গ ল্প
সে দিন বেশ কুয়াশা পড়েছে। আমাদের বাড়ির বেড়াটা বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি। বেড়ার গায়ে ভর্তি হয়ে লতিয়ে গেছে নীলকন্ঠ ফুলের গাছ। সকালে কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি বারান্দায়। একা। গেটের ওপাশ দিয়ে মাটির পথ চলে গেছে। এত সকালে কেউই পথ দিয়ে চলাচল করছে না। বেড়ার নীলকন্ঠ লতায় অনেক ফুল ফুটেছে নীল রঙের। হঠাৎ দেখি— একজন বৃদ্ধ, গায়ে কমদামি একটা চাদর জড়িয়ে নীলকন্ঠ ফুলে হাত বোলাচ্ছেন। বারেবারে। এইরকম বৃদ্ধরা সাধারণত প্রাতঃকালে উঠে এ-গাছের ও-গাছের ফুল তুলে নিয়ে যান। কেউ কেউ সতর্ক দৃষ্টিপাতেও তোলেন, যাতে ওই ফুলগাছের মালিক না দেখতে পান। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, ওই বৃদ্ধ ঠিক সেই দলের নন।
আমি ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে বৃদ্ধের সমীপবর্তী হলাম। তিনি তখনও একাগ্রচিত্তে নীল রঙের নীলকন্ঠ ফুলের গায়ে বড় মায়ায় হাত বোলাচ্ছেন। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি মুখ তুললেন। একদা বৃদ্ধের রং খুব ফর্সা ছিল। এখন তামাটে। কয়েকদিনের না-কামানো সাদা দাড়ি। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে চলেছেন কেন!
বললাম, “আপনি ফুল নেবেন? তুলে দেব আমি? নিন। পলিপ্যাক দেব একটা?”
বৃদ্ধ বললেন, “না না, আমি ফুল নিতে আসিনি। এমনিই ফুলগুলো দেখছিলাম। এই ফুল দিয়ে আমার স্ত্রী শনিবারে শনিবারে পুজো করতেন। এই ফুল দিয়ে।” বলে আবার হাত বোলাতে লাগলেন।
বললাম, “আপনার স্ত্রী এখন এই ফুলে পুজো করেন না?”
“সে মারা গেছে দশবছর আগে।” বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “আমি যখন এই সময় এই পথ দিয়ে যাই, তখন ফুলগুলো দেখি। তার কথা মনে পড়ে। আজ শনিবার বলেই বড় বেশি করে মনে পড়ছে।”
আমি বললাম, “আপনার বাড়িতে কে কে আছেন এখন?”
বৃদ্ধ ম্রিয়মাণ হাসলেন, “দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে চাকরি করে। অন্যত্র থাকে। আমি এখানেই থাকি। এইসময় সে থাকলে বড় ভালো হতো।”
হঠাৎই সেই কুয়াশার সকালে বৃদ্ধ মানুষটি ফুঁপিয়ে উঠলেন। দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। তিনি আমার হাতখানা ধরে বললেন, “আজ আমি ক’টি নীলকন্ঠ ফুল নেব বলেই এসেছিলাম। নেব?”
“নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আমি তুলে দেব?”
“না। আমি নিজের হাতে তুলে ওর ফটোতে দেব। জানেন, কাল থেকে আমি এখানে আর থাকবনা।”
“কেন?” আমি যেন বেশ কষ্ট পেলাম বৃদ্ধের কথায় ।
“আমার ছেলেরা এই বাড়ি বেচে দিয়েছে। অনেক বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, তোদের মা-র স্মৃতি। তা ওরা বলল, স্মৃতিফিতি এখন চলেনা। সব তো নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া তুমি আর কতদিন বাঁচবে?”
চোখের জল মুছতে মুছতে বৃদ্ধ বেশ কয়েকটি নীলকন্ঠ ফুল তুলে চাদরের মধ্যে নিলেন।
আমি বললাম, “তাহলে তো ছেলেদের ওখানে যাচ্ছেন। কোথায় ওরা থাকে?”
বৃদ্ধ নিঃশব্দে হাসলেন, “ওরা আমার জন্যে একটা বৃদ্ধাশ্রম ঠিক করেছে। কাল থেকে সেখানে…”।
আমার চোখে এক ঝলক কুয়াশা এসে লাগলো। ভাবলাম— এই সময়টা কাদের! আমারও তো একটা ছেলে৷ আমার যদি…!