আ মা র পু জো
পুজোমণ্ডপে হতকুচ্ছিত হাতের লেখায় ভুল বাংলা বানানের ছড়াছড়ি। তা দেখে সে-কী আনন্দ আমার ! বিষয়টা ব্যাখ্যা করা কঠিন। ঘটনার বর্ণনা দিলেই বুঝবেন, যে আমার জায়গায় পবিত্র সরকার কিংবা শঙ্খ ঘোষ থাকলেও, তাঁরাও ওই ভুল বানানে আপ্লুতই হতেন । এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাঁশয়ারায়।
মধ্যপ্রদেশ সীমান্তে রাজস্থানের ছোট শহর ও জেলা বাঁশয়ারা । সেবার সংবাদপত্রের সম্পাদককে হিপনোটাইজ করে কুড়ি দিনের ছুটি হাতিয়ে পুজোর সপ্তাহ খানেক আগেভাগে বাঁশয়ারার উদ্দেশে ট্রেনে চড়ে বসেছিলাম । ২০১৪ সালের কথা। সেই সময়টায় উট, কেল্লা, বালি আর খমাঘনি রাণাদের দেশে থাকত আমার বোন-ভগ্নীপতি। আনন্দের কথা হল, যোধপুর, জয়পুর, উদয়পুরের মতো বড় শহরে থাকত না ওরা। বড় শহর আঞ্চলিকতাকে খেয়ে নেয় কিংবা পণ্য করে তোলে (রাজস্থানের শহরগুলোর ক্ষেত্রে দুটোই হয়তো সত্যি) । বাঁশয়ারার মতো ছোট শহরে ওইসব নেই। গিয়েই বুঝেছিলাম নেহাতই দেহাত। গ্রাম-গাঁওয়ের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তাঘাট, মানুষজন সবেতেই। আসলে তুলনায় ব্যস্ত শহরগুলো খানিক দূরে। বাঁশয়ারা থেকে সবচেয়ে কাছের রাজস্থানের অতি চেনা বড় শহর উদয়পুর। বাসে ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। উল্টোদিকের কাছের ব্যস্ত জংশন স্টেশন মধ্যপ্রদেশের রতলাম। সময়ের হিসেবে বাঁশয়ারা থেকে দূরত্ব আড়াই ঘণ্টা প্রায়।
শেষরাতে রতলামের আগের স্টেশন মন্দসৌর-এ নেমে বাঁশয়ারায় পৌঁছানোটাও ছিল অপূর্ব অভিজ্ঞতা। পাহাড়-জঙ্গল ভেদ করে ছুটেছিল আমাদের প্রাইভেট গাড়ি। ধীর ধীরে তারা মুছে, আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্য উঠেছিল। খেত-খামারে ঘুরছিল রোদের ময়ূর। রাস্তায় মাঝেমাঝেই বিরাট উটের পাল নিয়ে দেহাতি রাখাল। সাদা রাজস্থানী ফতুয়া, সাদা খাটো ধুতি পরণে। মাথায় সাদা কাপড়ের পাগড়ি। যা দেখে অবাক হয়েছিলাম, তা হল ওদের প্রত্যেকের হাতে ওই ভোরবেলাতেও একটা করে হ্যাজাক লণ্ঠন। কেন? নিজের সঙ্গে খানিক কথোপকথন চালিয়ে বুঝলাম- সারাদিন উট চরানো। ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধে। ইলেক্ট্রিসিটিহীন পাহাড়ে-জঙ্গলে, অন্ধকারে গ্রামের পথ খুঁজে নিতে প্রয়োজন হ্যাজাকের আলোর। অর্থাৎ কিনা জিনিসটা সকালে চোখে পড়ল বটে আমার, কিন্তু ব্যবহার হবে সন্ধ্যায়। উট-পালকের ডায়েরির লেখক সামনাসামনি উট-পালকদের দেখে শিহরিত হয়েছিল বলা বাহুল্য !
বাঁশয়ারায় পৌঁছেও আরাবল্লীর রেঞ্জ পিছু ছাড়েনি। বোনেদের তিনতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়াতেই দেখি খানিক দূরে সবুজপাহাড়। এমনিতে সবটাই ভালো। কলকাতা থেকে এত দূরে আসা নতুনের জন্যেই তো। নতুনের খোঁজেই লোকে পয়সা খসিয়ে হিল্লিদিল্লি পাড়ি দেয়। ঝুঁকি নেয়। প্রাণের এমনকী! কিন্তু আমি যে বচ্ছরকার দুর্গাপুজো ফেলে এসেছি কলকাতায়!
