গ ল্প
এক
পিচের রাস্তাটা কারখানার গেট ছুঁয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। জায়গাটার একটা নাম আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমে। লোকের মুখে মুখে মিলগেট নামটাই বেশি প্রচলিত। রাস্তাটা বাঁ দিক ঘুরে মাঠটাকে মাঝ বরাবর চিরে বেরিয়ে গেছে দূরে হাইওয়ের দিকে। রাস্তাটাকে বাঁ হাতে রেখে একটু এগিয়ে গেলেই নদীর চড়া। নদীর উল্টোদিকের গ্রামগুলো থেকে সকাল হলেই দল বেঁধে কাজ করতে আসত সবাই। শুকনো প্রায় মরে যাওয়া নদীটা হেঁটেই পেরিয়ে আসত সারা বছর। বর্ষার সময়েও এমন কিছু জল হত না। নৌকায় সাইকেলসহ চেপে পার হওয়া যায়। নদীতে বাঁধ বলে যা ছিল তাও নেই। বালির লরি নদীর বাঁধ ও পিচের রাস্তার সবটুকু খেয়ে নিয়েছে।
কারখানার উত্তর দিকে যেখানে নদীতে নেমে যাওয়ার রাস্তাটা শুরু হয়েছে তার মুখে একটা অস্থায়ী ত্রিপলের ছাউনি। ছাউনির এক কোণে বাঁশের ওপরে একটা ছোট্ট বোর্ডে লেখা “আজ অবস্থান বিক্ষোভের ১৭২তম দিন”। ছাউনির ভিতরে বাঁ দিকে একটা খাতা নিয়ে বসে আছে কাজল। মুখটা গম্ভীর। যারা যারা এসেছে তাদের প্রত্যেকের সই হয়ে গেছে। কিন্তু বাপি এখনও আসেনি। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছে কাজল। কারখানা তারা কিছুতেই খুলতে দেবে না। তাদের চারটে দাবির অন্তত তিনটে মানতেই হবে মালিক পক্ষকে। বাপি যখন আছে তখন ভরসাও আছে। বাপির কামড় একেবার কচ্ছপের কামড়। একটা ছোট্ট অবস্থান বিক্ষোভকে আজ এমন জায়গায় এনেছে যে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে মালিক পক্ষ। বাপি আর কাজলকে সাসপেন্ড করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই বিক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছিল। দলে দলে শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। শাসক ও বিরোধী দু’পক্ষের নেতারাই আন্দোলন থেকে ফায়দা নিতে ছুটে এসেছিল, কিন্তু বাপি একা হাতে লড়েছে। আন্দোলনের রাশ কাউকে ছাড়েনি। কাজলরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সঙ্গে থেকেছে। কিন্তু বাপির হলটা কী! কালকেও আসেনি। আজকেও সারাদিনটা পেরিয়ে গেল এল না। শরীর খারাপ নয় তো? সন্ধের দিকে একবার দেখা করা দরকার। বাড়িতেই যাবে কাজল। ছাউনি থেকে নদীটা স্পষ্ট দেখা যায়। একেবারে ওই পাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। আর একটু পরেই কারখানায় ছুটি হয়। ছুটির সময়টা বেশ দেখার মতো। তিনশো শ্রমিক দল বেঁধে বেরিয়ে আসত। কারখানার গেট থেকে পিচের রাস্তা ছুঁয়ে উত্তর মুখে নদীর মধ্যে সবাই নেমে পড়ত। সূর্যাস্তের মুখে লাল আলোয় নদীর ঐ সামান্য জলটুকুও একেবার আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। হাত মুখ ধুয়ে একে একে সবাই যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা দিত, আবার কেউ কেউ সাইকেল নিয়ে পিচের রাস্তা ধরে দু’পাশের মাঠের ভিতর দিয়ে চলে যেত। বাপি আর কাজল আরও কিছুক্ষণ থাকত। সামনের চায়ের দোকানে এসে বসত দু’জনেই। নদী পেরোলেই বাপির বাড়ি। কাজলের বাড়ি কারখানার পাশেই। ফলে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না কারোর। সারাদিনের কাজের পর গল্প করতে করতে সাতটা বেজে গেলে তবে উঠত। হাতের টর্চটা জ্বেলে নদীর ভিতরে নেমে যেত বাপি। কারখানার গেটের মুখে চায়ের দোকানটা দীর্ঘদিন বন্ধ। কাজল ছাউনির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে একবার দাঁড়াল। কারখানাটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল।
