বাং লা দে শে র গ ল্প
অপরিচিত কোনো জায়গায় যেতে হলে মা-বাবার অনুমতির প্রয়োজন বলে মনে করল নিনাদ। তাছাড়া শুধু জায়গাটা অপরিচিত নয়, লোকগুলোও চেনা-জানা নয়। এই কদিনে কতটুকুই বা জেনেছে অথই সম্পর্কে! সুতরাং অনুমতির বিশেষ প্রয়োজন, কিন্তু মনে মনে লজ্জা পাচ্ছিল নিনাদ। কীভাবে কথাটা তুলবে, কীভাবে বলবে। তবু যেতে তো হবে, তাই ও মায়ের সঙ্গে শেয়ার করল। সব শুনে মা হেসে বলেন, কবে তুই বড় হয়ে গেলি নিনাদ, একটুও টের পেলাম না।
: কি যে বলো আম্মু, আমি তো এখনো শিশু।
একথা বলে নিনাদ মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দেয়। মা আদর করতে করতে বলেন, ঠিক আছে বাবা, তোর ভালো লাগলে অবশ্যই যাবি। দেখি তোর আব্বুকে বলছি–। এই যে শুনছো, কই গেলে– দেখো তোমার ছেলে কী বলছে।
: আম্মু–।
: উঁহ, আর কথা নয়। এবার আমার ওপর ছেড়ে দে।
বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, কী ব্যাপার, মা-ছেলেতে কী পরামর্শ চলছে শুনি।
মা বললেন, তোমার ছেলে যে বড় হয়ে গেছে সে-খেয়াল আছে?
বাবা বললেন, কেন, কী হয়েছে বলো তো? প্রেমে পড়েছে নাকি?
বাবার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। নিনাদ উত্তর করল, না আব্বু, প্রেমে পড়িনি। তবে পড়ব বলে ভাবছি।
: কি সাংঘাতিক! ভুলেও ও-কাজটি করতে যেও না। দেখছো না, তোমার মাকে নিয়ে আমি–।
: আহ্! থামো তো?
মা থামিয়ে দিয়ে বলেন, এখন ছেলের কথা ভাবো। নিনাদ নাকি দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবে। কোনো বন্ধুকেও সাথে নিবে না। একা একা ওকে ছাড়ি কেমন করে?
: প্রেম করতে হলে বা প্রেমে পড়তে হলে তো একাই যেতে হবে, নাকি? কিন্তু আমি বলছিলাম কি নিনাদ, সামনে তোমার বিসিএস পরীক্ষা–। এ সময় এসবের মধ্যে না জড়ালে ভালো হয় না–?
: পরীক্ষার আরো তিন মাস বাকি। আমি সব গুছিয়ে নেবো। কেন, তোমার ছেলের ওপর আস্থা নেই আব্বু?
: আস্থা থাকবে না কেন? আমার একটি মাত্র ছেলে– অনেক বড় অফিসার হবে। এই স্বপ্ন তো আমি দেখি বাবা।
: তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। তবে আমি পুলিশে ঢুকব না, পুলিশ অফিসার হবো না, আগেই বলে রাখছি।
মা বললেন, কেন, পুলিশ খারাপ হবে কেন? দেখিসনি তোর বড় মামা কত বড় পদে আসীন হয়েছে?
: মামাকে দেখেই তো বলছি। কত ভালো একজন মানুষ অথচ দেখেছি অফিসে বকাবকি ছাড়া কথাই বলেন না। কি বিশ্রী ভাষা রে বাবা!
মা-বাবা দুজনেই হেসে ফেললেন। নিনাদ বলতে থাকল, তবে বিসিএস পাস করলেও ভালো কোনো ডিপার্টমেন্টের নিশ্চয়তা কম। বুঝলে আব্বু, আমার এক বন্ধুর বড় ভাই– তিনি কখনো গান-কবিতা পছন্দ করেন না, গান শুনতেও অতটা ভালোবাসেন না এবং গান সম্পর্কে তেমন ধারণাও নেই। অথচ তাঁকে দেয়া হয়েছে রেডিওতে সংগীত বিভাগের পরিচালক পদে। হা-হা-হা। কি মজার কাণ্ড দেখেছো? আমলারা বুঝতেও চায় না কে কোথায় যোগ্য। তা আমি যাচ্ছি তো আম্মু? কী বলো আব্বু?
মা-বাবা দুজন একসাথেই কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। পরে মা বললেন, মেয়েটির বাড়ি কোথায়?
: রাজবাড়ী।
: রাজবাড়ীর কোথায়?
: কালুখালি জংশন নামে একটি রেল স্টেশন আছে, সেখানে।
বাবা বললেন, পরিচয় কিভাবে?
: ফেসবুকের মাধ্যমে।
: ঐ ফেসবুকই তোমাদের মাথা খেয়ে ফেলছে।
মা তাকে থামালেন, আহ্ থামো তো? প্রযুক্তিকে অস্বীকার করবে কী করে?
: অস্বীকার করছি না, তবে তার অপব্যবহার নিয়ে বলছি।
মা বললেন, বাদ দাও এসব।
: দিলাম বাদ।
মা এবার নিনাদকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি দেখতে কেমন?