একেবারেই ভক্তিবাদী নই। ঠাকুরমশাই ভুল উচ্চারণে সংস্কৃত বললেন, তার উপর আমি আরও কিছুটা ভুল যোগ করে ‘ভক্তিভরে’ অঞ্জলি দেব, যার গোটা এক লাইনের মানেও জানি না! এইসব ঝক্কিতে আমি নেই । লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখাতেও অনীহা। পুজোর চারদিন নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম থাকে যাঁদের, যাঁরা খুব আড্ডা দেন, সিনেমা-থিয়েটার দেখেন, রেস্টুরেন্টে খান, তাঁদের দলেও পড়ি না। গোটা বছরের মতোই অবজার্ভেশন মোডে কাটে আমার পুজোর চারদিন। মানুষ দেখি, মানুষের আনন্দ দেখি। দুঃখ অবদমনের আশ্চর্য আনন্দকৌশল দেখি! খেয়াল করেছি, ছোটদের আনন্দ সারা বছর পবিত্র। কিন্তু বড়দের আনন্দ পবিত্র মাত্রা পায় পুজোর সময়েই। দুনিয়ার মার খেয়ে সন্তানের জন্য নতুন জামা-জুতোর ব্যবস্থা করেছে যে বাপ-মা, সন্তান যখন সেই জামা পরে সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সেই বাপ-মার চোখে “বিশ্বরূপ” দেখেছি! পুজোর একটা দৃশ্য বড্ড প্রিয় আমার। দৃশ্য এরকম— অসুস্থ দাদু বা ঠাকুমাকে হাত ধরে ধীরে ধীরে মণ্ডপের দিকে নিয়ে আসছে উত্তরপ্রজন্ম। ওঁরা এসে দাঁড়ালেন আনন্দ-ঈশ্বরীর সামনে। নতজানু হয়ে ভক্তিভরে প্রণাম ও প্রস্থান। এমনকী যাঁরা অসুস্থতায় বিছানা নিয়েছেন, তাঁরাও পুজোর সময় নতুন পোশাকে ওই বিছানাতেই আরোগ্যআনন্দ খোঁজেন ! ছেলেপুলে, নাতি-নাতনিদের সহযোগিতায় আধশোয়া হয়ে মণ্ডপের দিকে মুখ করে জোড়হাতে প্রণাম দেখেছি ! আহ, এই না হলে নশ্বর মহাজীবনের মহিমা! একদিকে অর্থবানের ছেলের দশটা জামা, অন্যদিকে ঢাকির ছেলের ছেঁড়া গেঞ্জি, খালি পা ! এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমি ও আমরা ! যেন জীবনানন্দকথিত বিপন্ন বিস্ময়ের বহুমাত্রিক সিনেমা হলে জন্মেছি! তারই একটা পর্দায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের পাড়ার ‘বিশ্বকর্মা’ মণীশকে। পড়াশুনো শেখেনি, কিন্তু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ জানা। বছর ভর সাইকেল সারায়, ইলেক্ট্রিকের ছোট কাজ করে, গরিবের সাইকেলে বড়লোকের ছেলেমেয়েদের চাপিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেয়। আর পুজোর সময় পাড়ার মণ্ডপের মাঠের উল্টো দিকের রাস্তায় চারদিনের এগরোল-চাউমিনের দোকানদার। প্রতিবার। অবশ্য এসব দেখার বাইরেও থাকে দুর্গাপুজোর ব্যক্তিগত মায়া !