দুই
“এটা কী বলছ তুমি? না, আমি এই কাজ কিছুতেই করতে পারব না।”
উঠোনের এক কোণে একটা মাদুরের ওপর বসে কাজল মাথা ঝুঁকিয়ে তার অসম্মতি জানাল।
“কাজল, দেখ এছাড়া আর পথ নেই। এতগুলো দিন কারখানা বন্ধ। কারোর কাজ নেই। হাতে টাকা নেই। ভিতরে ভিতরে সবাই ভেঙে পড়েছে। আমি জানি এখুনি কারখানা খুলে গেলে কাজে যোগ দিতে চাইবে অনেকেই।”
“বাপিদা, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না, কেউ কাজে যোগ দেবে না। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে আমিও দেখব। তুমি কাল চলো তো।”
“কাজল, জেদ করিস না, আমার কথা শোন। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না।”
“আলবাৎ চলবে। বাপি আর কাজল থাকতে কারখানার চিমনি দিয়ে কেমন ধোঁয়া বের হয় দেখব। মালিকের পোঁদ দিয়ে ধোঁয়া বের করে ছেড়ে দেব। শালা ঢ্যামনা।”
“কাজল, আমার কথা শোন, কারখানা খোলা দরকার রে। আমি আর তাকাতে পারছি না ওদের মুখের দিকে।”
“কী ব্যাপার বলো তো বাপিদা? মাল খেয়েছ নাকি? কতোতে রফা করলে মাইরি? আমাকেও ভাগ দাও, সরে যাব।”
“কাজল!”
বাপি উঠে দাঁড়াল। কাজলের কথাগুলো গরম সীসের মতো তার কানে ঢুকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মুখটা রাগে অপমানে কালো হয়ে গেছে।
“আমার সঙ্গে আয়।”
কাজলকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে নদীর একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল।
“দেখ, সারারাত ওই পাড়ে লাল আলোটা জ্বলত। আজ কতদিন ঐ আলোটা বন্ধ হয়ে আছে ভেবে দেখ। কারখানা থেকে ফিরে ঐ লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেছি। কিন্তু আজ কী অবস্থা ভাব। কী লাভ অবস্থান বিক্ষোভের যদি কারখানাটাই না থাকে। মালিকের কী আর যাবে আসবে। একটা কারখানা বন্ধ হলে কিছুই হবে না ওদের।”
“কী বলতে চাইছ তুমি? মালিকের মর্জি মাফিক আমাদের চলতে হবে? তোমাকে আমাকে সাসপেন্ড করে দেবে, কোনও কারণ ছাড়াই আর সেটা মেনে নিতে হবে?”
“তোর সাসপেনশন তুলে নেবে, তুই শুধু আমার কথা শোন। তোরা একটা মিটিং কর। আমাকে সেক্রেটারি পদ থেকে সরিয়ে দে। তুই সেক্রেটারি হয়ে মালিকের সঙ্গে আলোচনায় বস। আমি খবর নিয়েছি আগামী বুধবার ম্যানেজমেন্টের লোকজন আসবে কারখানা ভিজিটে। মালিক নিজেও হয়তো আসতে পারে। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় ওরা। কিছু দাবি মানতেও পারে বলেই শুনেছি। তোরা এই সু্যোগটা হারাস না কাজল।”
“ম্যানেজমেন্টের লোক আসছে তো তুমিই কথা বলছ না কেন। তুমি তো আমাদের থেকে ভাল বলতে পারবে।”
কাজলের কথাগুলো শুনে বাপি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রাত প্রায় দশটা। কাজলকে এই নদীর পথেই ফিরতে হবে। আর আটকে রাখা ঠিক হবে না।
“তুই আজ এখানেই থেকে যেতে পারিস। আর যদি বাড়ি যেতে চাস তাহলে বেরিয়ে পড়। আর দেরি করিস না। রাত হচ্ছে।”
“আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও বাপিদা। তুমি নিজেই কেন মালিকের সঙ্গে আলোচনায় বসে আন্দোলন তুলে নিচ্ছ না?”
