে দাঁড়াল আর গান শেষ হতেই আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলল, বড়িয়া আওয়াজ হ্যায়, আর একটা হয়ে যাক। একটু ভয় যে করল না তা নয় কিন্তু ভয় কেটেও গেল একটু বাদে যখন আমার গাওয়া পরের গানটারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে উঠল লোকটা। আরও তিন-চারটে গানের পর যখন ওই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন লোকটা নিজের হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে ওর ভাললাগা পৌঁছে দিতে চাইল আমার কাছে।
দু-তিনদিন পর প্রতীকদা আবার আমায় নিয়ে বেরোবার সময় খানিকটা উৎসাহের ঢঙেই বলল, আলতাফ তোর গান শুনে এমন ফ্যান হয়ে গেছে যে একদিন বসতে চাইছে তোর সঙ্গে। আমার এবার একটু ভয়ই লাগল। রেস্তোরাঁয় আলাপ হয়েছে, গান শুনে বাহবা দিয়েছে, ব্যস, চুকে গেছে! আবার ওই ডনের সঙ্গে বসে খেজুর করতে হবে কেন? রেগে গেলে দেবে চাকু চালিয়ে! প্রতীকদাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি একেবারেই আগ্রহী নই ওই মাফিয়া ডনের সঙ্গে বসতে।
-আরে না, অত ভয়েরও কিছু নেই। আর তাছাড়া চালালে পরে চাকু চালাবে কেন? ওদের কাছে কি ইনস্যাস, একে-ফর্টি সেভেন-এর অভাব আছে? প্রতীকদা হেসে উঠল।
-ঝাঁঝরা করে দেবে একদম?
-চাইলে, দিতেই পারে কিন্তু কেন দেবে না জানিস? তুই যে কারণে পয়সা ছাড়া বম্বেতে মাসের পর মাস পড়ে থেকে স্ক্রিপ্ট লিখবি না।
-মানে?
-মানে, আলতাফ একটা প্রফেশনাল ক্রিমিনাল। আর বম্বেতে প্রতিটা মার্ডারের পিছনে বিশ লাখ-পঁচিশ লাখ টাকার ডিল হয়। এবার যাদের খুন করে আলতাফের পকেটে পাঁচ-সাত লাখ ঢুকবে ও তাদেরই খুন করবে বাবু। তোকে মেরে হাতে গন্ধ করবে কেন?
হয়তো প্রতীকদা ঠিকই বলছিল কিন্তু আমার সত্যি করে ইচ্ছে ছিল না একদম। আলতাফের হাসির ভিতর লুকিয়ে থাকা ওই সোনার দাঁত আমাকে ঘুমের ভিতর ভয় দেখাল একাধিক দিন। কিন্তু ভিনমুলুকে নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কতটাই বা দাম! আলতাফ একে-তাকে দিয়ে বারদুয়েক তাগাদা দিতে প্রতীকদাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমার সঙ্গে ওর মিটিং করাতে। প্রতীকদার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছিলাম। অ্যাড হোক বা ফিচার, ওকে বম্বেতে ছবি বানিয়ে খেতে হবে। কিন্তু আমার মনটাকে কিছু বোঝাতে পারছিলাম না। বুঝতে বা বোঝাতে না পেরেও পৃথিবীর হাজারো কাজ হয়। তারই একটা ধরে নিয়ে আমি শেষমেশ প্রতীকদার সঙ্গে তর্ক করা বন্ধ করে দিলাম। আর একটা শনিবার সন্ধেয় আবারও আলতাফের সঙ্গে দেখা করতে বেরোলাম।
২
আর কোনও হোটেল-ফোটেলে নয়। ওরলির একটা সি-ফেসিং বাড়ির তিনতলায় এবারের মোলাকাত। বম্বে নিজের হেরিটেজ ধরে রেখেছে। তাই ভারতের সবচেয়ে গ্লোবাল শহর হয়েও নিজের ভিতরকার পুরোনো গন্ধটাকে মরতে দেয়নি; কলকাতার মতো সমস্ত ঐতিহ্য ভেঙেচুরে ‘কোমর ছাব্বিশ, বুক ছাব্বিশ, পাছা ছাব্বিশ’ ফ্ল্যাটে বদলে দেয়নি পুরোটা।
আমরা ফ্ল্যাটের দরজায় বেল দিতে যে লোকটা দরজা খুলল, তার উচ্চতা ছ’ফুট ছাড়িয়ে আরও ইঞ্চি তিনেক। একদম পাথর কেটে তৈরি করা চেহারা। দেখলেই বুকটা কেঁপে ওঠে সামান্য। আমাকে আর প্রতীকদাকে যে নিয়ে এসেছিল সেই রীতেশ সালাম দিতেই লোকটা দরজা থেকে সামান্য সরে দাঁড়াল। কিন্তু আমরা ভিতরে ঢুকতেই সে প্রথমে আমাকে, পরে প্রতীকদাকে, জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে নিল একবার।
-আসিফ, এরা সব আমাদের চেনা-পরিচিত। রীতেশ মিনমিন করে বলল।
আসিফ ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, মুঝে আপনা কাম করনে দো।