যেমন, উঠোন-সাজানো শিউলি দেখতে মনে হয় ভোররাতেই উঠে পড়ি। বিশ্ব উষ্ণায়নেও যদি প্রকৃতি সদয় হয় শেষ রাতের তথা ভোরের মৃদু শীত উপভোগ করতে কী ভালো লাগে! তারপর অল্প দূর থেকে ভেসে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ! চির রহস্যময় আনন্দের তাল! বেলা বাড়তেই মাইকে উদার মন্ত্র, ট্রেড মার্ক হিন্দি-বাংলা পুজোর গান। কিছু গান যেন পুজোর গান হবে বলেই…! তারপর বাড়িতে মায়ের হাতের ভালো রান্না, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক আড্ডাও। এবং একাই বেরিয়ে পড়া হঠাৎ। পৃথিবীতে কত কোটি রকমের সুন্দরী হয় এবং তাদের পবিত্র তথা মিথ্যে প্রেমের ম্যাজিক দেখতে ভালো লাগবে না! এমন কত কী যে ছেড়ে এসে পৌঁছেছি বাঁশয়ারায়! আমার মতো একটা আপাত নির্লিপ্ত লোক পুজোর থেকে দূরে এসে প্রথমবার পুজোর কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে বেমালুম বাড়িয়ে ফেলেছে বুঝতে পারছি! কিন্তু সেই আবেগ ভেঙেছে বোন-ভগ্নীপতির বাড়িতে আসা-ইস্তক। কেন?
কারণ বোন-ভগ্নীপতিও জানে না, বাঁশয়ারায় একটিও পুজো হয় কি-না ! যেহেতু ওরা যতদিন হল এখানে এসেছে, ততদিনে পুজোর সময়টা এখানে কাটায়নি। কিন্তু, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগে সবখানেই বাংলা চ্যানেল। অতএব, তৃতীয়া থেকেই দেখানো শুরু কলকাতা তথা গোটা রাজ্যের পুজো পরিক্রমা ! যা ফেলে আসা দুর্গাপুজোর আনন্দকে গাঢ় দুঃখে পরিণত করতে যথেষ্ট। এর মধ্যে, সম্ভবত ষষ্ঠীর দিনে একটা কানাঘুষো শোনা গেল, পুরানা বাসস্ট্যান্ড বলে একটি জায়গায় একটা পুজো নাকি হয় । আমি ভাবছি, যদি সেখানে হয় তো হয়, নচেৎ রামকৃষ্ণ মিশনের খোঁজ করব। রামকৃষ্ণ মিশন দুনিয়ার সবখানে আছে। আর সেখানে একশো শতাংশ পুজো হবেই । নিশ্চিত।
না, রামকৃষ্ণ মিশন খুঁজতে হয়নি। ষষ্ঠীর দিন সকালে পুরানা বাসস্ট্যান্ডের ব্যাপারটা কনফার্ম হল। সেদিন সকালে ও সন্ধ্যায় টিভিতে খাপছাড়া পুজো দেখলাম। বাইরে বেরোনোর জো নেই। অক্টোবরেও অসম্ভব গরম বাঁশয়ারায়। সাড়ে দশটা এগারোটার পর তো রীতিমতো লু। পথেঘাটে অল্প মানুষ। তাদেরও নাক-মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। তবে সূর্যাস্ত হলেই বদলায় আবহাওয়া। পাহাড়ের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসে। তখন মনে পড়ে বাংলার শরতের কথা । সেদিন রাতে শুতে গেলাম কলকাতা থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরের দুর্গাপুজো কেমন হতে পারে, সেই সব ভাবতে ভাবতে।
সপ্তমীর সকালটা কোনোমতে ডিঙিয়ে সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়লাম বাঁশয়ারার পুজোর সন্ধানে । বোনদের ফ্ল্যাট বড় রাস্তার গায়ে গায়ে গলিতে। উঁচু বড় রাস্তায় উঠে অটো নিলাম আমরা । পুরানা বাসস্ট্যান্ড নামের জায়গাটায় পৌঁছাতে মিনিট পনেরো লাগল । আগেই জেনেছিলাম, জায়গাটা বাঁশয়ারার অন্যতম ব্যস্ত অঞ্চল। দেখলাম, টুকিটাকি অনেক দোকান। সবজি বাজারও আছে। বোন-ভগ্নীপতি জানাল, আজকের ভিড় কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তার মানে পুরানা বাসস্ট্যান্ডের