Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গ ল্প

ধ্রু ব   মু খো পা ধ্যা য়

মুখোশ

এক সময়, রাত্রে মায়ের পাশে শুয়েও হ্যারিকেন নেভাতে পারতাম না। উপর থেকে গাছের পাতা পড়লে মনে হত প্রেতাত্মা কিছু একটা বলতে চায়ছে। যাকগে, এখন আর সে সব নেই। ভূতকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টে ভূত আমাকে দেখলে হয়তো ভয়ে পালাবে! ভাববে, ‘বাবা! এরকম শরীর থাকার চেয়ে অশরীরী হওয়া ঢের ভালো’। বাবা বলে, “ভয় তো মানুষকে রে। ভূত কি আর মানুষের সঙ্গে পারে!” আগে না বুঝলেও এতদিনে সেটা বেশ বুঝেছি। আসলে বর্তমানের আঁকাবাঁকা সরু গলি দিয়ে যখন ভবিষ্যতের গাঢ় অন্ধকারটা একেবারে সোজা এসে চোখের মণিতে ঠেকে, তখন আর আলাদা করে ভূত বলে কিছু থাকে না। মানুষ, জীবন, সময় সমস্ত কিছুই তখন ভূত বনে যায়। পড়ে থাকে খালি একখান মুখোশ।

রাহুলকে চোখের সামনে দেখতেই, সেই ভূতের ভয়টাই আমি আবার পেলাম। মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত। আমি তাই আর নিজেকে মিকিমাউস বানাতে দেরি করিনি। চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে বিয়ে বাড়ির সাজার ঘরে গিয়ে চটপট খোলস সহ মুখোশটা পরে, একেবারে হাসি মুখের মিকিমাউস। 

চার্লি চ্যাপলিনের তখনও অনেক বাকি। দাড়ি কামানো মুখে, সাদা রং করে, ভ্রুর উপরে পাহাড়-পর্বতের মত উঁচু করে ভ্রু আঁকতে সময় তো লাগবেই। লুঙ্গি আর ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জির শরীরে ধীরে ধীরে একটা ইস্তিরি করা কালো প্যান্ট, সাদা জামা, তার উপর আবার বাহারি নীল রঙের টাই চড়তে চড়তে যখন কাঁচা-পাকা চুলের মাথায় কালো টুপিটা পরল ততক্ষণে আমার ভিতরটা বেশ শান্ত হয়ে গিয়েছে। কেন জানিনা বাইরে বেরিয়ে আবার দেখতে ইচ্ছে করছিল রাহুলকে। ওকে এক ঝলক দেখেই বুঝেছিলাম ওর মুখোশটা বেশ শক্তপোক্ত। মুখে বয়সের লেশ মাত্র নেই। তাই মুখোশের আড়ালের মুখটা দেখতে, আর তর সইছিল না।   

মুখোশ ভারী অদ্ভুত জিনিস। মুখ যার গরম তার। তবে আমার ব্যাপারটা অন্য। গরম লাগলেও, পরে থাকতেই হচ্ছে। আসলে খিদের জ্বালার থেকে গরমের জ্বালা অনেক আরামের। আগে জানলে এই বিয়ে বাড়িটাতে আমি আসতাম না। কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন বড্ড জোর করল। তাছাড়া অঙ্কের হিসাবটাও ছিল অনেকটাই। তাই আর না করিনি। এমনিতেই মফস্‌সল, তার উপর আবার লোক দেখানো মুখোশ পরা কার্টুন! বেশি কেউ ডাকে না! “ঐ দ্যাখো মিকিমাউস!” কথাটা শুনতেই নিমন্ত্রিত এক বাবুর বাচ্চার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলাম। তারপর সেলফি। সেলফিটা তুলতে গিয়ে পিছন থেকে নিমন্ত্রিত বাবুর হাতটা আমার পিঠে ঠেকতেই বুকটা আবার ছ্যাঁত করে উঠল। ঠিক এভাবেই রাহুল আমার পিঠে হাত দিয়েছিল। তখন আমার ক্লাস টেন আর রাহুলের উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষাটা সবে শেষ হয়েছে। সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। তবে আজ আছে। চার্লি চ্যাপলিন কোত্থেকে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে দাঁড়াল যাতে সেলফিটা জমজমাট হয়। মুখোশের জমজমাট ভিড়ে চকমকে সেলফি তুলতে তুলতেই কখন যে চার্লি চ্যাপলিন বাবুর হাতটা সরিয়ে নিজের কাঁধে রেখেছিল, বাবু বুঝতেই পারেনি। তবে আমি বুঝেছিলাম। ভিতরের ভয়টা যেন মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল।