সেই ‘কাম’ মানে জড়িয়ে ধরে শরীর থাবড়ানোর সময় লোকটার গা থেকে একটা তীব্র সেন্টের গন্ধ আমার নাক বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রায়। আমি দমবন্ধ করেই দাঁড়িয়েছিলাম একরকম। আর আমার পালা শেষ হয়ে গেলে, প্রতীকদা কীভাবে সামলায় ব্যাপারটা দেখছিলাম। আমাকে অবাক করে প্রতীকদা হেসে উঠল আসিফ নামের সেই লোকটির বাহুবন্ধনে।
সিকিওরিটি চেক শেষ করে আসিফ যখন আমাদের ঘরের সোফায় বসার ইঙ্গিত দিয়ে চলে গেল আমি প্রতীকদাকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না যে ও হাসছিল কেন ওইসময়।
-কী করব? লোকটা জড়িয়ে ধরতেই ওর আঙুলের ছোঁয়ায় আমার কাতুকুতু লাগছিল তো।
-সেদিন তো দিব্যি ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে গান গাইছিল। আজ এখানে এত নিরাপত্তার ঘনঘটা কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-খোলা জায়গায় ওর পিছনে তিন-চারটে বডিগার্ড থাকে। খেয়াল করা যায় না খালি চোখে। রীতেশ জবাব দিল।
ঠিক তখনই ধোঁয়া ওঠা কফি আর বেশ কয়েকরকম কেক-পেস্ট্রি-বিস্কিট-ড্রাই ফ্রুটস ট্রে’তে নিয়ে হাজির হল দু’জন।
-সন্ধে নেমে গেছে এখন আবার কফি? প্রতীকদা বলে উঠল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলতাফ ঘরে ঢুকে বলল, রাত একটু গড়াক, তখন যার যা পছন্দ সবই মিলবে।
প্রতীকদা চুপ করে গিয়ে কফিতে চুমুক দিল, আমি কয়েকটা পেস্তা হাতে নিয়ে কুটুসকাটুস করতে শুরু করলাম আর রীতেশ আলতাফের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কী বলল, ঠিক ধরতে পারলাম না।
আমি আলতাফকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম যে ওই পাঁচ ফুট সাত-আট ইঞ্চির লোকটাকে ব্যবসায়ী বা চাকুরিজীবী বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। তেমন কোনও বিশেষত্বই নেই চেহারায় কেবলমাত্র নাকটা একটু বেশি চোখা আর চোখদুটো একটু ধারালো। ওর পাশে ওই আসিফ দাঁড়ালে সবার নজর আসিফের দিকেই যাবে। কিন্তু দুনিয়ায় শুধু চেহারা দিয়ে কবে কী হয়েছে যে আজ হবে?
খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, আলতাফ বলে উঠল, সিঙ্গার সাব আপনি রাইটার ভি আছেন জানার সাথে সাথে আমার মন হল কি আপনাকে দিয়ে আমিও একটা স্ক্রিপ্ট লেখাই। বহুদিন ধরে ইচ্ছা একটা ফিল্ম বানানোর। এটাও বাংলা আর হিন্দি দোনো মে হি হবে। আপনি বাংলাটা লিখবেন।
-ডিরেকশন আমি দেব তো আলতাফ ভাই? প্রতীকদা বলে উঠল।
-সেটা আমি এখনও ফাইনাল করিনি। আলতাফ ঝামা ঘষে দিল তৎক্ষণাৎ।
প্রতীকদা মাথা নিচু করে কেকে কামড় দিল আর আমাকে খানিকটা অবাক করেই আলতাফ বলে উঠল, আমার সিনেমার নাম হবে, ‘তালাক’। খুব খারাপ জিনিস আছে। আপনি বোঝেন তো রাইটার সাব?
আমি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললাম, বোঝালে বুঝব না তা নয় কিন্তু আমার মনে হয় এই সাবজেক্টটা আপনার কমিউনিটির কেউ আমার চেয়ে অনেক ভাল লিখতে পারবেন।
-কিঁউ? তালাক কি শুধু মুসলিমরাই দেয় নাকি? হিন্দুরা দেয় না? তালাকের জন্য হিন্দু মেয়েদের জীবন নষ্ট হয়ে যায় না?
-আমি আসলে এই ব্যাপারটা ভাল জানি না। একরকম সারেন্ডার করে দিলাম ।
আলতাফ দমে না গিয়ে বলল, জানতে হবে। আপনার সেদিনের গান শুনে আমি ফিদা হয়ে গেছি। এত দরদ দিয়ে গাইছিলেন আপনি। আমার স্টোরিটাও খুব দরদ দিয়ে লিখতে হবে। আর এর দুটো পার্ট আছে। প্রথমটা শুনলে তবেই পরেরটা বুঝতে পারবেন। তো পহেলে আপ মেরা কিসসা সুনিয়ে। ফির, বাকি বাত।
রীতেশ হেসে উঠল কথাটা শুনে। প্রতীকদা বোকার মতো সেই হাসিতে যোগ দিল। আমি চুপ করে রইলাম। আলতাফের লোকেরা ট্রে’তে মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। ওরা যখন সোডা আর বরফ দিয়ে মদ বানাচ্ছে, আলতাফ একটা লম্বা সিগারেট ধরিয়ে বলল, গল্প শুরু করার আগে একটা গান হয়ে যাবে নাকি?