: খুব সুন্দর, তবে তোমার মতো এতটা নয়।
: তাকে পেলে আবার আমাদেরকে ভুলে যাবি না তো? আজকাল এমনটা হচ্ছে হরহামেশাই। মা-বাবাকে ওল্ডহোমে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
: আমি তোমাদেরকে চাইল্ড হোমে পাঠাবো। অথই যদি আমার বউ হয়ে আসে, ওকে বলব, এই বাচ্চা দুটোকে সেবা যত্ন করে গড়ে তুলতে হবে।
: কী বললি! আমরা বাচ্চা? দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে–।
নিনাদ এক দৌড়ে বের হয়ে নিজের ঘরে যায়।
অনলাইনে অথইকে পাওয়া গেল না। আগামীকাল বিকালে নিনাদ ওদের বাড়ি যাবে এ-সংবাদ দেয়া দরকার। অনলাইনে অবশ্যই আসবে, না এলে ফোন করে জানাবে। পড়ার টেবিল থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল নিনাদ।
অথই-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা বেশ মজার ছিল। নিনাদ ফেসবুকে ওর বন্ধুদের স্ট্যাটাসে লাইক-কমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। তখন অথই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে নিনাদ ওর প্রোফাইলে ঢুকে দেখল প্রোফাইল লক্ড। কিন্তু হলুদ সর্ষে ক্ষেতে লাল শাড়িতে চমৎকার ভঙ্গিমার প্রোফাইল পিক-টি দারুণ আকর্ষণীয় মনে হলো। সেই সঙ্গে এটাও মনে হলো এই পিক-টি এই আইডির মালিকের নয়। এটা হয়ত কোনো ছেলের আইডি। আজকাল অহরহ এমন আইডি খুলছে ছেলেরা। আবার অনেক মেয়েও আছে যারা ছেলের নাম দিয়ে আইডি খোলে। কোনোটাই নিনাদের পছন্দ নয়। নিনাদ ইনবক্সে লিখল, আপনি রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। প্রোফাইল লক্ড না থাকলে কিছুটা আন্দাজ করতে পারতাম।
উত্তরে অথই টেক্সট করল, আমি রিকোয়েস্ট পাঠালেই তোমাকে একসেপ্ট করতে হবে এমন কথা নেই।
মহাফাঁপড়ে পড়ল নিনাদ। শুরুতেই সম্বোধন ‘তুমি’? তাছাড়া লক্ড প্রোফাইল নিয়েও অহংকার। এটা নিশ্চয়ই ছেলে এবং ধুরন্ধর। একসেপ্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই নানা অজুহাত দিয়ে টাকা চাইতে থাকবে। এটা নিনাদ আগেও প্রমাণ পেয়েছে। ইনবক্সে কয়েকটি সুন্দর ছবি দিয়ে একটি মেয়ে জানালো তার পরীক্ষার ফিস জমা দিতে পারছে না, ৫০০০ টাকা এই মুহূর্তে ভীষণ জরুরি। তার টাকার সংস্থান হয়ে গেলে টাকাটা ফেরৎ দিবে। মেয়েটির প্রোফাইলে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি লেখা আছে সুতরাং অবিশ্বাসের কিছু নেই। নিনাদ তার বিকাশ নাম্বার নিয়ে ৫০০০ টাকা পাঠিয়ে দিলে সে থ্যাংকস জানালো। এই টাকা পেয়ে তার খুব উপকার হয়েছে, না হলে পরীক্ষা দিতে পারতো না ইত্যাদি। এভাবে মাঝে-মধ্যে সে নিনাদের সাথে ইনবক্সে টেক্সট আদান-প্রদান করে। সামনে ইদ থাকায় একবার সে বলল ইদে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট যেতে হবে অথচ নতুন কোনো জামাকাপড় কিনতে পারেনি। নিনাদ বলল, তোমার ঠিকানা দাও আমি গিফট পাঠিয়ে দেব। শাড়ি নাকি থ্রি-পিস পছন্দ তোমার?
সে বলল, থ্রি-পিস। তবে তুমি টাকা পাঠালে আমি কিনে নেব আমার পছন্দমতো।
নিনাদ সরল বিশ্বাসে আবার ৫০০০ টাকা পাঠিয়ে দিল। উপহার হিসেবে নয়, উপকারের কথা ভেবেই। নিনাদকে সে একটি থ্রি-পিসের পিক ইনবক্সে দিয়ে বলল, এটা কিনেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?
নিনাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনে রেগে গেল। ও লিখল, ড্রেসটি তুমি পরে একটা ছবি দাও। তাছাড়া তুমি যখন ভিডিও কলে অভ্যস্ত নও, তখন আমি এমন একটা পিক আশা করতেই পারি।
: এভাবে পিক দিতে গেলে জামার ভাঁজ ভেঙে যাবে। ভাবছি বাগেরহাট গিয়ে একবারে ইদের দিন তোমাকে সারপ্রাইজ দেব।
: ভাঁজ তো আগেই ভেঙে ফেলেছো।
: তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো? ঠিক আছে, তোমার মতো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব রাখা যায় না।
ব্লক খেয়ে নিনাদের টাস্কি খাবার যোগাড়। কী এমন কথা হলো যে এক কথাতেই বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেল? আজকাল এমন ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কম নেই। সুতরাং অথইকে বিশ্বাস করার মতো কোনো প্রমাণ পাচ্ছে না। তবু একটা কৌতূহল থেকে নিনাদ ওর রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল। তখন ও দেখতে পেল অথই-এর আরও বিভিন্নরকম পিক আছে। বান্ধবীদের সঙ্গেও আছে। সবখানে ওকে সবার উপরে লাগছে। যেমন মিষ্টি হাসি তেমন মিষ্টি মুখ। কোনো কোনো নায়িকার সাথে তুলনা দেয়া যায়, কিন্তু তার কি কোনো দরকার আছে, যে কিনা নিজেই অতুলনীয়?
