বি শে ষ র চ না
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সবচেয়ে বড় পার্বণটি হল দুর্গোৎসব। দুর্গোৎসবকে ঘিরে বাঙালির উন্মাদনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে সমাজের প্রতিটি স্তর এই উৎসবে প্রভাবিত হয়। সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। শারদীয়া সংখ্যার ব্যাপকতা দেখে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পূজা সংখ্যা’ প্রবন্ধে বলেছেন—
“সাম্প্রতিককালে শারদীয়া পূজা উপলক্ষ্য করিয়া আমাদের মাসিক ও দৈনিক পত্রিকাগুলির সম্পাদকমণ্ডলী যে পূজা সংখ্যারূপে এক নূতন সংক্রামক প্রথার প্রবর্তন করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের মনন-জীবনে যে প্রতিক্রিয়া আসিয়াছে, তাহা মোটেই বহিরঙ্গ বলিয়া উপেক্ষিত নহে।”
(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)
বাংলা সাহিত্যচর্চা সবচেয়ে বেশি হয় পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। সারাবছর পত্রপত্রিকাগুলি দৈনিক থেকে শুরু করে দ্বি-মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বাৎসরিক ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হলেও দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ পত্রপত্রিকা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে এবং এই সংখ্যাগুলি ঘিরে সাহিত্যপ্রেমীদের মনে যথেষ্ট উৎসাহ থাকে। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ সংখ্যা অর্থাৎ শারদীয়া সংখ্যা বা পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হয় সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে যে প্রশ্নটি সবার মনে প্রথমে আসে সেটি হল, শারদীয়া সংখ্যার সূত্রপাত কবে থেকে এবং কোন পত্রিকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। প্রাবন্ধিক ও গবেষকদের অনুমান অনুযায়ী ১২৮০ বঙ্গাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের ‘সুলভ সমাচার’-এর একটি সংখ্যাকে আমরা প্রথম শারদীয়া সংখ্যা বলতে পারি। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১০ই আশ্বিন। এই বিশেষ সংস্করণটির দাম ছিল এক পয়সা। এ প্রসঙ্গে ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’ প্রবন্ধে সন্দীপ কুমার দাঁ জানিয়েছেন—
“…কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সংস্কার সভা’ তাদের তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার একটি সংস্করণ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রকাশ করেছিল ১২৮০ বঙ্গাব্দের পুজোর সময়। অবশ্য পুজো সংখ্যা বলে এতে কোনও উল্লেখ ছিল না, কারণ সম্পাদক কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্ম— স্বভাবতই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি।”
(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)
‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার বিশেষ সংস্করণটি যেমন প্রথম শারদীয়া সংখ্যা, তেমনই এই বিশেষ সংখ্যার বিজ্ঞাপনটি হল প্রথম শারদীয়া সংখ্যার বিজ্ঞাপন—
“ছুটির সুলভ!!
আগামী ছুটি উপলক্ষে সুলভের বিশেষ একখণ্ড বাহির হইবে!
উত্তম কাগজ, উত্তম ছাপা। দাম কিন্তু এক পয়সা।
মজা করে পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও। একটা পয়সা দিয়ে সকলের কিনিতেই হইবে। দেখ
যেন কেউ ফাঁকি পোড়ো না।”
(সন্দীপ কুমার দাঁ, ‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’)
এরপর আমাদের বেশ কিছুটা সময় অর্থাৎ ১৩২০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় প্রথম পূর্ণাঙ্গ শারদীয়া সংখ্যা পেতে। ১৩২০ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা তাদের পুজো সংখ্যা প্রকাশ করে। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এই পুজো সংখ্যাটিতে তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা সাহিত্যিক সত্যেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বিপিনবিহারী দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, নিরূপমা দেবী প্রমুখ লিখেছেন। এখন প্রশ্ন হল, ১২৮০ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩২০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত কি দুর্গাপুজোকে নিয়ে কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি? ‘সুলভ সমাচারে’র পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ শারদীয়া সংখ্যা বাঙালির হাতে পেতে ৪০ বছর সময় লাগলেও, এই সময়ের মধ্যে বলা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশের পূর্ব প্রস্তুতি চলছিল। এই সময়পর্বে (১২৮০-১৩২০ বঙ্গাব্দ) কোনো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ না হলেও দেবী দুর্গাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, মনোমোহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় ‘দুর্গাবন্দনা’ ও ‘দুর্গোৎসব’ নামক কবিতা প্রকাশিত হয়। এছাড়া ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকাতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে পুজোর পদ্য প্রকাশিত হত। এরপর ১৩২২ বঙ্গাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকার পুজো সংখ্যা ‘সচিত্র শারদীয় সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়। এই শারদীয়া সংখ্যাটিতে রঙিন ছবি, কবিতা আর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আলোচ্য পত্রিকাটিতে দুর্গাপুজো সম্পর্কিত কবিতা— ললিতচন্দ্র মিত্রের ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’, বিপিনচন্দ্র পালের প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালীর প্রতিমা-পূজা ও দুর্গোৎসব’, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীশ্রীদুর্গোৎসব’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধ ‘দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা’ ছাড়াও ভবানীচরণ লাহার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল।