প্রতীকদা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। আমি সুব্রত চ্যাটার্জীর একটা পুরোনো হিন্দি গান ধরলাম।
৩
গানটা শেষ হতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল আলতাফ, আপনার সুব্রতবাবুর গান ভাল লাগে?
আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
-শুধু বাঙ্গাল নয়, অল ইন্ডিয়া ফেমাস শকস হ্যায় উও। এই গল্পে উনিও আসবেন। বাট ফার্স্ট আমার কথা শুনুন।
আলতাফ নিজের জীবনকাহিনি শুরু করল, হুইস্কিতে প্রথম চুমুকটা দিয়ে।
গল্পটা শুনতে শুনতে কীরকম অন্য একটা জগতে চলে যাচ্ছিলাম। সেই যেখানে সরু সরু রাস্তা, সন্ধেবেলা নানারকম আওয়াজ শোনা যায়, মেহেন্দি করা হাত সুর্মা করা চোখের নজরে পড়ে যায়; যেখানে লোহার শিকে গাঁথা থাকে মাংস আর ঝুট-ঝামেলায় গাঁথা থাকে জীবন, যেখানে বর্ষা হলেই নোংরা জল ঢুকে আসে কিন্তু গাড়ি ঢুকতে পারে না, যেখানে গোটা মহল্লায় গ্র্যাজুয়েট একজন বা দু’জন কিন্তু জেলখাটা আসামি অজস্র, সেখানেই বেড়ে উঠেছিল আলতাফ।
ওর বাবা আলতাফের মাকে তালাক দিয়ে ফের শাদি করেছিল। আলতাফরা পাঁচ ভাইবোন কীভাবে বেঁচে আছে তার খোঁজটুকু পর্যন্ত নেওয়ার দরকার মনে করেনি। একবেলা খেয়ে, দু’বেলা না খেয়ে দিন কাটত ওদের আর মনে মনে একটা তীব্র জ্বালায় ভুগত আলতাফ যখন দেখত ওর সমবয়সী কোনও বাচ্চা, নিজের বাবার আদর পাচ্ছে।
সময় থেমে থাকে না, সে সবাইকেই সেই মোড়ে এনে দাঁড় করায় যেখানে আধপেটা খেয়ে থাকা লোকের ভিতরেও সেই ভুখ জেগে ওঠে যা রুটি-মাংস কিংবা ভাত-মাছে মেটে না। আলতাফ যেহেতু খিদে দিয়েই দুনিয়া মাপত তাই সেই ভুখটাকেই ও ‘প্রেম’ বলে ধরে নিয়েছিল। আর সেই প্রেম ওর জেগে উঠেছিল ওদেরই মহল্লার লাগোয়া এলাকার একটা মেয়ের প্রতি। ছিপছিপে চেহারার, লম্বা বেণী করা সেই ‘মারাঠি মুলগি’র জন্য আলতাফের ভিতরটা ছটফট করত। মন যদি একটা মুরগি হত তাহলে আলতাফ কবে সেটাকে গলা মটকে মেরে দিত। কিন্তু মন তো হাজারবার মারার পরও কোঁকর-কোঁ করে ওঠে, তাকে নিয়ে কী করা যায়?
মেয়েটা হিন্দু ছিল। কিন্তু তাতে কি? প্রেম কি হিন্দু মুসলমান মানে? আলতাফের যে মন, দিন নেই, রাত নেই ওই মেয়েটার কথাই ভাবত সেও তো ধর্মে, ‘প্রেমিক’ কেবল। ব্যবহারিক কোনও ধর্মের চাপ সে সহ্য করবে কেন?