নিনাদ লিখল, তোমাকে বন্ধু করতে পেরে নিজেই ধন্য হলাম বন্ধু।
: ধন্যবাদ। আমিও তোমার মতো বন্ধু পেয়ে ধন্য।
সেই থেকে শুরু। তারপর কোথায় থাকো, কী করো, কখন ফ্রি থাকো এসব নিয়েই উভয়ের আলাপ চলতে থাকে। একপর্যায়ে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে কথা বলা। এরপর ভিডিও কলে একে অপরকে দেখে কথা বলা। সবকিছুতেই নিনাদের আনন্দ। গ্রামের এমন একটি সহজ সরল মেয়েকে সত্যিই ভালোবাসা যায়। কিন্তু ভালোবাসার কথা কখনো বলা হয়নি। না নিনাদ বলেছে, না অথই। রাজবাড়ীর কালুখালিতে বাড়ি হলেও অথই পড়ালেখা করছে ফরিদপুর রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। অকপটে ও জানিয়েছে ওদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো নয়। কিন্তু অন্যদের মতো কখনো বলেনি টাকা দাও। এমনকি নিনাদ একবার যখন বলেছিল আমি কিছু টাকা তোমার ফোনে ফ্লেক্সি করে দিই, তখন অথই ফুঁসে উঠেছিল, কেন?
এভাবেই কথা চলতে চলতে একদিন নিজ থেকেই নিনাদ বলল, আমি তোমাদের বাড়ি যেতে চাই।
ইয়ার্কি মনে করে অথই মুখ ভেংচিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, আমি তোমাদের বাড়ি যেতে চাই, ঢং আর কি!
অদ্ভুত মুখভঙ্গি দেখে নিনাদের আরো ভালো লাগে। বলল, না, না, সত্যিই বলছি অথই– আমি তোমাদের বাড়ি যাব। তোমাকে দেখতে।
: এখনো তো দেখছো।
: ছুঁয়ে দেখতে চাই। সত্যিই তুমি মানুষ নাকি পরি!
: পরি। জানো তো পরিরা আগুনের তৈরি। ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে মরবে। বুঝেছ মাই ডেয়ার ফ্রেন্ড?
: খুব বুঝেছি। তোমাকে ছুঁয়ে, পুড়তেও আনন্দ আছে।
: প্রেমে পড়ে গেলে নাকি?
নিনাদ আর কথা বলতে পারে না। অথই আবার বলে, এই যে মিস্টার, হ্যালো মিস্টার– বলছি তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে গেলে?
অথই-এর কথা শেষ হতে না-হতেই ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। নিনাদ বলল, আবার বুঝি ট্রেন আসছে? তোমার ওখানে ঘনঘন ট্রেন যাতায়াত করে বোধ হয়।
: অতটা নয়, তবে জংশন স্টেশনে ইঞ্জিন বদলানোর ব্যাপার থাকে তো, হুইসেল আর ট্রেন চলার শব্দ একটু বেশি থাকে।
: ইঞ্জিন বদলানো মানে? এখানে কি নতুন ইঞ্জিন জোড়া হয়?
অথই হেসে ফেটে পড়ে। ট্রেন চলার মৃদু শব্দে ওর হাসিটা আরও চমকপ্রদ হয়। অথই হাসতে হাসতেই বলে, তুমি সত্যিই জানো না ইঞ্জিন কীভাবে বদলায়?
: না, জানি না।
: ইঞ্জিন একদিক থেকে ঘুরিয়ে বগির অন্যদিকে জোড়া দিলে তাকে বলে ইঞ্জিন বদলানো।
: কিছুটা বুঝছি। পুরোটা বুঝতে প্র্যাকটিক্যালি দেখতে হবে। আচ্ছা, ট্রেনের শব্দে তোমার ঘুম ভেঙে যায় না?
: না, অভ্যাস হয়ে গেছে। যাক, ঘুমের কথা মনে করিয়ে ভালো করেছ, আমি এখন ঘুমাবো।
: ঠিক আছে, ঘুমাও। আমার একটু পড়া আছে, শেষ করেই ঘুমাবো।
এভাবে দু’জনের মধ্যে প্রতিদিন কথা হয়। দু’জনেই কথা বলতে কেন এত আকর্ষণ বোধ করে তা কেউ তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে না। ফেসবুক বন্ধুও যেন সহপাঠী বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে কখনো কখনো। অনেক ছেলে-মেয়েই অনেক বাজে বিষয় নিয়ে আলাপ করে, কিন্তু ওরা দু’জন কখনো সে-ধরনের আলাপ করেনি। এজন্য দু’জনকে দু’জনই পছন্দ করে। একবার একটি মেয়ে সরাসরি নিনাদকে ভিডিও কল করল। নিনাদ রিসিভ করে দেখল মেয়েটি বুক খুলে হাসছে। শুধু তাই নয়, এক হাতে নিজের স্তন ধরে নাড়া দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে নিনাদ বলল, অনুমতি ছাড়া এভাবে কাউকে কল করা ঠিক নয়।
: ইস, দেমাক কত? কত বেডায় আমারে দেখবার জন্যি হুমড়ি খাইয়া পড়ে। বেডা শয়তান জানি কোহানকার?