“বাঘের পিঠে বসে পড়েছি রে কাজল। নামলেও মরব। চেপে থাকলেও মরব। তোর কী মনে হয় আমি মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে এই আন্দোলন তুলে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? একটু আগে তুই কী বললি, কত টাকায় রফা হয়েছে? কাল সবাই বলবে। আর এই সুযোগটাই নেবে মালিক পক্ষ। আমার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ক্ষোভ উসকে দিয়ে একটা ফুটো কড়িও না ঠেকিয়ে তোদেরকে বাধ্য করবে কাজে যোগ দিতে আর না হলে কারখানা বন্ধ করে চলে যাবে।”
“কিন্তু তোমার কী হবে?”
“আমার কথা ভাবিস না কাজল। তোরা এখন সংসারের কথা ভাব। ছেলেমেয়ে বউ-এর কথা ভাব। অসুস্থ বাবা-মায়ের কথা ভাব। আমি পিছিয়ে আসতে পারি না। কিন্তু তোদের জন্য পথ খোলা আছে, নেমে পড় সবাই। তোদের কিছুটা দাবি মিটে যাবে, কারখানাও খুলবে।”
একটানা কথাগুলো বলে বাপি থামল। দূরে নদীর বুকের ওপর যেন একখানা ধারালো ছুরি কেউ রেখে গেছে। অল্প আলোতেও চকচক করছে। বাপি স্পষ্ট দেখল ছুরিটা ক্রমশ চেপে বসছে তার গলায়। একটাও কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কাজল নেমে গেল নদীর মধ্যে। অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ছুরির দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশ ফিরল। কাজল শিখে গেছে ছুরির ধার এড়িয়ে কীভাবে রাস্তা করে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। বাপির মুখে একটুখানি হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
তিন
গোলমালটা কারখানার গেট থেকে ক্রমশ ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল।
ম্যানেজারের অফিসটা ভেঙে তছনছ করে দিল একটা দল। আর একটা দল সোজা ঢুকে গেল মেশিন ঘরের মধ্যে।
“শালা গদ্দার! আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি! এখন আমাদের এসেছে বোঝাতে।”
কন্ট্রোল রুমের কাছে এসে কারখানার মালিক সব্যসাচী বসাককে দেখে ভিড়টা থমকে গেল।
“আপনারা প্লিজ সবাই শান্ত হন। আপনাদের সব দাবি তো মেনে নেওয়া হবে বলেছি। এর পরেও যদি কিছু দাবি থাকে তাহলে বলতে পারেন, কিন্তু ভাঙচুর করবেন না প্লিজ।”
পোড় খাওয়া ব্যবসাদার সব্যসাচী বসাক। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছেন। এত দিনের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম তিনি এমন আন্দোলন দেখলেন। রাজনৈতিক ইন্ধন ছাড়াও একটা আন্দোলন যে এতদিন চলতে পারে তা তিনি নিজে না দেখলে জানতেও পারতেন না। কারখানা বন্ধে তাঁর বিপুল ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পেরেই তিনি ম্যানেজমেন্ট ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন। এর আগেও অনেকবার আলোচনা ভেস্তে গেছে। কিন্তু এইবার কাজল নিজে উদ্যোগ নেওয়াতে তিনি নিজেই এসেছেন। বিষবৃক্ষের ঝাড়কে তুলেই ছাড়বেন। কাজলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরে চারটে দাবির তিনটে দাবি মানলেও আর একটা দাবি তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কোনও কারখানা মালিকের পক্ষেই এমন অদ্ভুত দাবি মানা সম্ভব নয়। তিনি কী করে মানবেন! শ্রমিক কো-অপারেটিভকে কারখানার পার্টনার করার মতো দাবি মানা কখনও সম্ভব নয়। শ্রমিকরাই কারখানার মালিক হতে চাইছে এ কেমন দাবি! তবে তিনি বাকি তিনটি দাবি মেনে নেওয়ার শর্ত হিসেবে বাপিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার শর্ত রেখেছিলেন। কারখানার ভিতরে এমন নেতা কারখানার মালিকের জন্য বিপজ্জনক। কাজলকে বাপি এই আশঙ্কার কথা আগেই বলে দিয়েছিল। ফলে কাজল খুব একটা অবাক হয়নি। কিন্তু কিছুতেই বাপিদার নামে বাকি শ্রমিকদের কাছে সে মিথ্যে বলতে পারবে না। আন্দোলনের নাম করে বাপিদা মালিকের কাছে মোটা টাকা খেয়ে ভিতরে ভিতরে আখের গুছিয়ে নিয়েছে এ কথা সে কী করে বলবে!