মেয়েটা যখন ছাদে কাপড় শুকোতে দিত, আলতাফ ওই ভেজা কাপড়ের গন্ধে গন্ধে গিয়ে দাঁড়াত গলির মোড়ে। ভেজা কাপড়ের গন্ধটা কী করে চিনত, আলতাফ আজও বুঝতে পারে না। কিন্তু সেই দিনগুলোয় ওই সামনের বড় দোকানের ঘড়িটায় ঢং ঢং করে বারোটা বাজলেই নাকে একটা সুবাস লাগত এসে আর পেট পর্যন্ত কেমন মোচড় দিয়ে উঠত।
একটা সময়ের পর আলতাফকে দেখলে মেয়েটা হাসত। আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করত। সাইকেল নিয়ে আলতাফ ওর পিছনে ধাওয়া করছে দেখে একদিন একটা টাঙায় উঠে পড়ল মেয়েটা আর হঠাৎ করে টাঙাটা থামিয়ে আলতাফ যে গোলাপটা ওকে দেবে বলে ছুটে আসছিল সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল।
সেদিন ভেবেছিল যে মেয়েটা ওকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু তারপর কয়েকদিন মেয়েটাকে দেখতে পেল না ও। আর একে-ওকে খোঁজ করে জানল মেয়েটার ফ্যামিলি পুনায় বেড়াতে গেছে। ওই পুনা থেকেই মেয়েটার বিয়ে দিয়ে ফিরে এল ওরা। স্তম্ভিত আলতাফ দেখল, যে রাস্তা ধরে ও মেয়েটার পিছু নিয়েছে সেই রাস্তা ধরেই একমাথা সিঁদুর নিয়ে নিজের বরের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। আর তার কয়েকদিন পর নাসিক না ঔরঙ্গাবাদ কোথায় একটা চলে গেল সে বরের চাকরির সুবাদে। এর-তার মুখে সবই শুনল আলতাফ।
আলতাফ চোখের সামনে খুন, রাহাজানি, আরও অনেক কিছুই দেখেছে কিন্তু বুকের ভিতর এই অসহ্য যন্ত্রণা যেটায় রক্তটা বাইরে না এসে আরও ভেতরে ঢুকে যায়, সেটাকে কী বলে ওর জানা ছিল না। ভালবাসা কী এরকমই হয়? আলতাফ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করত। উত্তর পেত না। বদলে ওর মনে হত যে ওকে স্ট্যাব করে যাচ্ছে দুপুরের রোদ্দুর, স্ট্যাব করে যাচ্ছে সমুদ্রের বাতাস, রাতের বৃষ্টি, সন্ধের হাওয়া।
আলতাফ পাগল হয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুদের কেউ ওকে বেশ্যাখানায় নিয়ে গেছে, ও একটুও আনন্দ পায়নি; দরগায় নিয়ে গেছে, ও এতটুকু শান্তি পায়নি। ভিতর থেকে প্রাণটা বেরিয়ে না গেলে, এই যন্ত্রণাও বেরোবে না, এমনই ভেবে নিয়েছিল। আর এই মরতে হবে ভেবে নেওয়ার পরই ওর মাথায় আসে যে ওই মেয়েটা আর তার হাজব্যান্ডকে মেরে মরলে কেমন হয়? ওরা কবে আবার আসবে বম্বে? ততদিনে কি মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবে? এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে একদিন বার থেকে প্রচুর মদ খেয়ে বেরিয়ে রাস্তা ক্রস করার সময় একটা গাড়ির ধাক্কা খায়। গাড়িটা ওকে একেবারে শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
অনেক পরে জেনেছিল যে সেই গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেলেও পরের গাড়িটা থেমেছিল। মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক ভদ্রমহিলা ড্রাইভারের সাহায্যে আলতাফকে তুলে নিয়েছিলেন গাড়িতে। নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। প্রায় দেড়মাস আলতাফ হাসপাতালে ছিল। ষোলোটা ফ্র্যাকচার হয়েছিল ওর। অতদিন হাসপাতালে থেকেও সারেনি আলতাফ, সেই ভদ্রমহিলা তারপরও ওকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন তিনমাস। মায়ের মমতায় সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। কিংবা মায়ের থেকে একটু বেশিই। কারণ আলতাফের নিজের মা তো ওর খোঁজ নিতেও আসতে পারেনি। সংসারের চাপে সেটা হয়তো স্বাভাবিকই ছিল। অবশ্য আলতাফ খুব বেশি মিসও করেনি নিজের মাকে। কেন করবে? জয়শ্রীদিই যে ততদিনে ওর মা, দিদি, ভগবান, আল্লা সব হয়ে উঠেছে। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো একটা সময়কে ঝর্নার জলে বদলে দিচ্ছে একাই।
কিন্তু জয়শ্রীদির নিজের জীবনে দুঃখের অন্ত ছিল না। ওঁর বাড়িতে থাকতে থাকতে সেই দুঃখের সঙ্গেও পরিচয় ঘটল আলতাফের। তিনটে মেয়ে জয়শ্রীদির। নীলা, লীলা আর শীলা। কতই বা বয়স, নয়, সাত আর চার। ফুলের মতো দেখতে মেয়েগুলো কিন্তু ওদের বাবা, সেই সময়ের ভারত-বিখ্যাত গায়ক সুব্রত চ্যাটার্জীর চোখে ফুল নয় কাঁটা। ছেলে হয়নি বলে জয়শ্রীদিকে অকথ্য গালিগালাজ করত লোকটা। গোরেগাঁও-এর সেই ফ্ল্যাটের একটা ঘরে শুয়ে সেই গালি শুনতে পেত আলতাফও।