উল্টো নিনাদকেই শয়তান বলে ব্লক করে দিল। এরকম ঘটনা অথইয়ের ক্ষেত্রেও আছে। কল রিসিভ করে অপ্রস্তুত অবস্থায় ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি কল কেটে দিল। তাকে ব্লক করল এবং সেই থেকে অনুমতি ছাড়া কোনো কল রিসিভ করে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে নিনাদের মতো একটি ভদ্র ছেলে আর হয় না। মাঝে মাঝে দুষ্টামি করলেও সেটা আনন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
নিনাদ একদিন খুব সিরিয়াস হয়ে বলল, আমি তোমাদের বাড়ি যেতে চাইলাম তুমি তো কিছু বললে না?
: আগে বলো এখানে কেন আসতে চাও?
: অনেকগুলো ব্যাপার আছে।
অথই একটুক্ষণ ভেবে নিল। ব্যাপার আছে মানে তো অন্য কিছু। তবে কি নিনাদ সত্যিই তাকে ভালোবাসে নাকি পাগলামি থেকে বলছে? অথই বলল, একটা একটা করে বলো, একসঙ্গে জবাব দিতে পারবো না।
: প্রথমত কৃষিকাজ। তুমি বলেছিলে তোমার বাবা কৃষিকাজ করে, আমি দেখতে চাই।
: দ্বিতীয়ত?
: দ্বিতীয়ত আমি বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে চাই তোমার মতো।
: তুমি কি মাছ ধরতে পারো?
: না। তুমি শিখিয়ে দেবে।
: আর?
: তোমাকে শর্ষেক্ষেতে দাঁড় করিয়ে তোমার সাথে সেল্ফি তুলব। তুমি থাকবে লাল ড্রেসে আর আমি সবুজ।
: দু’জন মিলে বাংলাদেশ?
: আরে না, না–। দু’জনে কি একটি দেশ হয়? তোমার সুন্দর সুন্দর পিক দেখে আমারও ইচ্ছে হলো প্রকৃতি আর প্রকৃতি প্রদত্ত একজন মানুষের সঙ্গে আমার একটা কোনো চিহ্ন থাক।
: বাব্বাহ্! এতদূর! আর?
: তোমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখব। পুকুর চালায় নারকেল গাছে, বাড়ির পাশে বাঁশবাগান, সুপারিবাগান– ইত্যাদি। সব দেখব।
: আমাকে দেখবে না?
: তোমাকে তো সব সময় দেখি। শুধু ছুঁয়ে দেখা বাকি। অনুমতি দিলে ছোঁবো।
: অত সোজা নয়।
: সে দেখা যাবে। আগে যাই তো। আমি কি যে করব তুমি ধারণাই করতে পারছো না। তোমাকে পাগল করে ফেলব। আর আমি তো পাগল হয়েই আছি।
: সত্যিই তুমি একটা পাগল।
: আচ্ছা তোমার গলায় কি ওটা স্বর্ণের চেইন?
: না, এমিটেশন। কেন বলো তো?
: না, এমনি। ওটার লকেট আছে না? ওড়নাটা একটু সরাও না, দেখি।
: মানে কি মিস্টার?
: মিস্টার মিস্টার করো কেন? আমার নাম নেই? সরাতে বললাম, লকেটটা দেখতে চাইলাম আর তুমি কি না–।
: আমাকে অত বোকা ভাবো কেন? লকেট দেখতে চেয়েছ, দেখাচ্ছি– এই দ্যাখো–। চেইনটা হাত দিয়ে লকেটসহ বের করে এনে দেখালো অথই। কিন্তু ওড়না সরালো না। নিনাদ ওর টাউজারের দিকে একটি হাত দিয়ে চুলকাতে থাকলে অথই বলল, এটা কী হচ্ছে?
: চুলকানি। বড্ড চুলকানি।
: চুলকানি হলে চুলকাও। তা আমাকে দেখাচ্ছ কেন?
: মেজাজটা জানা হলো।
: আমার মেজাজ সবসময় নরম।
: আমারটা আরো নরম। কখনো রাগাতে পারবে না।
: তোমারটা মানে? কোনটা? ফাজিল একটা–।
অথই হাসতে থাকে। নিনাদ বলে, আমি কোনোই ফাজলামি করছি না। আমি মেজাজের কথা বলছি।
: তোমার মেজাজ আমি চিনি। পাকামি আর ন্যাকামিতে ভরা।
: আর তুমি কী?
: আমি ট্রেনের ইঞ্জিন ঘোরানোর মতো—দু’দিকেই চলি।
: স্বীকার করলে তাহলে?
: সত্যকে অস্বীকার করব কেন?
