আ মা র পু জো
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন বদলে যেতে থাকে সব। সমস্ত রঙগুলো কেমন যেন পাত পেড়ে বসে। কত পরিচিত মুহূর্তের মধ্যে এক পশলা আলাপী গল্প ছাড়া আর কিছুই হয় না। ছোটো থেকে আজ অবধি পুজো আসার প্রাক-অনুভূতি কিন্তু একই রয়ে গেছে। পুজো বলতে প্রথমেই এক ঝটকায় সারাদিনের আবহাওয়ার বদল মনে গেঁথে থাকে। রোদ্দুর ঝকঝক করে ওঠে। যত দুপুর গড়ায় কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে থাকে। রাতে গরম— বৃষ্টি— ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয়। এটাই বোধহয় জীবনের নিয়তি। উপলব্ধি করি প্রতি সেকেন্ডে প্রকৃতির বদল। সারা জীবনই প্রকৃতির প্রভাব আমার উপর মারাত্মক। প্রথমে ভাবতাম পাগল হয়ে যাচ্ছি। পরে এই নিয়ে পড়াশোনা করে আন্দাজ করতে পেরেছি এটা পাগলামি না। সাইকোলজির ভাষায় এর ব্যাখ্যাও আছে। আমার মনের উপর আমার চারপাশের মানুষের মতো প্রকৃতিও দৃঢ়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
ছোটোবেলার পুজো ছিল অনেক মোলায়েম আবেগ— বই নিয়ে বসতে হবে না, স্কুল ছুটি, নাচ প্র্যাকটিস করতে হবে না। যেন এক চরম শান্তি। আমাদের পুরোনো দিনের বড় খসে পড়া চুনবালির দেওয়ালের বাড়িতে শান্ত উলের বাঁদরের মতো ঘুরে বেড়িয়ে কেটে যেত সারাদিন। আরেকটু বড় হতে রবীন্দ্র, শরৎ, সুকুমার সরিয়ে… ‘শুকতারা’র সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে আসা বড়দের শারদীয়া পড়ার উত্তেজনা ছিল প্রথম নিষিদ্ধ আপেলের স্বাদের মতোই অম্ল মধুর। ঝলমলে রোদ্দুরের চোখে শূন্যতার উপলব্ধি করার বাজে অভ্যাসেরও সেই শুরু। আরও এক মজার স্বপ্নের শুরু হয়েছিল সেই শারদীয়ার সংখ্যার পাতা থেকেই। আমিও একদিন বড় লেখিকা হব। গম্ভীর মুখ করে হেঁটে যাব প্যান্ডেলের ভেতর। তারপর অটোগ্রাফ দেওয়া… আরও কত কী! শারদীয়ায় পাতায় পাতায় যেসব শাড়ির বিজ্ঞাপন থাকতো সেগুলোই মনে মনে জড়িয়ে নিতাম গায়ে। সবই জেগে জেগে ভাবতাম অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অবচেতনে… কখনো জানলার সামনে বসে কোলে শারদীয়া নিয়ে, কখনো বুকের ওপর রেখে পড়ন্ত রোদের আকাশ দেখতে দেখতে, ছায়া দেখতে দেখতে… একটা ঘোরের ভিতর ঢুকে যেতাম। এই ঘোর যখন কাটল তখন বদলে গেছে সব। পুজো হলো অনেকটা সেই রাজার গল্পের মৌমাছির মতো। মৌমাছি মধু নিয়ে যায় আর আসে। পুজোরও এই নির্বিকার আসা যাওয়ার ভেতর হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেলাম।
দু’পা হাঁটলেই ইছামতী নদী। শান্ত ইছামতীর জলকে এখন শুধুই বিসর্জনের শব্দে ভারী হয়ে উঠতে দেখি। পুজোর স্বাদ কি এভাবেই বদলে যায়?