১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটি প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ গল্পের মধ্যে পড়ে। এই কারণে ১৩২৯ সালের ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। ১৩৩২ সনে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের সম্পাদনায় ‘বসুমতী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ‘বসুমতী’র এই সংখ্যাতেই প্রথম শারদ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকার পুজো সংখ্যাতে রবীন্দ্রনাথের ‘পরিত্রাণ’ নাটকটিও প্রকাশিত হয়। এবার আসা যাক ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রসঙ্গে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতী’ পত্রিকার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শারদীয়া সংখ্যা ১৩৩৩ সনে প্রকাশিত হয়। ‘ভারতী’র পুজো সংখ্যার দাম ধার্য করা হয়েছিল এক টাকা। ‘ভারতী’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘ষোড়শী’। এর নাট্যরূপ দেন শিবরাম চক্রবর্তী। এই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতী’ কবিতাটিও প্রকাশিত হয়।
এবার আসা যাক বাণিজ্যিক পত্রিকা আনন্দবাজার প্রসঙ্গে। আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে ১৯২৬ সালে। আনন্দবাজার পত্রিকায় অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক লিখতেন। আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, বিধুশেখর শাস্ত্রী, অন্নদাশঙ্কর রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সজনীকান্ত দাশ প্রমুখ লিখতেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম শারদীয়া উপন্যাস প্রকাশিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের এই সংখ্যাতেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রবিবার’ গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দবাজার পুজো সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ (১৩৪৭) ও ‘প্রগতিসংহার’ (১৩৪৮) গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। আনন্দবাজার গ্রুপেরই পত্রিকা ‘দেশ’ তার প্রথম পুজো সংখ্যা প্রকাশ করে ১৩৪১ সনে। এই পত্রিকাতে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় আরো কয়েক বছর পরে অর্থাৎ ১৩৫৬ সনে। দেশ পত্রিকার প্রথম শারদীয়া উপন্যাস হল সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’। আনন্দবাজার গ্রুপের ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। ২০০৪ সালে আনন্দমেলা পত্রিকা দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ‘আনন্দমেলা’ এবং অল্প বয়সি তরুণ-তরুণীদের জন্য প্রকাশিত হয় ‘উনিশ কুড়ি’। যদিও ‘উনিশ কুড়ি’র মুদ্রিত সংস্করণ এখন আর প্রকাশিত হয় না। বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকার সমস্ত পত্রিকাই শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে।
বাণিজ্যিক পত্রিকার মধ্যে বর্তমানে প্রতিটি সংবাদপত্র দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে গল্প-উপন্যাস ও কবিতার পসরা সাজিয়ে পাঠকের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। এই পত্রিকাগুলির মধ্যে আজকাল, স্টেটসম্যান, প্রতিদিন, বর্তমান, এই সময়, উৎসব, শুকতারা, নবকল্লোল, ফেস্টিভ্যাল টাইমস, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাণিজ্যিক পত্রিকার আলোচনা প্রসঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন এসেই যায়। বাণিজ্যিক পত্রিকার মতোই লিটল ম্যাগাজিনও দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে কতগুলি লিটল ম্যাগাজিন শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে সেই তথ্য আমাদের হাতে নেই। এ নিয়ে বিস্তারিত কাজ করার অবকাশ থেকে গেছে। তবুও আমরা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের নাম করতে পারি যারা খুব ভালো শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করত বা এখনও করে থাকে। যেমন নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘এক্ষণ’, আসানসোল থেকে প্রকাশিত ‘কোলফিল্ড টাইমস’, আন্দামান থেকে ‘দ্বীপবাণী’, ‘অনুষ্টুপ’ প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিন উল্লেখ করার মতো শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে।
শুধুমাত্র সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত পত্রপত্রিকাই শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আকাশবাণী’র ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা, সিনেমা সংক্রান্ত পত্রিকা ‘উলটোরথ’ ও ‘প্রসাদ’-এর নাম করা যায়। বলা বাহুল্য যে ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাজার চুরাশীর মা’ প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনও শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে। যেমন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পত্রিকা ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার শারদ সংখ্যা, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের ‘তত্ত্বমসি’ শারদ সংখ্যা, আদ্যাপীঠ মন্দির থেকে প্রকাশিত ‘মাতৃপূজা’ প্রভৃতি পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাগুলি উল্লেখযোগ্য।
পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে দুর্গোৎসবে পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা বাঙালির জীবনে কতখানি জুড়ে রয়েছে। তাই বর্তমানে প্রিন্ট থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করছে। ব্লগজিন, ওয়েবজিন ও অনেক পত্রিকা তাদের ওয়েব সাইটে পুজো সংখ্যা এই মহামারীতেও পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে শারদীয়া সংখ্যার প্রকাশ মাধ্যমও পরিবর্তনের দিকে পা বাড়িয়েছে। মাধ্যম যাই হোক না কেন, লাভ বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যপ্রেমী পাঠকেরই।