এর কয়েকদিন পর অথই হঠাৎ সেলফোনে রিং করল। নিনাদ একটু অবাক হয়ে রিসিভ করলে অথই বলল, একটা দারুণ খবর। তুমি রোজ রোজ আমাকে বলো আমাদের বাড়ি আসতে চাও। মা-বাবা ও বড় ভাইকে তোমার কথা বলেছি। সবাই রাজি হয়েছে। এখন তোমার যেদিন খুশি চলে আসতে পারো।
: কী বলছো তুমি? সত্যি তো?
: আরে বাবা, হ্যাঁ। সত্যি না হলে এখন ফোন করতাম?
: খুব খুশি লাগছে আমার। কবে যাব তোমাকে জানাবো।
: এতদিন তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে, এখন আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
রাত ১১টার দিকে ম্যাসেঞ্জারে কল করল অথই। নিনাদ তথন কাপড়চোপড় গুছিয়ে লাগেজে ভরছিল। অথই বলল, কী করছ?
: কাপড় গোছাচ্ছি।
: কেন? কোথায়ও যাচ্ছ নাকি?
: হ্যাঁ। আমি আগামীকাল বিকালে তোমাদের বাড়িতে আসছি। সকালে একটু পারসোন্যাল কাজ আছে।
: তা বলোনি তো?
: ভাবছিলাম তুমি অনলাইনে এলে তোমার চাঁদমুখটি দেখে কথাটা বলব।
: আমারটা যদি চাঁদমুখ হয় তোমারটা সূর্যমুখ। আলোও বেশি, তেজও বেশি।
: তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। কাল সামনাসামনি কথা হবে। তখন একটু রেহাই দিও, কেমন?
: ওকে মাই ডিয়ার।
সকালে নিনাদ যমুনা ফিউচার পার্ক গিয়ে লকেটসহ একটি স্বর্ণের চেইন কিনল। অথই সত্যি বলেছে নাকি মিথ্যা বলেছে সেটা বড় কথা নয়। ওর ঐ চেইনটা ইমিটেশন হোক আর গোল্ড হোক, নিনাদ ওকে আরেকটি চেইন উপহার দিতেই পারে। তাছাড়া গতরাতে যখন ও গিফট দেয়া নিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যায় তখন মা নিজে থেকেই চেইনের কথা বলেছেন এবং পুরো টাকাটাও তিনি দিয়েছেন। চেইন কিনে বাসায় এলে মা বললেন, আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।
: কোনটা পছন্দের কথা বলছো আম্মু?
: দুটোই।
: ধ্যাৎ, কি যে বলো না আম্মু। আমি তো এখনো ওকে ভালোবাসার কথা বলিইনি।
: তাতে কী হয়েছে, এবার গিয়ে সামনাসামনি বলবি।
: তুমি যে একটা কী না আম্মু–।
মা ওকে গাড়ি দিতে চাইলে নিল না। গাবতলী গিয়ে ঢাকা-রাজবাড়ী টিকেট না কেটে নিনাদ ঢাকা-কুষ্টিয়া টিকেট কাটলো। কারণ ও জেনেছে রাজবাড়ী থেকে আবার আরেকটি গাড়িতে কালুখালি যেতে হবে। এই পরামর্শটাও অবশ্য অথই দিয়েছে। কালুখালি স্টপেজে নামলে দেখলো অথই ওকে নিতে এসেছে। ওখান থেকে ভ্যানে করে যেতে হবে। অথইদের বাড়ি অবশ্য কালুখালি স্টেশনের কাছে রতনদিয়া বাজারের পাশে।
বিকালে অথই যখন নিনাদকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গেল তখন অথইয়ের মা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আগে থেকেই তৈরি করা পিঠা ও অন্যান্য খাবার এনে দিলেন। সুস্বাদু এসব পিঠা খেয়ে নিনাদ ভীষণ খুশি। এরপর নিনাদকে নিয়ে অথই সারা বিকেল ঘুরে বেড়ালো। মাঠ, ঘাট, পুকুরে মেয়েদের গোসল, মাঠে কৃষকের আনাগোনা, সারি সারি নারকেল গাছ, সুপুরি বাগান, বাঁশঝাড় সব দেখা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল দুজন।
অথইয়ের মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। অথই গেল একটু সাহায্য করতে। মা বললেন, আমি একলাই পারবোন রে মা, তোরে লাগবিন নে। তুই যা দ্যাখ ছাওয়ালডার কিছু লাগবি কি না।
পাশে বসে থাকা ওর বাবাও বললেন, যা মা তুই পোলাডারে দ্যাখ য্যান যত্ন-আত্তি কম না হয়। আজার অইলেও শহুরে পোলা, এই গৈগেরামে কি তারে মানায়? যা মা যা– আমি জ্বাল দিতেছি।
অথই কিছু না বলে উঠে গিয়ে নিনাদের ঘরে যায়। নিনাদের ঘর মানে ওর বড় ভাইয়ের ঘর। বড় ভাই হাশেমের ঘরে নিনাদকে থাকতে দেয়া হবে বলে আগে থেকেই বিছানাপত্র পাতা হয়েছে। কাঠের বাক্স থেকে নতুন কাঁথা আর বালিশ বের করা হয়েছে। নিনাদ জানতে চাইল, আমি এখানে থাকলে তোমার ভাই কোথায় ঘুমাবে?
: সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। সব আগে থেকেই ঠিক করা আছে। ভাই তার বাজারের দোকানে থাকবে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে। সেই বন্ধুও আজ আমাদের বাড়িতে খাবে।
: বাহ্! মজার বিষয় তো। কিন্তু তোমার ভাই বিয়ে করছে না কেন?
: আমাকে বিদায় না দিয়ে সে বিয়ে করবে না।
: বিদায় না দিয়ে মানে?
: এটাও জানো না? মানে আমাকে বিয়ে না দিয়ে–।
: ও আচ্ছা! তা তুমি বিয়ে করছো না কেন?
: পাত্র খোঁজা হচ্ছে। মামারা উঠেপড়ে লেগেছে। আমি বলেছি, মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার তো–। পরীক্ষাটা দিয়েই ঝুলে পড়ব।
: দারুণ হবে। আমিও তিন মাস পর ফ্রি হচ্ছি।
: তোমার ফ্রি হওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কী?
: না, না– এমনি বললাম আর কি। যদি নিমন্ত্রণ পাই, আসতে হবে তো!
রান্নাঘরে তখন অথইয়ের বাবা ওর মায়ের সাথে চাপাস্বরে কথা বলছিল যেন কেউ শুনতে না পায়।
: শুনচো অথোর মা, ছাওয়ালডা এক্কেবারে রাজপুত্তরির মতোন। যেমন চেহারা তেমন আদব লেহাজ–। আমারেও এটুদান হিংসে কইরলো না। পায়ে আত দিয়ে সালাম করে কইলো কেমন আছেন খালুজান? তুমি কও দেহি–।
: আমি কী কবো। এদ্দিন জানতাম মাইয়া মানুষ ছাওয়ালগের দিক তাহায়, এহন দেকতেছি–।
: বাহ্– আমার মাইয়া নাই বুঝি?
: তুমি যে কী স্বপ্ন দেকতাচো অথোর বাপ–। ছাওয়ালডা আয়ছে বেড়াতি–। তেমন কিছু অইলে তো অথো আমারে কইতো। নাও খড়িডা লাড়া দাও, জ্বাল কমে আসতেছে–।
লাকড়ির গোড়া ধরে নেড়ে চুলার আগুন বাড়িয়ে দেয় অথইয়ের বাবা।
বারান্দায় পাটি পাতা হয়েছে রাতের খাবারের জন্য। একটু আগে অবশ্য হাশেম তার বন্ধুকে নিয়ে এসে খেয়ে গেছে। নিনাদের সঙ্গেও নিজের দোকান কেমন চলে না-চলে এ নিয়ে কথা বলে গেছে। অথই বলল, তুমি তো পাটিতে বসে অভ্যস্ত না, আমার পড়ার টেবিলে তোমাকে খেতে দিচ্ছি।
নিনাদ বলল, লাগবে না। আমি একসঙ্গে বসে খাবো। বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গেই বসি।
অথইয়ের বাবার নিষেধও শুনলো না। পরে অথই, নিনাদ ও অথইয়ের বাবা একসঙ্গে খেতে বসলে অথইয়ের মা পাতে খাবার তুলে দিলেন। নিনাদ তাঁকেও বসতে অনুরোধ করল- খালাম্মা আপনিও বসুন না আমাদের সঙ্গে।
মা খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, আমি বসলি বাইড়ে দিবি কিডা বাজান? তুমি খাও আমি তুইলে দিচ্ছি। এই যে ছোড মাছের চচ্চরি– অথো কইছে ছোড মাছ নাকি তোমার পছন্দ– বাজারে এহন অত পাওয়া যায় না– তিতপুঁটি আর টেংরা–।
নিনাদ মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করে অথইকে জিজ্ঞেস করল, তিতপুঁটি কী?
: তিতপুঁটি চেনো না? পুঁটি মাছ ছোট হলে তিতপুঁটি আর বড় হলে সরপুঁটি।
অথইয়ের কথা শুনতে পেয়ে ওর মা হাসেন, ছাওয়ালডা তিতপুঁটিও চেনে না। তিনি বলেন, এইটা রুই মাছের মুড়িঘন্ট আর এইডা খাসির কইলজা বুনা–।
নিনাদ বলল, এ সবই তো আমার পছন্দের খাবার। তা সব একবারেই রান্না করেছেন কেন খালাম্মা? আমি তো দু’দিন থাকব। আপনার মেয়েটারও একেবারেই বুদ্ধিসুদ্ধি নেই।
: ক্যান, মাইয়াডা আবার কী দোষ কইরচে?
: আমার কাছ থেকে সব জেনেছে কী খাবার পছন্দ করি না-করি। আর সে কিনা সেগুলো হাজির করিয়ে ছাড়লো?