-ছেলে ধরে এনেছ নাকি রাস্তা থেকে? ছেলে তো না, এ তো দেখছি লোক। ছেলের জন্ম দিতে পারোনি বলে যেখান থেকে যা পাচ্ছো তুলে আনছ? আলতাফকে দেখিয়ে জয়শ্রীদিকে বলেছিল লোকটা।
আলতাফের মনে হয়েছিল উঠে দাঁড়িয়ে গলা টিপে ধরে লোকটার। কিন্তু তখন তো ওর সেই শক্তি নেই। মুখ বুজে সহ্য করেছিল তাই।
লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর মেয়েগুলো কান্না জুড়ে দিত, আর জয়শ্রীদি বলত, বাবা একটুও ভালবাসে না তবু মেয়েদের মন তো বাপের জন্য কাঁদে তাই না? যদি আমাকে গালাগালি করার জন্যেও প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফিরত, তাহলে শান্তি পেতাম।
লোকটাকে একদম পছন্দ হত না আলতাফের। কী রুড কথাবার্তা। জয়শ্রীদি তো দূর, নিজের একটা মেয়ে কোলে বসতে এলে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। মাসের মধ্যে তিন সপ্তাহ তো দেশ-বিদেশ করে বেড়ায় গানের ট্যুরে, যে কয়েকটা দিন বাড়িতে থাকে, একটু ভালবাসতে পারে না বাড়ির লোকগুলোকে? এত বড় সেলিব্রিটি কিন্তু মনটা বম্বের ট্যাক্সির মতো ছোট। আলতাফ ভাবত।
উল্টোদিকে জয়শ্রীদির নিজের দুর্দান্ত গলা, কিন্তু গানের কেরিয়ার ভুলে গিয়ে এই লোকটার জন্য জীবন উৎসর্গ করে বসে আছে। এই লোকটার ছেলের বাসনা পূর্ণ করবে বলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রেগন্যান্ট হয়েছে তিনবারের বার, আর তারপরও ছেলে হয়নি বলে সুব্রত চ্যাটার্জীর খিস্তি-খামারি খাচ্ছে। দিনরাত খেটে মানুষ করছে মেয়েগুলোকে। পিয়ানোর ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছে, গান শেখাচ্ছে, পড়তে বসাচ্ছে। তার মধ্যে, কে জানে কেন, রাস্তায় পড়ে থাকা আলতাফকে জীবন বাজি রেখে জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে।
-তুমি শেষে আমার জন্য তোমার হাতের বালা দুটো বিক্রি করে দিলে? আলতাফ একদিন আর থাকতে না পেরে বলল।
-কে বলল, বিক্রি করে দিয়েছি?
-তোমার মেয়ে নীলাই, লীলাকে বলছিল। আমি শুনতে পেয়েছি।
-ওরা বাচ্চা, কান শুনতে ধান শুনেছে। আমি বিক্রি করিনি মোটেই, বন্ধক রেখেছি। সময় হলেই ছাড়িয়ে নেব।
-কিন্তু কেন দিদি? আমি তোমার কে যে আমার জন্য এত করছ? আলতাফের গলা বুজে এসেছিল।
জয়শ্রীদিও কেঁদে ফেলেছিল জবাব দিতে গিয়ে, আমি জানি না তুই আমার কে। কিন্তু রাস্তা থেকে তোকে তুলে আনার পর যখন আমার কোলে তোর মাথাটা রেখেছিলাম আর আমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছিল রক্তে তখন তুই আমার দিকে তাকিয়ে আধো অচেতনে বলে উঠেছিলি, “মুঝে বাচাও”। আর সেই সময় থেকে আমার মনে হতে থাকল যে তুই আমার জন্ম না নেওয়া ছেলে। কেন মনে হতে থাকল জানিস? কয়েকদিন আগেই আমি আবার কনসিভ করেছিলাম আর ডাক্তাররা আমার মত না নিয়েই অ্যাবর্ট করে দিয়েছিল বাচ্চাটাকে। আবার জন্ম দিতে গেলে আমি শিওর মরে যেতাম তাই। তারপরই তোকে রাস্তায় পেলাম আর তুই ওই কথাটা বললি; বিশ্বাস কর, তখন থেকে আমার মনে হতে থাকল যে তুইই সে। আমাকে কাতর গলায় বলছে, বাঁচতে চাই। এবার আমার পেটের ভিতর যে ছিল তাকে তো আমি বাঁচাতে পারিনি, তোকে মরতে দিতাম কী করে ?
আলতাফ আর কিছু বলতে পারেনি উত্তরে। শুধু জয়শ্রীদির পায়ে নিজের মাথাটা রেখেছিল। আর জয়শ্রীদি ওর মাথাটা তুলে ধরে কপালে একটা চুমো খেয়ে বলেছিল, বেঁচে থাক।
শরীর সারতে আলতাফ যখন নিজের মহল্লায় ফিরে গেছে, পোর্ট এলাকার এক ছোট মাফিয়ার আন্ডারে কাজ শুরু করেছে, তখন জয়শ্রীদি একদিন পৃথিবীর থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। আলতাফ ওর এক বন্ধু মারফৎ খবর পেল যে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি আছে জয়শ্রীদি।
খবরটা পেয়েই আলতাফ ছুটে গেল হাসপাতালে।
-তুমি মেয়েগুলোকে রেখে, আমাকে রেখে, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে? তোমার লজ্জা করল না একবারও?
-করেছিল। কিন্তু যখন মেয়েদের স্কুলের ফিজ দিতে পারছিলাম না আর ওদের প্রিন্সিপাল ফোন করছিল, তখন আরও লজ্জা করছিল। ভেবেছিলাম আমি মরে গেলে হয়তো ওদের বাবা ওদের দায়িত্ব নেবে। আর তখন ওর নতুন বউও বাধা দিতে পারবে না।
-দাঁড়াও, দাঁড়াও। সুব্রত চ্যাটার্জী আবার বিয়ে করেছে?