ময়দানে পুজো হচ্ছে ! দলে দলে ভিড় সেই দিকেই এগোচ্ছে যে। আমরাও ময়দানে পৌঁছোলাম। মাঠের যেদিকে রাস্তা, সেইদিকেই প্যান্ডেল। সাদামাটা। তবে, দেখলেই বোঝা যায় যে এ দুর্গামণ্ডপ না হয়ে যায় না । সবচেয়ে বড় কথা, এখানে শুধু পুজোই হচ্ছে না, মেলাও বসেছে একটা। নাগরদোলাটোলা নেই, হরেক মাল কেনাকাটার দোকানের মেলা । মণ্ডপেই ঢুকলাম আমরা। ছোট মাতৃপ্রতিমা দর্শন করলাম । প্রতিমা সাধারণ। দেখেই মনে হল, স্থানীয় কুমোরের কাজ । আসলে প্রতিমার ছাঁচ অচেনা ঠাকুরের মুখচোখও । প্রতিমার পায়ের কাছে রাখা ঘট-ডাব, ফল-প্রসাদ, ধূপধুনো। সবটা দেখে অদ্ভুত আনন্দ হল। প্যান্ডেলের ভেতরে কয়েক জোড়া ডেকরেটার্সের চেয়ার পাতা। তাতে খানিক বসলাম। বসে বসে ভাবছিলাম, বাঁশয়ারার বাঙালিরাই যে এ পুজো করেছে তা তো বুঝেছি, কিন্তু তাদের যদি দেখা যেত একঝলক। ভাবতে ভাবতেই মণ্ডপে ঢুকল একদল কম বয়সি ছেলেমেয়ে। বয়স পনেরো থেকে আঠারো-কুড়ি হবে। ছেলেরা পাঞ্জাবি পরেছে, মেয়েরা সালোয়ার, এমনকী শাড়ি কারো কারো। যদিও তারা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতেই কথা বলছে। শারীরিক অভিব্যক্তিতেও একটা জাত-কে চেনা যায়। এদের দেখে বোঝা গেল এরা বাঁশয়ারার পরিবর্তিত বাঙালি প্রজন্ম। এর মধ্যে পুজোর উদ্যোক্তা বড়রাও ঢুকলেন মণ্ডপে। ধুতি পরা কাউকে দেখিনি। তবে, পাজামা-পাঞ্জাবি সকলের। মা-কাকিমারা মা-কাকিমাদের মতোই। বড়রা অবশ্য বাংলাতেই কথা বলেন। সবচেয়ে বড় কথা, বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই কম বয়সিরাও বাংলা বলছে, যদিও কতকটা হিন্দি টানে। বুঝতে পারলাম, কেবল ভূখণ্ড বদলের কারণেই পুরোনো প্রজন্মকে নিজের ঐতিহ্য ও ভাষাকে বাঁচাতে কতটা লড়তে হচ্ছে। এরই মধ্যেই চোখে পড়ল মণ্ডপের একদিকে কাপড়ের গায়ে আর্ট পেপার কাগজ সাঁটা। এগিয়ে গিয়ে দেখি বাংলা অক্ষর ! সেখানে পুজোর নির্ঘণ্ট লেখা। সেই লেখা দেখে পিলে চমকালো আমার। একে তো ভয়ঙ্কর হাতের লেখা। তার উপর ভয়াবহ বানান। সপ্তমী হল “সপতমি”। একই যুক্তিতে “অষটমি”, “নবমি” ও “দশমি”। এবং এইরকম আজব অক্ষরজোটে আরও পুজো সংক্রান্ত আরও কত কী লেখা । অতি আক্ষেপে কয়েক পলক সেই বানানের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই আচমকাই চূড়ান্ত আনন্দ হল আমার । চাপা উল্লাস করে উঠল মন । অনুভব করলাম, জীবিকার জন্য কিংবা অন্য কোনও অস্তিত্বের সংকটে কলকাতা থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে এসেও বস্তুত একটা লড়াই চালাচ্ছে বাঁশয়ারার এই বাঙালি সমাজ। অতি কঠিন লড়াই। যে সময় পশ্চিমবঙ্গের “শিক্ষিত” বাঙালি বাপ-মা সন্তান ইংরেজি জানলে ও বাংলা ভুলে গেলে নৈসর্গিক আনন্দ পায়, যখন ভাষার যুদ্ধ বেধে গেছে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে ভারত মহাদেশের, প্রভাবশালী উত্তর ভারতীয়রা কৌশলগতভাবে চাইছেন, গোটা ভারতের মুখের ভাষা হোক হিন্দি। আঞ্চলিক ভাষা সংস্কৃতির সেই সংকটকালে বাঁশয়ারার শিকড় ছেঁড়া বাঙালিরা আসলে ভুল বাংলা বানান লিখেও নিজেদের “ঠিক” রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।