আ মা র পু জো
আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোকমঞ্জির বেজে উঠতেই ছোটবেলায় একটা আলাদা আনন্দ হতো, যেটা বয়েস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলেছে ধীরে ধীরে। যত বয়েস বেড়েছে, দেখেছি কলকাতার পুজো আস্তে আস্তে কেমন একটা চকমকে গিফট র্যাপের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। থিম পুজোর রমরমার মধ্যে যেমন বিভিন্ন শিল্পী, কারিগরদের হাতের জাদু উঠে এসেছে, তেমনই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে উমার ঘরে ফেরার উষ্ণতাটুকুনি। ছোটবেলায় পুজো মানেই আমাদের ভাইবোনদের কাছে ছিল বিধানপল্লির বাড়ির পুজো। সেখানে হরিদাদু, ছোটদিদা, পিসি ও কাকা-জ্যাঠা, ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হওয়া। পুজোর মধ্যেই সারাদিন আড্ডা, গান, গল্প, খেলা, খাওয়াদাওয়া, সন্ধ্যা-আরতির সঙ্গে ঢাকের তালে তাল মেলানো আনন্দ আর বিসর্জনের পর ফাঁকা দুর্গামণ্ডপে একলাটি প্রদীপের দিকে তাকিয়ে শান্তির জল নিতে নিতে ভাবা “আসছে বছর আবার হবে”। কিন্তু জীবন যে ওই ছোট্টবেলাটির থেকে অনেক অনেক বড় আর দারুণ আলাদা, সেটা বুঝতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। যে উমারা ঘরে ফেরে তারা ছাড়াও এ পৃথিবীতে এমন অনেক উমাই যে আছে যাদের ফেরা হয়না। প্রবাসে কাটানো পুজোর দিনগুলোতে সেটা আরও বেশি করে উপলব্ধি করেছি। কানাডায় থাকতে প্রথম উইক-এণ্ডের পুজো দেখি। দিন-সময়-লগ্ন, পুজোর যথাযথ প্রক্রিয়া ইত্যাদি গৌণ হয়ে গিয়ে সবাই মিলে আনন্দ করাটাই সেখানে আসল ব্যাপার। মনে হয়েছিল, এটাই তো হওয়া উচিত। বাঙালির দুর্গোৎসব তো কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, আদতে এ তো মিলনোৎসব। এক মেয়ের ঘরে ফেরার আনন্দই যেখানে আসল।
কিন্তু এইসবের মধ্যে যে এমন একটা পৃথিবীও লুকিয়ে আছে, যেখানে উমারা ঘরে ফেরে না বা হয়তো ফিরতে পারে না বা হয়তো তাদের কোনও ঘরই নেই। মুম্বই প্রবাসে বছর দুয়েক কেটে গেছে তখন। আমি আর আমার এক বন্ধু, মাঝে মধ্যেই কাজের থেকে ছাড়া পেলে পৃথ্বী থিয়েটার যেতাম। অনবদ্য সব থিয়েটার দেখা ছাড়াও ওইখানকার আড্ডাটার আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। কোথায় কী হচ্ছে, কে কী নতুন অন্যধরণের কাজ করছে, হাল-হকিকতের কী অবস্থা ইত্যাদি আলোচনায় কখন সন্ধে গড়িয়ে রাতে পৌঁছে যেত ঠিক নেই। তো তেমনই একটা আড্ডায় আমরা সেবার ঠিক করেছিলাম এবার পুজো এবং নবরাত্রিতে দুটো দিন বের করে আমরা এমন দুটো জায়গায় যাব যেখানে অধিকাংশ মানুষই উৎসবে ঘরে ফিরতে পারেন না। আমাদের বিভিন্ন এনজিও-তে কাজ করা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দু’টি জায়গা ঠিকও করে ফেললাম এবং পৌঁছেও গেলাম ‘বিজয় আশ্রম’ ও ‘আশাদান’-এ। দু’টি সংস্থার কাজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গৃহহীন শিশুদের শিক্ষা ও আশ্রয়দান এবং আশ্রয়হীন, অসুস্থ ও কর্মক্ষমতাহীন বয়স্কদের দেখাশোনা করা। গৃহহীন শিশুদের সঙ্গে এর আগেও আমি কাজ করেছি, ওয়ার্কশপ করেছি, তাই ওদের এই অসম্ভব লড়াইয়ের জীবন সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা আগে খুব কাছ থেকে দেখতেই হয়েছে। কিন্তু এইবারে আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেল তিনজন বয়স্কার বাস্তব। বাইরে তখন দশমী বা দশেরার আনন্দ উদযাপিত হচ্ছে। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠেছে সেই আলোকমঞ্জির। ছোট করে কিছু আয়োজন হয়েছে আশ্রমেও। তার মধ্যে হাত মিলিয়েছি আমরাও। কিন্তু এই তিন মায়ের কোনো আনন্দে ফেরা নেই। দৃষ্টি সুদূরে মেলে চেয়ে আছেন তিনজনই চাতালের তিনদিকে বসে। মালতী বেন সন্তানহীনা, সারাজীবনটাই প্রায় আত্মীয়স্বজনের কটাক্ষে কেটেছে। কিন্তু স্বামীর ভালোবাসায় সব ক্ষতে প্রলেপ পড়তো। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে তুমূল একটা ধাক্কায় সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারান। পরিবারের অন্যান্যরা ভর্তি করে দেন মানসিক হাসপাতালে। কিন্তু বছরখানেকের ভেতর সুস্থ হয়ে উঠলেও কেউ এসে তাঁকে নিয়ে যায় না, থেকে যান সেইখানেই। আর সেখানেই আলাপ হয় তাঁর অঞ্জলিদেবীর সঙ্গে। অঞ্জলিদেবীর স্বামী অল্পবয়সেই মারা যান লিভার সিরোসিসে, খুব একটা কেজো মানুষ তিনি ছিলেন না, তাই বিয়ের পর থেকেই কোনো না কোনো কাজ করতে হয়েছে অঞ্জলিদেবীকে। মেয়েকেও বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বছরখানেক যেতেই ধীরে ধীরে মানসিক অসুস্থতার নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। প্রায় সারাক্ষণই দরজার কড়া নাড়া শুনতে পেতেন, শুনতে পেতেন কেউ ডাকছে, আর সেই ডাক শুনে বেরিয়ে যেতেন বাড়ি থেকে উদ্দেশ্যহীন। সেই কারণেই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। মানসিক অসুস্থতা বছর তিনেক বাদে কাটে। তাঁর কন্যা চালের একটি খোলিতে থাকেন পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে, তাই সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মায়ের থাকবার ব্যবস্থা করেন এই হোমে এবং সঙ্গে সঙ্গে মালতী বেন-এর বিষয়েও কথা বলেন যে আশ্রমে যদি কোনও ডোনারের সাহায্যে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করা যায়। ভাগ্যক্রমে সে ব্যবস্থা হয় এবং দু’জনেই একসঙ্গে মানসিক হাসপাতাল থেকে আশ্রমে এসে থাকতে শুরু করেন। তৃতীয় জনের কথা কী বলব ঠিক জানিনা, কারণ কেউই জানেন না তাঁর ঠিক কী হয়েছিল। আরতি কাওয়াস্কর। বহু বছর হয়ে গেছে তিনি কথা বলেননি। বলেন না। চেহারায় আভিজাত্যের একটা ছাপ রয়েছে, এককালে সুন্দরী ছিলেন সেটাও বোঝা যায়। সাদা চুলে আলগা খোঁপার মৌনতায় তাঁকে যেন আরও সুন্দর লাগছিল আমার। এই তিনজনের আর একটি বিষয় আমার মন টেনেছিল, তা হল সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা। সকাল থেকে আর সব কাজের মধ্যে একটি দুর্গাবন্দনার একাংশ ওঁদের শিখিয়েছিলাম। আরতি দেবী শুধু মন দিয়ে দুলে দুলে শুনছিলেন। সন্ধেবেলায় ঘটপুজোর সময় ওঁরা যখন সেটা গাইছেন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। হঠাৎ যেন দেখলাম আরতি দেবীর মাথা নিচু ও জোড়হাতের মাঝখানে তাঁর ঠোঁটদুটো নড়ছে। যে উমার খোঁজ নিতে বহুদিন কেউ আসে না, যে উমার ঘরে ফেরা নেই, যে উমার কথা বলা নেই, সে উমার কাছে আজ গান এসেছে। এর থেকে বড় উৎসব আর কী বা হতে পারে! ফেরার পথে আমাদের দুই বন্ধুর মুখে কোনো কথা ছিল না। মনে হচ্ছিল আজ যদি বিসর্জন হয় তবে তা দুঃখের বিসর্জন হোক।