-হ্যাঁ। ইন্ডাস্ট্রির উঠতি সিঙ্গার স্বপ্না চাওলাকে। আর বিয়ে করার পরই আমাকে সংসার খরচের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি। আগেও যে খুব বেশি দিত তা নয়, কিন্তু এখন একেবারে স্টপ। এমনকী এই ফ্ল্যাটের ভাড়া পর্যন্ত আটকে দিয়েছে। আর দশদিন পর আমাকে নীলা, লীলা আর শীলাকে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করব না তো কে করবে ?
-কী বকোয়াস করছ তুমি? তোমাকে ডিভোর্স না করে চ্যাটার্জী ফিরসে শাদি করল কী করে? তুমি পুলিশে নালিশ করলে, ওর তো হাতে হাতকড়া লাগবে।
-পুলিশ, আদালত কোথাও গিয়েই কিছু করা যাবে না। আইন যেমন আছে, আইনের ফাঁকও তো আছে। সুব্রত চ্যাটার্জী ধর্ম পালটে বিয়ে করেছে। ও এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
-মতলব?
-মতলব, সুব্রত চ্যাটার্জী মুসলিম হয়ে এই বিয়েটা করেছে।
-উসনে সচমুচ ইসলাম কবুল কিয়া?
-না। মিথ্যেমিথ্যি মুসলিম হওয়ার নাটক করছে আমাকে আর আমার মেয়েগুলোকে না খাইয়ে মারবে বলে। বম্বেরই একটা ছোট মসজিদে গিয়ে কলমা পড়েছে, তারপর উকিলকে টাকা খাইয়ে এফিডেভিট করে ‘সারোয়ার হুসেন’ হয়েছে। এবার সেই ব্যাপারটা কোর্টের খবরাখবর ছাপা হয় এমন একটা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছে। সেই কাগজটা কেউই পড়ে না, কিন্তু ছাপা তো হয়। এবার কাগজটার কয়েকটা কপি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে লোকটা। ও দিব্যি আগের মতো সুব্রত চ্যাটার্জী হয়েই জীবন কাটাবে কিন্তু আমি কোনও লিগাল স্টেপ নিতে গেলেই নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে, একাধিক বিয়ে জাস্টিফাই করবে।
-রোক্কে রোক্কে। এত কথা তুমি জানলে কীভাবে?
-সুব্রত নিজেই একদিন স্বপ্নাকে নিয়ে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল, আর আমার মায়ের দেওয়া গয়নাগুলো সব আলমারি থেকে জবরদস্তি বের করে নিতে নিতে বলল, যে মেয়ে ছেলে বিয়োতে পারে না, তার গয়না পরা মানায় না। এগুলো আমার নতুন বেগম পরবে। আমি বাধা দিতে গেলাম ওকে, তখন…
-চুপ করে গেলে কেন, বলো।
-আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘তালাক, তালাক, তালাক’। জয়শ্রীদি চিৎকার করে উঠল।
-হিন্দু আউরতকো তালাক দে দিয়া? ওয়া রে ওয়া! বলতে বলতে আলতাফের চোখের সামনে অজস্র মুখ ভেসে উঠল। প্রথম মুখটাই ওর মায়ের। তালাক পেয়ে যাকে পাঁচটা বাচ্চার হাত ধরে রাস্তায় নামতে হয়েছিল। তারপর মনে পড়ল ওর ফুফির কথা, যাকে বাজারে পাঠিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোক। আর সে গেটের বাইরে বেরোতেই দোতলা থেকে চিৎকার করে উঠেছিল তার স্বামী, ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বলে। গেট পেরিয়ে আর ভিতরে ঢুকতে পারেনি সেই মহিলা। কিম্বা ওর সেই চাচাতো বোন যাকে হানিমুনে নিয়ে গিয়ে তালাক দেওয়া হয়েছিল। অজস্র উদাহরণ। আলতাফ ছোট থেকে দেখে এসেছে। অথচ হাজি আলির দরগায় বসে এক সুফি গায়ক ওকে বুঝিয়েছিলেন, তালাকের সঙ্গে ওর ধর্মের কোনও অচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। যে ধর্মে, মায়ের পা’কে মানুষের জান্নাত বলা হয়েছে সেই ধর্মের নাম করে মেয়েদের অত্যাচার করাটাই তো সবচেয়ে বড় গুনাহ। আলতাফ ওর অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিল, তালাক আসলে কতগুলো স্বার্থান্বেষী শয়তানের নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার একটা ধান্দা।
কিন্তু এই ধান্দা কতদিন চলতে পারে? হিন্দুধর্মেও তো সতীদাহ ছিল, মেয়েরা বিধবা হয়ে গেলে তাদের স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া হত। সেই নারকীয় প্রথা বন্ধ হয়নি? সাহেবরা এসে কোন একটা বাঙালির হেল্প নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই বাঙালির নামটা জয়শ্রীদির থেকে শুনেছিল আলতাফ। কিন্তু মনে রাখতে পারেনি। আচ্ছা, ও নিজে এমন কিছু করতে পারে না যাতে জয়শ্রীদি আর বাচ্চারা ওর নামটা মনে রাখে সারাজীবন?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ততদিনে বম্বের অলিগলি মোটামুটি সড়গড় হয়ে গেছে আলতাফের। খুঁজতে খুঁজতে বান্দ্রার লিংক রোডের সেই ফ্ল্যাটেরও খোঁজ পেয়ে গেল যেখানে সুব্রত চ্যাটার্জী ওরফে সারোয়ার হুসেন নিজের নতুন বউ বা বেগমের সঙ্গে লিভ-ইন করছেন। হাতের পিস্তলটা দেখে দারোয়ান নিঃশব্দে আলতাফ আর ওর দুই স্যাঙাতকে ফলো করল আর নিজেই নক করল তিনতলা ফ্ল্যাটের দরজায়। সিল্কের লুঙ্গি আর হাত কাটা গেঞ্জি পরে তখন মদে ডুবে আছেন গায়ক। দারোয়ানের গলার আওয়াজ শুনে দরজা ফাঁক করতেই, ওকে একটা ঠেলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল আলতাফ আর ওর সঙ্গীরা?
