আ মা র পু জো
মহালয়া শুনছে পাহাড়ের মাথা। আমি বার বার আমার মোবাইলের অ্যাপ থেকে দেখছি, গাড়িটা কোথায়। অল্প অল্প ঠাণ্ডা বাতাস আর ভোরের সুগন্ধ। অজানা পাড়া থেকে না বোঝা অথচ চেনা চেনা শব্দ– হিন্দিতেই তবু কথা বলতে হবে।
ষষ্ঠীর দিন। হোটেলেই আছি। কাজ শেষ। বিকেলের ফ্লাইটে বাড়ি, মানে কলকাতা ফেরা।
ফোন থেকে ট্র্যাক করতে করতে গাড়ি এলো। গাড়ি ছুটে চলে, জিপি-আর-এস ধরে কামাখ্যা মন্দিরের দিকে। পাহাড়ের অসাধারণ মেঘ আর জীবনের ফুটবল এবং উত্তেজনা– এই গুয়াহাটিতে এসেছিলাম অনেক ছোটবেলায় । স্মৃতি আর বড় হওয়ার ফিকশন পয়েন্টে, বাঙালী বিরোধী এই শহরে কুকুরের শেষ ঘ্রাণ নিয়ে, সেই মেয়েটির আঙুল থেকে, মদের দোকানের ঝিলিকগুলো বন্ধ। কাল রাতের বিয়ারের গন্ধ আর সেই মেয়েটিকে দেখে যাওয়া পাহাড়ি জ্যোৎস্না — অবিশ্বাসের দেওয়ালে হিসি করে যাওয়া মাতাল শব্দের গুলতিতে জোনাকি ধরতে ধরতে পাগল হয়ে গিয়েছে। ততদিনে শুনে ফেলেছি, বহিরাগত—বাঙালির বাচ্চা– সহকর্মী এসে বলেছে, ” তোর মতো এখানকার বাঙালীরা । ওরা ভীষণ চুতিয়া। আমাদের জমি, খাবার, চাকরি, নারী সব নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের সব লোকজন। অহিন্দু বা হিন্দু যাই হোক, আমরা মানব না।” পাহাড় বিয়োগ করে দিয়েছে — বিদ্বেষ হেসে বলে এটাই তো পরকীয়ার মজা। যেখানে আধ-একটু দরদ কিম্বা এগিয়ে যাওয়া ছিলো, সেখানে নেমে এসেছে এক তালিবানি অন্ধকার।
অঞ্জন দত্তের গান কানে বেজে ওঠে। ইয়োরোপীয়দের ছেড়ে যাওয়া ইতিহাসে গরু চরে বেড়ায় এখন । যিশু আর রামের দূরত্ব, মসজিদ কিম্বা মন্দিরের দূরত্ব যেখানে নেই হয়ে গিয়েছে, সেই উৎসবের সাজানো দুনিয়ায় কোনো সেন্সর নেই। পাহাড়ি রোদ্দুর বেয়ে আমি অবশেষে কামাখ্যার মন্দিরে। কিন্তু বিশাল লাইন। পুজো দেওয়া যাবে না। সুতরাং এদিক ওদিকে ঠেলে মন্দিরে ঘুরে একদম চটজলদি এয়ারপোর্ট, মানেই মুক্তি। বাড়ি যাওয়া। পুজোতে বাড়ি যাব না??
বান্ধবীদের ফোন। আসলে কলকাতার বাইরে থাকলে বোঝা যায় শহরটার গুরুত্ব আর আধুনিকতা। কলকাতার ভিতরের আন্তর্জাতিকতার মাইক্রো-প্ল্যানিং, বম্বে বা দিল্লিতে কিছুটা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভারতবর্ষের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। হায়দ্রাবাদ কিছুটা ইতিহাস, কলকাতার চেনাগলি ভেবে ঢুকে বুঝেছি- না, আলাদা কোথাও আছি। আমার মনে আছে, শ্রীনগরে আবিদ-জীর বাড়িতে বিরিয়ানি খাওয়া, ওয়ারিংগমের সঙ্গে লোকাল মদ আর কুকুরের মাংস, ব্রহ্মপুত্রের চরে ইলিশ মাছ ভাজা আর স্মারনভ– আমি তো গান গাইতে পারি না, ছবি আঁকতে পারিনা, না হলে যৌন-মিলনের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, প্রকৃতিতে। চাপিয়ে দেওয়া ভারতবর্ষ আর জমে থাকা ইয়োরোপের সিভিল-ওয়ার দেখতে দেখতে কখনো তেলেঙ্গানার লাইট-পোস্টে লাল নিশান শুকনো কাঠি হয়ে গেছে, শিল্প-তালুকে উড়েছে গেরুয়া পতাকা, পীরদের – ফকিরদের আস্তানা থেকে পালিয়ে আসা জামাত কোনো অহংকার বলে ওঠে, ” আমি যাব না”। কোথাও হিন্দু না হলে জল পর্যন্ত দেওয়া হয় না। কোথাও ধর্ম বদলে দেওয়া হয় খাদ্য, অর্থের বদলে। কোথাও সোশালিস্টরা দালাল হয়ে ওঠেন। কোথাও মন্দিরের পুরোহিত দাঙ্গা আটকে দেন, কোথাও মৌলানা চিৎকার করে সব ধর্মকে সম্মান করতে বলেন। এটাই আমার দেশ, যেখানে মিনি-স্কার্ট থেকে পর্দা প্রথা, পর্দা প্রথা থেকে বোরখা– সংস্কৃতি, মানুষজন তবু ভালোবাসা, সম্মান, নারী-স্বাধীনতাকেই ধর্ম বলে মনে করেন।
মণিপুরের সেই মেয়েটি, যিনি বিয়ারের বোতল আর এক-চুমুক সিগারেট খেয়ে গানে কোহেন হয়ে যান, আবার যিনি শরীরে বোমা বেঁধে হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। বিভেদের ভিতর থেকে আমি দেখি, একটি ছেলে গেয়ে উঠছেন জীবনের গান। কানহাইয়া কুমার। আমাদের দেশ একটা স্বপ্ন। একটা চমৎকার। চমৎকারের আদান প্রদানে যেভাবে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছে, সেখানে অন্ধকার আছে, আলো আছে আর আছে গভীরতা। প্রকৃতির সেই ভীষণ না- মানা, সেই বিশাল নগ্নতায় নেশাতুর ডাইনোসর।
ভাষা – উৎসব – সংস্কৃতির আকাশে একের ভিতর অনেকে লুকিয়ে আছে…
অথচ জাতীয় সঙ্গীতের আওয়াজ পেরিয়ে, আমার কানের দিকে অথবা জানলায়, ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স।