অথই হাসতে থাকে। বাবাকে বলে, বাজান, কাল ক্ষেপলা জাল ফেলবা পুহুরে। তাজা মাছ কেমনে ধরে তারে দেহাবো।
আবার হাসে।
রাতে শোবার সময় অথই এসে বলল, যদি বাথরুমে যেতে হয় আমাকে ডাকবে, আমি পাশের ঘরেই আছি।
এটা একটা সমস্যা বটে। এখানে এটাচ বাথ নেই। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের পেছনে ছোট একটি টয়লেট। প্লাস্টিকের প্যান বসানো। বদনায় করে পানি নিতে হয় টিউবওয়েল থেকে। নিনাদের জন্য এটা বেশ অস্বস্তিকর হলেও হাসিমুখে গ্রহণ করে নিয়েছে। কেন এমন পরিবেশ গ্রহণ করে নিয়েছে তা নিজেও জানে না। বিছানায় একটি তোশক দেয়া হয়েছে সেটাও বেশ শক্ত। ঘুম হবে কি না কে জানে। আর মাঝে মাঝে ট্রেনের শব্দ তো আছেই। তবু নতুন পরিবেশে নিজেকে নতুন লাগছে। মা-বাবার সঙ্গেও কথা বলেছে কয়েকবার, খুব ভালো লাগছে বলে। এরা নিজেরাই কত গরিব অথচ বিকালে ঘুরে বেড়ানোর সময় অথই বলছিল লাউ-কুমড়া কিছু বিক্রি করা হয়, কিছু গরিব মানুষদের দিয়ে দিই; তরমুজ হোক, শশা হোক, ডাঁটা হোক, যখন যা হয় বিক্রির পাশাপাশি গরিবদেরকেও দেয়া হয়। অদ্ভুত ব্যাপার।
নিনাদ বলল, প্রয়োজন হলে তোমাকেই ডাকব ম্যাডাম। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। যাও শুয়ে পড়।
দু’জন পাশাপাশি ঘরে শুয়েও ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট শুরু করল। নিনাদ লিখল, ঘুমাওনি এখনো?
: না। ঘুম আসছে না। তুমি ঘুমাওনি কেন?
: তোমার কথা ভাবছি। তুমি এত নিষ্ঠুর। বিকালে আল ধরে হাঁটার সময় একটু হলে কাদায় পড়ে যাচ্ছিলাম, তুমি হাতটা পর্যন্ত ধরলে না–।
: ইস! শখ কত? আমার স্পর্শ পাওয়া অত সোজা না মিস্টার।
: তুমি যে বললে কাল সকালে ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে হাত ধরে হাঁটবে। এটা আমার বহুদিনের ইচ্ছে। নাটকে দেখেছি।
: তুমি নায়ক নও, আমি নায়িকা নই। বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস।
: তার মানে তুমি হাঁটবে না?
: এখানে দুটো লাইনের গ্যাপ অনেক বড়। তুমি নাটকে দেখেছ মিটার গেজ লাইন, আর এটা ব্রড গেজ। হাতের নাগাল পাব কি পাব না কাল সকালে মেপে দেখব। এখন ঘুমাও।
: তার মানে তুমি সত্যিই হাত ধরবে?
: আচ্ছা পাগল তো! এখন ঘুমাও।
: ঘুমাবো। আর একটা কথা– আমি তোমার জন্য একটা গিফ্ট এনেছি।
: কোনোই দরকার ছিল না।
: ভাবছি কখন কীভাবে গিফ্টটা তোমাকে দেবো–। আচ্ছা, যাবার সময় দিলে কেমন হয়?
: খুব দামি নাকি? দামি হলে নেবো না।
: অত দামি না। তবে আমি যখন চলে যাব তখন আমার কথা ভেবে ওটা গায়ে জড়িয়ে রাখতে পারবে।
: আসলেই তুমি একটা পাগল। এখন ঘুমাও তো–।
: আমি বাথরুমে যাব।
: মিথ্যে কথা। তুমি এখনই আমাকে ছুঁতে চাচ্ছ।
: এত অ্যাডভান্স বোঝো কেন? আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুমি সঙ্গ না দিলে আমি একাই যাব। তবে ওখানে আলো কম বলে ভয় পেতে পারি।
: ঠিক আছে, তুমি বের হও– আমি বেরোচ্ছি।
টিউবওয়েল চেপে বদনায় পানি ভরে টয়লেটে দিয়ে এল অথই। নিনাদ বলল, আমি পারতাম তো।
: পারোনি কখনো। যে ক’দিন এখানে থাকবে, সব আমি করব। যাও, ভেতরে যাও। পানি বেশি লাগলে বালতিতে আছে, ঢেলে নিও।
: ডাকলে তুমি গিয়ে ঢেলে দিবে না?
: যাও। তুমি আসলেই একটা ফাজিল।
হাসতে থাকে অথই। এই ফাজলামোটা যে খুব প্রিয় হয়ে গেছে তা ওর হাসি দেখেই বুঝতে পারে নিনাদ।
পরদিন সকালে দু’জন তৈরি হয়ে উঠোনে নামলে অথইয়ের মা বললেন, পরোটা আর ডিম ভাজছি– গরম গরম খাইয়া যা মা।
অথই বলল, আইসা খাব মা। এমনিতে মেলা দেরি অয়া গেছে।
নিনাদকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে থাকে অথই। নিনাদ বলল, তোমার তো লাল জামা পরার কথা ছিল, সাদা পরেছো কেন?