-অ্যাই তোমরা কে? গেট আউট অর আই উইল কল দ্য পুলিস। সুব্রত চ্যাটার্জী চেঁচিয়ে উঠল।
-পুলিশ ডাকার আগে তোর গলার নলিটা কেটে দেব। লজ্জা করে না শুয়োরের বাচ্চা, আমার মজহবকে ইউজ করে নিজের খোয়াইশ মেটাচ্ছিস? তুই কী ভেবেছিস, পার পেয়ে যাবি?
-ওহ তুই সেই লোকটা? তোর সাথে জয়শ্রীর কী সম্পর্ক? কেন তুলে এনেছিল তোকে রাস্তা থেকে? তোর সঙ্গে শোয়ার জন্য নিশ্চয়ই। যা এখন শো গিয়ে ওর সঙ্গে। আমি ছেড়ে দিয়েছি ওকে।
কথাগুলো শেষ হতেই আলতাফ ঠাটিয়ে চড় মারল সুব্রত চ্যাটার্জীকে। লোকটা মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
-তোর গান, তোর সুর, সব মিথ্যা। যে নিজের মেয়েদের খেতে দেয় না, নিজের বউকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়, সে আবার শিল্পী? নে, আমার দিদির গয়নাগুলো বের করে দে আগে।
-কীসের গয়না? কার গয়না? সুব্রত নিচু গলায় বলল।
-বুঝতে পারছিস না, নাকি দিতে চাইছিস না? তা তুই তো এখন মুসলমান হয়েছিস, আমাদের মজহবে চুরির কী শাস্তি জানিস তো? বলতে বলতে আলতাফ ওর প্যান্টের পকেট থেকে লম্বা চাকুটা বের করল।
সুব্রত চ্যাটার্জী ভয় পাওয়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল, না, প্লিজ আমার হাত কেটে দিও না।
ওর চিৎকারে কি না কে জানে, এই এতক্ষণে একটা স্লিভলেস নাইটি পরে স্বপ্না চাওলা ভিতরের ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়ে কাঁপতে শুরু করল।
আলতাফ খেয়াল করল যে ভদ্রমহিলা বেশ ভালরকম প্রেগন্যান্ট। বিয়ে না করে সুব্রত চ্যাটার্জীর হয়তো উপায় ছিল না। কিন্তু জয়শ্রীদি এই ব্যাপারটা খেয়াল করেনি কেন? নাকি আলতাফকে বলতে লজ্জা পেয়েছে?
-আমার দিদির জীবনটা নষ্ট করে এখানে তুই আবার নতুন সংসার বানাবি? আলতাফ চাকুটা উঁচু করে এগিয়ে গেল একটু।
-প্লিজ ওকে মেরো না। স্বপ্না ন্যাকা গলায় বলে উঠল।
-আপনি ভিতরে যান। আর এখন থেকে বাইরের পুরুষমানুষের সামনে পর্দা করবেন। মজহব চেঞ্জ করেছেন না?
-আমি কিছু চেঞ্জ করিনি। ও কী করেছে, জানি না। স্বপ্না বলে উঠল।
-কী রে তোর নতুন বেগম কী বলছে?