জীবনের প্রথম ভাগটা আমার বেশ কেটেছে। গোবরে পদ্মফুল হবার মজাটাই আলাদা! ফর্সা গায়ের রং, টানা চোখ, টিকালো নাক এসব দেখে লোকে বেশ খাতিরও করত। কিন্তু যত বড় হলাম ততই ঐ গোবরে পদ্মফুল হবার মজাটা যেন অভিশাপ হতে থাকল। তিন বোনের মধ্যে আমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে বাবার তেমন চিন্তা না থাকলেও লোকের ছিল। বাবুদের বাড়িতে মায়ের বাসন মাজা, ঘর পোঁছার মাঝেই বাবা হাঁক দিত পাড়ায় পাড়ায়, “লোহা.. ভা-ঙ্গা… টিন ভা-ঙ্গা…”। আর আমি তখন ইস্কুলের রাস্তার ঢিল খুঁজতে ব্যস্ত, পায়ে করে লাথি মারব বলে। কিন্তু সেই ঢিল যে বাবুদের বাড়ি অবধি গড়িয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমি বরাবরই লেখাপড়ায় মাথামোটা। তবুও কী জানি, চোখ-মুখ দেখে বাবু কী বুঝল! বলল, থেকে যেতে। ঘরের কাজ আর পড়ার দায়িত্ব সব নাকি বাবুদের। আর সেই থেকেই পড়াশুনোটা আর হল না। সে না হোক গে। পড়তে আমার খুব একটা ভালও লাগত না। সারাটাদিন বাবুর বাড়ির বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ছাদে কাপড় মেলা সব করার পর বেশিরভাগ দিনই বাবা ফিরতি পথে আমাকে বাড়ি নিয়ে যেত। কিন্তু ফাঁকিও দিত। আর সেই ফাঁকিতেই আমি শিখেছিলাম, মুখোশ ছাড়া জীবনটা চলে না। সেই রাত্রে রাহুল ছাড়া বাবুর বাড়িতে কেউই ছিল না। এমনকি কারেন্টটাও পর্যন্ত না। আর তখনই হাতটা বেশ ধীরেসুস্থে এগিয়ে এসেছিল আমার পিঠের দিকে। “অন্ধকারে ভয় করে?” রাহুল বললেও আমার উত্তর ছিল “না! ভয়টা অন্ধকারে নয়”। আসলে রাহুলের চোখমুখ দেখে ভয় পেয়েছিলাম তখন। যদিও কিছু বলতে পারিনি। সেই রাত্রে অনেক কিছু হয়েছিল এবং সেই হাত পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু ঘুরে বুক ফুলিয়ে বলেছিল, না পৃথিবীটা গোল নয়, পৃথিবীটা আসলে জিলিপির মত। আমার সেই প্রথম, তাই ভালোবাসার অত ফাঁকফোকর বুঝিনি, তবে ভালোবেসেছিলাম। দেখলে শরীরটা ছ্যাঁত করে উঠত। বেশ কিছুদিন চলেওছিল। কিন্তু গোবরের পদ্মফুল তো! তাই মাস তিনেক যেতে না যেতেই বাবু একদিন আমাকে ডাকল। বাবুর তখন চোখমুখ লাল। জড়ানো গলায় বলল, “তোর কোন ক্লাস রে?”

“টেন।“

“কই মুখ দেখে তো বোঝা যায় না!”

মুখোশ পরলে নিশ্চয় বোঝা যেত, কিন্তু তখনও মুখোশের ব্যপারটা জানতাম না। উত্তর খুঁজতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তাই বাবু নিজেই আবার বললেন, “রাহুলকে ভালোবাসিস?” আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিলাম, “হ্যাঁ।” কিন্তু এরপর আর স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। “ভালোবাসার মানে বুঝিস? রাহুল কিন্তু তোকে ভালোবাসে না! আমাকে রাহুল নিজে বলেছে।” বাবু বললেও বেশ সন্দেহ হয়েছিল। ‘বলতেই পারে না’ কথাটা বলতে গিয়েও বলিনি। তবে বাবু বলেছিল, “রাহুলের নিজের মুখে শুনতে চাস?” আমার তখন ছলছলে চোখ। দু-চার ফোঁটা জল পড়েছিল কিনা কে জানে! তবে বাবু বড় দরদী মানুষ, মুখোশের ব্যপারে বেশ যত্নবান। তাই নিজের হাসিটাকে চওড়া করে যখন বলেছিল। “আমিও তো রাহুলের মতই দেখতে! বয়সটা হয়তো কিছুটা বেশি! আমাকে ভালোবাসবি?” তখন আমি আর থাকতে পারিনি। সোজা বেরিয়ে চলে এসেছিলাম মায়ের কাছে। মেয়ের মায়েরা বড় সাবধানী হয়! তাই মা-ও কালমেঘের রস গেলার মতো করে গিলে নিয়েছিল সমস্ত কিছু কিন্তু বাবু গিলতে পারেনি। একটা ক্লাস টেনের মেয়ের সামনে নিজের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়টা বাবুকে ঠেলে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ির চৌকাঠে। “তোমার মেয়ের সাহস তো বলিহারি! বামন হয়ে চাঁদে হাত দেয়!” বাবু যখন শাসিয়ে গেল, ততক্ষণে সেই পদ্মফুল আর পদ্মফুল নেই। তার সবকটা পাপড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে পড়েছিল শুধুমাত্র মাত্র ঐ মাঝের হলুদ অংশটা। পাড়াতে জানাজানিও হয়েছিল। সেই সঙ্গে জেনেছিলাম আমিও। আমি ভালোবাসলেও রাহুল ভালোবাসতে পারেনি। দুঃখ হলেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। ভালোবাসা আসলে একটা নেশা, পাপড়ি ছেঁড়ার নেশা! যাইহোক পাপড়ি ছিঁড়ে গেলে তো ফুল আর ফুল থাকে না আর সেখানে প্রজাপতিও বসে না। কিন্তু তিন বোনের দিন-আনি-দিন-খাই সংসারে প্রজাপতি ছাড়া কি আর চলে? বাবার হাতটা একপ্রকার কপালেই ফিক্সড হয়ে গেল আর বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মা-ও বেশিদিন টিকল না। তবে পাড়াতে লোকে আমাদের বামন বলে খেপালেও বোনেদের বিয়েগুলো বাবা ঠিক দিয়েছিল। যদিও শরীরটা বেশিদিন সাথ দেয়নি। স্ট্রোক হবার পর আর তেমন কিছু করতেও পারে না। ঐ ক্যাটারিং-এর লোকেদের দৌলতে মাঝে সাঝে কিছু জুটে যায়। তবে শরীর গেলেও বাবার জেদ কোনোদিনও যায়নি। বাবু বাবাকে না দেখলেও বাবা বাবুকে বেশ ভালো করেই দেখে নিয়েছিল। “ঐ লোকের মুখোশ আমি খুলবই!” কথাগুলো মাঝেমাঝেই কানে আসে আমার।   

খুব সুন্দর করে ফুল-মালা দিয়ে সাজানো স্টেজের উপর এখন বর আর বউ। রাহুলের বউটাকে আমি খুব ভালো করে দেখলাম। সোনায় ঢাকা শরীর চারপাশের আলোয় ঝকমক করলেও মুখটা যেন কেমন। সারল্যের মিষ্টতাটা একেবারেই যেন নেই। ‘এর থেকে আমি ঢের ভালো দেখতে’ ভাবনাটা ভাবতেই কে যেন কানের পাশে “বামন” বলে হেসে চলে গেল। পাশ ফিরে দেখলাম, বড় বাবু, বেশ হুকুমের সুরেই বলছে “এই তোমরা একটু স্টেজের উপরে এসো তো। কিছু ছবি তুলব”। তারপর আমরা স্টেজে। রাহুল আর আমার মাঝে তখন মাত্র একটা সোনাদানায় ঢাকা মেয়ের দূরত্ব। রাগে জ্বালায় মুখোশটাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। একটা মুখোশ এক মুহূর্তে খুলে দিতে পারে বাকি সবকটা মুখোশকে। কিন্তু পাশের মেয়েটার সদ্য সদ্য চাঁদে হাত দেবার খুশিটাকে মাটি করতে মন সায় দিল না। সেই রাত্রে আমার রাহুলের সঙ্গে অনেক অনেক ছবি উঠেছিল। তবে প্রতিটা ছবিতেই আমি মিকিমাউস। তারপর শেষ বেলায় কনেযাত্রীর রাজকীয় খাওয়ার শেষে, যখন বড়বাবু গলা ভারী করে বলল, “এই তোমরা কিন্তু খেয়ে যাবে। আমার ছেলের বিয়েতে কেউ না খেয়ে ফিরবে না বলে দিলাম। বাইশ’শ টাকার প্লেট!” তখন আর থাকতে পারিনি। ফিসফিস করে বলেই ফেলেছিলাম, “খেতে গেলে যে মুখোশ খুলতে হবে!” 

“তা খুলবে! খুলে খাও। নিমন্ত্রিতরা তো সকলেই চলে গিয়েছে।”

মেয়ের বাবাকে দেখিয়ে তখন চার্লি চ্যাপলিন বলল, “ঐ তো। উনি তো এখনো আছেন।” চার্লি চ্যাপলিনকে আমি কোনোদিনও ওভাবে কথা বলতে শুনিনি। ব্যস্ততার সঙ্গে মেয়ের বাবার কাঁধে হাত রেখে বড় বাবু তখন বলল, “আরে, উনি তো আমার ঘরের লোক। আমার বেয়াই মশাই।” তখনও চার্লি চ্যাপলিনের গলাটা একই। সেই একই ভাবে বলল, “সেই জন্যই তো।” ছেলের বিয়েতে সারাক্ষণ নিজের মুখোশ বাঁচাতে বাঁচাতে বড় বাবুর অবস্থাও তখন ঠিক আমারই মত। তাই বেশ বিরক্তির স্বরেই বলল, “এই তোরা কে রে? কথা কানে যায় না! খেয়ে যেতে বলছি খেয়ে যাবি। এত কথা কিসের! মুখোশটা খোল।” বড় বাবুর মুখোশটার এই সামান্য নড়নচড়নের সুযোগটা আর চার্লি চ্যাপলিন ছাড়েনি। হুট করে খুলে দিয়েছিল আমার মিকি মাউসের মুখোশটাকে। মুহূর্তের জন্য চারিপাশ যেন স্তব্ধ। “তুমি!” বলতে গিয়েও থেমে গেল বড় বাবু। রাহুলও সামনেই ছিল। আমার মুখটা দেখে এবার সদ্য বিয়ে করা বউটাকে দেখে আবার সেই আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে। মুখোশ খুলে যাবার ভয়ে হয়তো প্রাণপণে ঈশ্বরকে ডাকছিল। আর একবার কারেন্টটা যাক! “কী বাবু, আর কারও মুখোশ খুলতে হবে?” চার্লি চ্যাপলিন একটা অপার্থিব সুখ নিয়ে বড় বাবুকে বললে, বড় বাবু তখন পালাতে পারলে বাঁচে! আমতা আমতা করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতেই “আবার কার মুখোশ খুলবে! যাকগে খেয়ে যেও।” বলে রাহুলকে নিয়ে ভ্যানিশ হতে চাইলেও পারলনা। “কী ব্যপার বেয়াই মশাই? কারা এরা?” মেয়ের বাবা জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলে বড় বাবু নিজেই তখন যেন মুখোশবিহীন বামন। চার্লি চ্যাপলিন শুধু এটুকুই চেয়েছিল। আর কথা বাড়ায় নি। শুধু বলেছিল, “আমিও আপনারই মত। মেয়ের বাবা! আসলে পেটের দায়ে মুখোশ পরি তো, তাই মুখোশ খুলতেও জানি।” শেষের কথাগুলো মেয়ের বাবা না বুঝলেও, বড় বাবু বেশ বুঝেছিল। সেই সঙ্গে হয়ত বুঝেছিল রাহুলও! 

আরও পড়ুন...