: বিকালে লালটা পরব। হলুদ শর্ষে ক্ষেতের কুয়াশার সঙ্গে সাদা কনট্রাস্ট হবে।
: গুড। আমারও তো সবুজ পরার কথা ছিল। ভুলে গেছি।
নিনাদ পরেছে কালো জিন্সের সঙ্গে পিংক শার্ট আর পায়ে কেডস। তখন সূর্য উঠলেও হালকা কুয়াশায় রোদ ঢেকে আছে। শর্ষে ক্ষেতে কুয়াশা দেখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ট্রেন লাইন পার হতে গিয়ে নিনাদ লাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল ফুরফুরে মেজাজে। অথই নিষেধ করল, এখন স্লিপ করে পড়ে যেতে পারো, বিকালে হাঁটবো।
: খুব ভালো লাগছে হাঁটতে। তাছাড়া কেডস আছে তো, স্লিপ করার ভয় নেই। তুমিও হাঁটতে পারো।
: আমার কেডস নেই। স্যান্ডেল–।
: তাতে কি? আমার পাশে হাঁটো। লাইনে ওঠার দরকার নেই।
: আমরা শর্ষে ক্ষেত দেখতে এসেছি। দেখ, কি সুন্দর–। চলো ক্ষেতে যাই।
: যাবো। একটু হাঁটি। ভালো লাগছে। তুমি হাতটা ধরলে আরো ভালো লাগবে। দেখো না ব্যালান্স রাখতে কষ্ট হচ্ছে। হাতটা ধরো–।
: শখ কত–!
বলে অথই নিনাদের হাত ধরে একটা ঝাঁকি দিয়ে নিচে নেমে যায় শর্ষে ক্ষেতে। নিনাদ পা ফসকে নিচে পড়ে আবারও উঠে লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। অথই ওকে ডাকতে থাকে, নিচে আসো।
: আসছি, আর একটু–।
বলতেই একটা পা স্লিপ করে নিচে পড়ে এবং সাথে সাথেই একটি রেলের সাথে আরেকটি রেল জোড়া লেগে ওর পা আটকে যায়। তার মানে সিগন্যাল পড়েছে ট্রেন লাইনের গতিপথ নির্ধারণের জন্য। যে ট্রেনটি আসছে সেটি স্টেশনের প্রথম লেন নাকি দ্বিতীয় লেনে থাকবে তা নিশ্চিত হলো।
দূরের একটি ছোট দোতলা ঘর থেকে এই সিগন্যাল কন্ট্রোল করা হয়। গাড়ির ব্রেক করার মতো একবার সামনে টেনে, একবার পেছনে ধাক্কা মেরে। সবুজ এবং লালবাতি জ্বালানো, পাখা নামানো-উঠানোও এখান থেকে কন্ট্রোল করা হয়। স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে স্টেশনের দুই প্রান্তে এমন দুটি দোতলা ঘরের অবস্থান। কিছুতেই নিনাদ পা টেনে তুলতে পারছে না। ওদিকে শর্ষেক্ষেতে একরকম নেচে বেড়াচ্ছে অথই। আর বারবার ডাকছে, কী হলো? আসো না কেন? আসো?
নিনাদ হাসতে হাসতে হাত ইশারা দিয়ে বলে, এই তো আসছি।
অথই ক্ষেতের মধ্যে গুনগুন করে গান ধরে। আবার ডাকে, আসো না? কী হলো নিনাদ? দেখো না কত মজা এখানে, আমি কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছি। আসো, এখানে এলেই হাত ধরব।
নিনাদ আবার হাত ইশারা দেয়। এমন ভঙ্গিতে ইশারা দেয় যেন ওর কিছুই হয়নি। ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। অথই চেঁচিয়ে বলে, ট্রেন আসছে তো? তাড়াতাড়ি ওখান থেকে নামো। নিনাদ, চলে আসো। নিনাদ কিছুতেই পা ছোটাতে পারে না। দুই হাত দিয়ে পা ছোটানোর চেষ্টা করে। জুতা খোলার চেষ্টা করে। ব্যথার চেয়েও জরুরি পা তুলে ফেলা। নিনাদের এমন পা ধরে টানতে দেখে অথই ওর দিকে ছুটতে শুরু করল। ততক্ষণে ট্রেন কাছাকাছি এসে গেছে হুইসেল দিতে দিতে। অথই লাইনের পাশে নিনাদের কাছাকাছি আসতেই ট্রেনটি দ্রুত ছুটে এসে ধাক্কা দিল। সাথে সাথেই রক্ত ছিটকে পড়ে অথইয়ের সাদা জামাটি লাল হয়ে গেল। নিনাদ খুব উচ্চস্বরে মাগো বলে চিৎকার দিয়েছিল কিন্তু ট্রেনের চলার শব্দে কেউই সেটা শুনতে পায়নি। অথইও শুনতে পায়নি। ওর শোনার অবস্থাও ছিল না। দু’হাতে চোখ ঢেকে পড়ে গেল।
অথই দেখতে পেল নিনাদ দুটি রেলের মাঝে পা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। উপায় না দেখে ও নিজের লাল জামাটি খুলে ট্রেন আসার দিকে মুখ করে উড়াতে লাগল যেন ট্রেনটি থেমে যায়। ওর পরনে শুধু ব্রা আর স্যালোয়ার। ওড়না কোথায় হারিয়েছে জানা নেই। লাল জামাটি উড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, থামাও– থামাও।