-ওর কথা বাদ দাও আলতাফ। তুমি যা বলবে, আমি তাই করব। শুধু আমার হাতটা কেটে দিও না। আমি এটা দিয়ে মাইক ধরে গাই। ফাংশানে ফাংশানে।
-সেই গান কে শোনে? আওয়াজ তো একটা দিল থেকে আর একটা দিলে যায়। কিন্তু তোর নিজেরই তো দিল নেই, তুই একটা পাত্থরদিল । তোর মতো লোকের কি গান গাওয়া উচিৎ? শোন, শুধু গয়নাগুলো ফেরত দিলেই হবে না। তুই যে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিস, ওটার মতো ভাড়া নিসনি, সে খবর আমি নিয়েই এসেছি। এবার এই ফ্ল্যাট আর নিজের সম্পত্তির অর্ধেক জয়শ্রীদির নামে লিখে দিয়ে বম্বে থেকে চলে যাবি। যে বম্বেতে আমি থাকি, যেখানে জয়শ্রীদি আছে, সেখানে তোর কোনও জায়গা নেই। ইন্ডিয়ার যেখানে খুশি চলে যা কিন্তু এই শহরে থাকবি না। আর তুই হিন্দু হয়ে না মুসলমান হয়ে বাঁচবি, আমার দেখার দরকার নেই। আমি শুধু একটা জিনিস জানি তুই ইনসান হতে পারবি না। শয়তান হয়েই থাকবি।
সুব্রত চ্যাটার্জী থরথর করে কাঁপতে লাগল, আমার এখন কত কাজ এখানে…
-ওসব বুঝি না। পনেরো দিনের ভিতর বম্বে ছেড়ে চলে যাবি। নইলে… আর শোন আমি যা বলে গেলাম সেটা পুলিস কমিশনারকেও ফোন করে বলতে পারিস।
ওদের কথার ভিতরেই স্বপ্না এসে জয়শ্রীদির সব গয়নাগুলো দিয়ে গেল। সেগুলো নিজের পাঞ্জাবির ভিতর ভরে নিয়ে আলতাফ অ্যাবাউট টার্ন করল।
পরের ঘটনা বেশ নাটকীয়। পুলিশেও ফোন গেল না। মিলিটারিতেও না। উল্টে মাসখানেকের মধ্যে বম্বে থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সুব্রত চ্যাটার্জী কলকাতা চলে গেল। মাঝেমধ্যে বম্বে আসত গান রেকর্ডিঙের জন্য, কিন্ত দু-তিনদিনের বেশি থাকত না কখনই। ‘বম্বে থেকে কেন চলে গেলেন’, এই প্রশ্ন কোনও রিপোর্টার জিজ্ঞেস করলেই, সুব্রত চ্যাটার্জীর বাঁধা উত্তর ছিল, “বম্বের অ্যাটমোস্ফিয়ারটা ঠিক স্যুট করল না।”
আলতাফ কথাটা শুনলেই হাসত। চ্যাটার্জী চলে যাওয়ার আগে নিজের ফ্ল্যাট জয়শ্রীদির নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিল, তিন মেয়ের নামে পাঁচ করে আর জয়শ্রীদির নামে দশ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিটও করে গিয়েছিল। জয়শ্রীদি একটা চাকরিতে জয়েন করেছিল সুব্রত চ্যাটার্জী বম্বে ছাড়ার কয়েকদিন পরেই। সেখান থেকে আরও ভাল একটা চাকরিতে। সেই চাকরিগুলো পাওয়ার পিছনে আলতাফের ভূমিকা জয়শ্রীদি নিজেও কখনও জানতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিদির মেয়েরাও দাঁড়িয়ে গেছে প্রত্যেকেই। একজন পাইলট হয়েছে, একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন প্রফেসর। সুব্রত চ্যাটার্জীর মৃত্যুর পর কোন একটা মিডিয়া থেকে ওদের তিনজনের প্রতিক্রিয়া নিতে এসেছিল। তিন বোন একটাই কথা বলেছিল, উই ডোণ্ট রিমেমবার হিম।
-সেই সুব্রত চ্যাটার্জীর গান আমি গাইছিলাম যখন, আপনি বাধা দিলেন না তো? গল্পটা শেষ হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আলতাফ হাসতে হাসতে উত্তর দিল, আমার বয়স এখন ফিফটি সেভেন। আর এই বয়সে আসতে আসতে আমি কী বুঝেছি জানো? শয়তানের ভেতরেও একটা ভগবান বাস করে আর গানটা সেই গায়। গানের সঙ্গে শত্রুতা কীসের? ইন ফ্যাক্ট কারও সঙ্গেই কীসের শত্রুতা? ভাববে এই কথা আমি বলছি, একটা মার্ডারার! কিন্তু মার্ডার করেছি বলেই বলতে পারছি, মানুষ মারায় কোনও সুখ নেই। ধান্দা ভেবে করি। আসলি সুখ পেতাম যদি জয়শ্রীদির মতো করে মানুষকে বাঁচাতে পারতাম।
-জয়শ্রী ম্যাডাম আছেন তো এখনও?
-জরুর। এই সিনেমাটা তো ওকে ট্রিবিউট দেব বলেই বানাব। স্টোরিটা ইন্টারেস্টিং করে লিখে আনো তো দেখি। কিছু অ্যাডভান্স দেব?
-না, আগে খসড়াটা অন্তত করি, তারপর। আমি জবাব দিলাম ।
সেই খসড়া শেষ হওয়ার আগেই রাইভাল গ্যাঙের সাতটা বুলেট আলতাফকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল একদিন কোলাবার বিশাল বাজারের সামনে। ওর বডিগার্ডরা আন্দাজই পায়নি। গুলি যারা চালিয়েছিল তারা বাইকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল পলকে। মরবার আগে আলতাফ কী বলেছিল জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল একদম বিনা নোটিসে জীবনকে তালাক দিয়ে চলে যাওয়ার আগে আলতাফ বোধহয় ওর জয়শ্রীদিকে একবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিল।