গ ল্প
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। না, দেরি হয়নি। আজ ভালোই লাগছিল সব মিলে। আমার ফুল ফুল হলদে রঙা সালোয়ারটা আমার সঙ্গে ভালোই সঙ্গত দিচ্ছিল। ওর খুশির কারণ আমি তেমন জানি না। টি,ভি’র বিজ্ঞাপনের মতো এক্সট্রা সাইন । যাই হোক, ওর দিকে এতো মন দেবার কিছু নেই। বরং সিঁড়িটা দিয়ে নামতেই পা’দুটো একটু শিরশির করলো। কয়েকদিন থেকেই দেখছি সিঁড়িটা কেমন গুম হয়ে আছে। কাল সন্ধেবেলা ফেরার সময় ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছিলাম , কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আজও সেই একই চেহারা। আমি ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে ওর মুডটা বোঝার চেষ্টা করতেই দোতলার ফ্ল্যাটের মোটা দাদাভাই বেরিয়ে এলেন। সবার এখন অফিস যাবার তাড়া। হাসলেন যেন। মাস্ক, ফেসশিল্ড ভেদ করে সেটা অল্পই বোঝা গেল। আমি জানি আমার হাসিটাও তেমনই, অনুভূত হয়। দেখা যায় না। মোটা দাদাভাই ধুপধাপ করে নেমে যাবার পর আমি ধীরে ধীরে নামতে লাগলাম, যাতে কিছুটা হলেও সিঁড়ির মুডটা বুঝতে পারি। মুখ ভেটকে পড়ে আছে, অথচ কিছুই বলবে না। পা টিপে টিপে নামলাম, যদি কিছু বোঝা যায়। কিন্তু না, পারলাম না। নিচে নেমেই দেখি অ্যাপ ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। মা বলে, আমার নাকি রোজগারের চেয়ে খরচ বেশি। ওরা কী বুঝবে ফ্রন্ট অফিসে কাজ করে কত মজা। কত রকম মানুষ যে আসে। অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে করতে তাদের নানা কাণ্ড , অস্থিরতা , বদঅভ্যেস, ফোনের প্রত্যেকটা কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনি। যেটুকু শুনতে পাই না সেটুকু বানিয়ে নিই। অন্যের চিঠি লুকিয়ে পড়ার মতো আনন্দ হয়। যদিও চিঠি কেউ কাউকে লেখে না এখন। খুব ছোটবেলায় বাড়িতে বড়দের চিঠি আসতে দেখেছি একটা দুটো। যাইহোক গাড়ির দরজা খুলে উঠতে উঠতে ভাবলাম, এখন আরও এক দুরন্ত নেশায় আমার দিন কাটে। ভরা করোনার দিনে অল্প কয়েকজন এমপ্লয়ী নিয়ে চলছে অফিস। আমি তাদের মধ্যে একজন। সারাদিন ওরা করোনার গল্প করে, চোখের কোণে, ভুরুর স্পেসে, কাঁধের ঝুলে পড়ায় আমি এই মারীকে সরাসরি দেখতে থাকি। যাইহোক এখন আমার দেখার বিষয় একটিই, সেটি হল মাস্ক, মাস্ক একটি বিষয়। এই জন্যই একদিনও অফিস কামাই হয় না। ড্রাইভারকে বললাম গাড়িটা সামনের বাস স্টপ এলেই যেন স্লো করে। অকারণে বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। সামনের রাস্তাটা টার্ন নিলেই বাসস্টপ। হঠাৎ মনে হল কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। সব থেমে গেছে, চারদিকটা ব্লার হয়ে গেছে। আমি ঢুকে পড়েছি একটা টানেলের ভেতর। খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছি, ওই তো ও দাঁড়িয়ে আছে। ও কেমন শার্ট প্যান্ট পরে থাকে আমি জানি না। ও খুব লম্বা না বেঁটে না মাঝারি আমি জানি না। ও কে তাও জানি না। আমি দেখি ওর মাস্ক। প্রতিদিন ও নানারকম মাস্ক পরে। নাক মুখ ঢেকে একটি অসামান্য ভঙ্গিতে ও দাঁড়িয়ে থাকে। রোজ… কোথায় যায় কে জানে… অফিস বোধহয়। আজ ওর মাস্ক দেখে আমার কেমন সব গুলিয়ে গেল। কালচে ঘেঁষা ঘন নীল একটা মাস্ক। কী অদ্ভুত পুরুষালি একটা ভাব ঠিকরে পড়ছে মাস্কটা থেকে। সাদা ভাল্ভটা আরো গাম্ভীর্য দিয়েছে মাস্কটাকে। গাড়ি এগিয়ে গেল, আমি ডুবতে লাগলাম। সারা শরীরে প্রথমে তীব্র উত্তেজনা এল । আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি ওর সামনে। মাস্ক ধীরে ধীরে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে আসছে। একটা প্রবল ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিল। ধীরে ধীরে উচ্ছ্বাস শান্ত হলে দেখি , চারিদিকে নীল জল। আমি ভেসে আছি জলে। আমার শরীর ওই জলে গুলে যাচ্ছে একটু একটু করে। কী অসহ্য আনন্দ হতে থাকে আমার। হাতটা মিশে যাবার আগে ছুঁয়ে দেখি ঝিনুক, জল শঙ্খ…কত মাছ নানা রঙের। সমস্ত শরীরটা গুলে যাবার পর আমি বুঝতে পারি চোখ দুটো কিছুতেই গুলে যাবে না। ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়াবে পুরুষালি নীলের গন্ধে। শরীরী উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে এল। এখন শুধু ভেসে থাকা। সারা শরীরে নীল মাস্কের ঢেউ জড়িয়ে আছে। আমার একা লাগে না। নীলের সঙ্গে গায়ে গা ঠেকিয়ে গল্প করি। নীল আমাকে চুমু খেতে চায়। হঠাত চমকে উঠি, দেখি অফিস পাড়াতে পৌঁছে গেছি। ড্রাইভার লোকেশন জানতে চাইছে।
আজ খুব আনন্দ হচ্ছিল। মাস্কের জন্য কেউ আমার হাসিটা দেখতে পায়নি । কিন্তু আমার চোখ, শরীর কিছু একটা বলছিল। অফিসের হাওয়াটা খুশি হয়ে ওঠে। অফিসের ঝুলে পড়া কাঁধগুলো টান টান হবার চেষ্টা করে। আজকের দিনটা আমার ভালোই কাটবে মনে হচ্ছিল। আজকাল সবাই না আসায় কাজের চাপ বেড়েছে। বাকিদের সঙ্গে মিলে্মিশে মন্দ লাগছে না এই নতুন পরিস্থিতি । কমপিউটারে চোখ রেখে ভাবছিলাম প্রথম দিনটার কথা। সদ্য আনলক হয়েছে, রাস্তায় লোকজন খুবই কম। আমি গাড়ি সার্চ করছিলাম আর হাঁটছিলাম । বাসস্টপেই যাবো হয়তো। কিছু না পেলে ফিরে যেতে হবে। তখনই দেখেছিলাম ওকে, মুখে আলগা ভাবে এঁটে আছে সার্জিকাল মাস্ক। মাথায় হাল্কা নীল সার্জিকাল ক্যাপ। মনে হচ্ছিল খুব চিন্তামগ্ন সেই মাস্ক। খুব অস্বস্তি ঘিরে আছে যেন। আর তখনই আমি নিজেকে দেখেছিলাম অপারেশন টেবিলে। গায়ের ওপর আলো পড়েছে। মাস্ক আমার শরীরের যন্ত্রপাতি খুঁটিয়ে দেখছে। মাথা নাড়ছে। অসন্তোষ প্রকাশ করছে। আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি, আমি কেন এখানে? কিন্তু উঠতেও পারছি না। আমি মাস্কের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছি। ও আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করছে। এটা কাটছে, ওটা সেলাই করছে। আমি কিছু না বলতে পেরে ওকে দেখতে লাগলাম। তারপর থেকে ওকে দেখেই যাচ্ছি। ওকে দেখাটা আমার এখনকার নেশা। ও আমার ভেতরটা দেখে, আমি ওর বাইরেটা। সেদিন সারাদিন ওই সার্জিকাল মাস্কের সঙ্গেই কেটেছিল। চারদিকে তখন মৃত্যুর খবর। আর মাস্ক এইসব খবরগুলো আমার ভেতরে ঢুকিয়ে সেলাই করে দিয়েছিল। ওর প্রত্যেকটা নড়াচড়া আমার ভালো লাগছিল। ওর কাছে কী করে আকর্ষণীয়া হয়ে উঠবো বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম শুকনো ঠোঁটটা একবার চেটে নিই, একটু সতেজ দেখাবে। কিন্তু জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে গিয়ে দেখি আমার মুখেও মাস্ক। যথাসম্ভব মেদুর চোখে তাকিয়ে রইলাম। যদি চোখে পড়ে। কিন্তু ও আমার পেট সেলাই করছিল মন দিয়ে, যাবতীয় খবরাখবর ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলো।
আজ বাড়ি ফেরার পথে মনে পড়ল সিঁড়িটার কথা। কাল ইলেকট্রিশিয়ানকে আসতে বলেছি। একটা ভালো লাইট লাগিয়ে দেবে। তাতে যদি গুমরানো ভাবটা কমে। দেখি…। বাসস্টপে অনেক মাস্ক দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য। কিন্তু ও নেই। সেদিনের মাস্কটা মনে পড়লো । বেশ কর্পোরেট টাইপ। সাদা রঙটা হাল্কা স্লেটঘেঁষা। আমার দেখেই মনে হয়েছিল যেন একটা কাচের দরজা ঠেলে আমি ঢুকলাম। ঢুকতেই একটা আশ্চর্য গন্ধ… মাস্ক আমাকে দেখছে। আমিও অবাক হয়ে ভাবছি এই তো আমি চেয়েছিলাম। আমার শরীর থেকে একটা সিঁড়ি বের হয়ে চলে গেছে মাস্ক পর্যন্ত, মাস্ককে ছাড়িয়ে আরো কোথায় কে জানে। কী অপূর্ব ঘোর । আমি নিজেকে যেন চিনতেই পারছি না। আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে । মাস্ক এসে আমার হাত ধরলো, আমি আর সে সুবিশাল জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। এইসব চিন্তারা আমার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। মা সেদিন বলছিল, এই করোনার দিনেও আমাকে নাকি বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। নতুন পাতার মতো চেকনাই বেড়েছে। মা আজকাল বাড়িতেও মাস্ক পড়ে থাকে। সেদিন মা পরেছিল লাইল্যাক রঙের মাস্ক। দেখে আমি চমকে উঠলাম। এই রঙটাই… এই তো সেদিন… সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওর পাশ দিয়ে যেতেই ও আমাকে টেনে নিল। তাকিয়ে দেখি আমি হাঁটছি রাতের আকাশ ধরে, ও আমার হাতে দিয়েছে অজস্র লাইল্যাক ফুল। আমি ফুলের গোছা বুকে জড়িয়ে ধরেছি। হঠাৎ দেখি যাঁরা মারীতে সদ্য মারা গেছেন, তাঁদের দেখতে তারাদের মতো লাগছে। আমি অবাক হয়ে মাস্ককে বললাম, এসব কী? ও বলল, এসব নিও নরম্যাল ঘটনা। আমি সেইসব সদ্য তারাদের লাইল্যাক ফুল দিলাম। তাদের জন্য খুব কাঁদলাম। আমার শরীরে তারা ঝিকমিক করতেই, মাস্ক আমাকে টেনে নিয়ে এল। আমরা বাসস্টপে দাঁড়ালাম। ও কেমন লাইল্যাক রঙের ধোঁয়া হয়ে আমার ওড়নায় মিশে গেল। এইসব খুশির দিন প্রায়ই আসতে লাগল। আর অফিসে সবাই অবাক হয়ে বললো, আমাকে নাকি এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে মাস্কের ওপর দিয়ে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সবাই আমার কাছে শুনতে চাইছিল যে তাদের ঝুলে পড়া কাঁধের ঠিক হবার কোনও ওষুধ আছে কিনা। আমি আমার ঘরের দরজার সিঁড়ি ছাড়া বাকি সবটাই ভালো রেখেছি। এদিকে মারীর তেজও অনেকটা কমের দিকে। অনেককেই মাঝে মধ্যে বেশ বেপরোয়া হয়েই ঘুরতে দেখা যায়। হয়তো তাদের আর কেউ নেই। ঘর বলতে হয়তো শুধু তার দেহটুকুই আছে। দেহঘর নিয়ে সে বেলাগাম ঘুরে বেড়ায়। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড অনেকেই মাস্ক পরে না। কী জঘন্য উলঙ্গ দেখায় তাদের। আমি আমাদের বাস স্টপে এসে দাঁড়াই । মাস্কও আসে। আমরা আমাদের মাস্কের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। চুমুর ভেতর কোনও চামড়ার গন্ধ নেই। সাবান কাচা রোদের গন্ধ লেগে থাকে আমাদের চলার রাস্তায়।
এরপর সত্যি একদিন আমার জ্বর এল। মা বললো এইবার শেষ হবে মারীর দিন। কতদিনের জন্য আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙলে মা বাবা বললো প্রায় একবছর পেরিয়ে গেছে। মারীর দিন শেষ। আমি ধড়মড়িয়ে উঠেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। ছুটতে লাগলাম বাস স্টপের দিকে। দেখি অনেকেই দাঁড়ানো। কারুর মুখে মাস্ক নেই তো! আমি পাগলের মতো ছুটে গেলাম, কই সে? কই? যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আমি তো চিনি না। কিন্তু মন বললো এইই সে। কী অসহ্য খোলা মুখ। মুখের কোন আড়াল নেই। আমার ভেতরটা কেমন চৌচির হয়ে যেতে লাগলো। কী হবে এবার। সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আতঙ্কে আমার গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ হলো শুধু। কিন্তু কই, ও তো চিনল না! আমাকে পেরিয়ে যেতে গিয়েও একবার ফিরে তাকালো। চলে গেল। আমি বাড়ি ফিরলাম। সিঁড়িকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে ঘরে ফিরে দেখি , আমার ঘরের বিছানায় কেউ অনেক ঝিনুক রেখে গেছে, রেখে গেছে লাইল্যাক ফুল। খুব ভালো লাগতে লাগল আমার। আস্তে আস্তে আমার গায়ে তারা ফুটে উঠল।