“কাজল, এই বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি দেখছি কী করা যায়।” সব্যসাচী বসাক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বললেন, “কিন্তু বাপি না থাকলেও তুমি তো আছ কাজল? তোমার সঙ্গে কী করা যায় বলো তো?”
সব্যসাচী বসাকের মুখের দিকে তাকিয়ে কাজল ধরতে পারল না সে ঠিক কী চাইছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজল এখনও বুঝতে পারল না তার এখন কী করা উচিত। সব্যসাচীবাবু কি সত্যিই সব দাবি মেনে নেবেন?
“আমরা মুখের কথায় বিশ্বাস করি না। আপনি এখুনি লিখিত নির্দেশ দিন যে আমাদের সব দাবি মানা হল। তবেই কাজে যোগ দেব, না হলে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না। আমাদের সব দাবি না মেটা পর্যন্ত আমরা কাজে যোগ দেব না।” ভিড়ের ভিতর থেকে একটা একটা মুখ থেকে কথাগুলো যত ছড়িয়ে পড়তে লাগল, মনে মনে ততই খুশি হলেন সব্যসাচী বসাক। ধীরে ধীরে মুখের হাসিটা চওড়া হল।
”শুনুন, আপনাদের চারটে দাবির মধ্যে আমরা তিনটে দাবি আগেই মেনে নিয়েছি। আর একটা দাবি মানার কথাও ভাবছি তবে…” বলতে বলতে একবার চারিদিকে তাকালেন সব্যসাচীবাবু, কাজলের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “শ্রমিক কো-অপারেটিভের নামে কারখানার শেয়ার দেওয়া এখুনি সম্ভব নয়।”
ভিড়টার দিকে একবার তাকাল কাজল। কিন্তু চারপাশটা ভাল করে তাকিয়েও বাপিদাকে কোথাও দেখতে পেল না। ঘাড়ের কাছটা ঘামে একেবারে ভিজে গেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর একটু সামনের দিকে এগিয়ে এসে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করল, “বন্ধুগণ, আপনাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। আজ আমাদের প্রায় সমস্ত দাবিই মেনে নিতে চলেছেন মালিক পক্ষ। সুতরাং আসুন, আমরাও মালিক পক্ষকে আশ্বাস দিই যে আগামীকাল কারখানা খুললে আমরা সবাই কাজে যোগ দেব।”
ভিড়টা নড়ল না একটুও। কাজল আশা করেছিল সবাই খুশিতে হাততালি দেবে। আনন্দে ফেটে পড়বে। কিন্তু কিছুই হল না। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “মালিক পক্ষ আমাদের সব দাবি মেনে নিয়েছেন। পুজোয় বাহান্ন দিনের বোনাস, ওভারটাইমের পেমেন্ট বাড়ানো ও সবেতন দশটি মেডিকেল লীভ আমাদের দেওয়া হবে। কী খুশি তো?”
“বাপিদা আর তুমি কতোতে খুশি হয়েছ কাজলদা?”
ভিড়ের ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ গলাটা তিরের ফলার মতো এসে কাজলের গলায় বিঁধল।
একটা গুঞ্জন উঠল। তারপর ধীরে ধীরে ভিড়টা সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কাজল কিছু বলতে যাওয়ার আগেই একটা পাথর এসে কপালটা কেটে বেরিয়ে গেল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না কাজল।
সব্যসাচী চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন। ওষুধে কাজ হয়েছে। এবার শুধু ঘা’টা খুঁচিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। এই দুই বিষবৃক্ষের চারাকে এরাই উপড়ে ফেলে দেবে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মাথাগুলো পাশাপাশি গাছের মত দাঁড়িয়ে আছে। অবিচল কিন্তু সিদ্ধান্তহীন। বাপি-কাজল ছাড়া এদের কোনও অস্তিত্ব নেই তা আগেই বুঝে নিয়েছেন।
“বাপি কাজলের জন্যই এখন এই দাবি আমাদের মানা সম্ভব নয়। না হলে শ্রমিক কো-অপারেটিভের নামে শেয়ার দিতে আমি নিজেই ইচ্ছুক।”
সব্যসাচীবাবু ভালই জানেন সাধারণ শ্রমিকদের এত শেয়ার, কো-অপারেটিভ, পার্টনারশিপ ইত্যাদি বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তাঁর কথাটা ভিড়ের মধ্যে আবার মিশে গেল।
“আমরা চাই আপনারা আগামীকাল থেকেই কাজে যোগ দিন…”
“আমরা কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমাদের একটা কথা বলুন, বাপি-কাজল এই কারখানায় কাজ করবে কিনা?” ভিড়ের ভিতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
সব্যসাচীবাবু থামলেন। প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা বুঝে নিতে চাইলেন। এরা বাপি-কাজলকে চাইছে নাকি চাইছে না ভাল করে বোঝা দরকার।
“আপনারাই বলুন বাপি-কাজলের সঙ্গে কী করা উচিত। আজ দীর্ঘদিন ধরে আপনাদের কাজে যোগ দিতে বাধা দিয়ে আপনাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নিয়মিত টাকা নিয়েছে ম্যনেজারের কাছ থেকে। আমি সব খবর পেয়েই আপনাদের দাবি মেনে নিয়ে কারখানা খুলে দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছি। আপনারাই বলুন ওদের কাজে রাখা কি ঠিক হবে?”
গুঞ্জনটা মুহূর্তের মধ্যে চিৎকারে পরিণত হল। কাজলকে ভিড়ের ভিতর থেকে ঠেলতে ঠেলতে টেনে নিয়ে গিয়ে গেটের বাইরে বের করে দিল একটা দল। বাপি-কাজল মুর্দাবাদ আওয়াজটা তখন রাস্তা ছাড়িয়ে নদীর ভিতরে প্রবেশ করেছে। ধীরে ধীরে শ্রমিকদের দলটা পাতলা হয়ে মুছে গেল বিকেলের আলোয়।
চার
নদীর জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে দুটো ছায়ামূর্তি পাশাপাশি বসে। কারখানার আবছা চিমনিটার ওপর লালচে আলো এসে পড়েছে। আর একটু পরে সূর্য ডুবে গেলেই দিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারের মধ্যে বিরাট কারখানাটা ডুবে যাবে।
“কাজল, এটা তুই কী করলি?”
“এছাড়া আর উপায় ছিল না বাপিদা। তুমি চলে গেলেও আমাকে সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইত। কারখানা আর কোনও দিন খুলত না।
“আর তোর ভবিষ্যৎ? তোর সংসার?”
“তুমি ভেবেছিলে তোমার সংসারের কথা? তাহলে আমিই বা অত ভাবব কেন? আমাদের দু’জনের জন্য যদি এতগুলো সংসার বাঁচে, তাহলে ওদের ভুল ভাঙিয়ে কী লাভ! বরং এই ভাল হল। তিন তিনটে দাবি মেনে নিয়েছে বাপিদা। স্রেফ একটা মিথ্যে এতগুলো শ্রমিকের জীবন বাঁচিয়ে দিল।”
কাজল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। নদীর ওপর হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। শীত আসছে। অন্ধকারে কেউ কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ।
“দেখো বাপিদা, কাল থেকে আবার কারখানা খুলবে। ভোরবেলা চিমনির সাদা ধোঁয়া নদীর ওপর দিয়ে সরের মতো ভাসতে ভাসতে চলে যাবে দূরে। কারখানা খোলার খবর ছড়িয়ে পড়বে সব জায়গায়। আমরা নাই বা থাকলাম। এত এত শ্রমিকের মুখে যে হাসি ফুটবে সেটাই বা কম কী। আমরা তো ওদের অধিকারের জন্যই লড়াই করেছি আর সেই লড়াইয়ে আমরাই জিতেছি।”
“কাজল, দেখ দেখ, সামনে দেখ।”
নদীর ওপরে চাপ চাপ অন্ধকার নেমে এসেছে। বাপি আর কাজল মুগ্ধ চোখে ঘন কালো চিমনির অবয়বের দিকে তাকাল। একটা তীব্র লাল আলো চিমনির গা ঘেঁষে উজ্জ্বল ভাবে জ্বলে উঠেছে।
সব্যসাচী বসাক কথা রেখেছেন।