আ মা র পু জো
“শারদোৎসব। বলো শারদোৎসব।” এই বলে অশ্বিনীবাবু মিষ্টি করে হাসলেন। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণি। দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলাশহরের বাসিন্দা। আমার পিত্রালয়। আমাদের মুখের ভাষা, উচ্চারণভঙ্গির একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যা, তথাকথিত মান্য বাংলা উচ্চারণ থেকে পৃথক, স্বতন্ত্র। শরতের আগমনে দ্বারকেশ্বর আর গন্ধেশ্বরী —শহরের দুই পাশে দুই নদ–নদীর চর ধরে আদিগন্ত কাশফুলের সমারোহ দেখে বুঝতে পারতাম দুর্গাপূজা আসছে। দুপুরবেলায় প্রবল হাওয়ার ওপর রৌদ্রের সর পড়ে এক স্বচ্ছ আস্তরণ ঝিকমিক করত। সকালে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা শিউলির নির্মল সুবাস প্রাণ ভরে নিতাম, অন্তরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শুদ্ধ হয়ে যেত, বুঝতাম দুর্গাপূজা আসছে। আর সব শেষে যেদিন খুব ভোরে বাবা তুলে দিতেন, আর বেতার থেকে ভেসে আসত এক দৈবী কণ্ঠস্বর, বুঝতাম দুর্গাপূজা এসে গেল। হ্যাঁ পূজা, পুজো নয়। দুর্গোৎসব বা শারদোৎসব নয়। দুর্গাপূজা। অশ্বিনীবাবু, বাঁকুড়ার মানুষ, আমার জেলার মানুষ, বাঁকুড়া জিলাস্কুলের শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষে সস্নেহ বললেন, “বলো শারদোৎসব।” তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, “দুর্গাপূজার আর এক নাম।” তো, সেই শারদোৎসব শব্দবন্ধের মধ্যে পেলাম এমন এক উৎসবের দ্যোতনা এমন এক বিস্তার যা আর নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম বা জাতির কুক্ষিগত থাকল না, হয়ে উঠল সর্বজনীন। আমাদের পাড়ায় হিন্দু মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমার জন্মের আগে থেকে, স্বভাবতই কৈশোরে যে–সব সমবয়সীর হাতে হাত রেখেছি, খেলাধুলা করেছি, তাদের অনেকেই ছিল মুসলমান। খুশির ইদে যেমন তাদের বাড়ি থেকে এসেছে আমন্ত্রণ, আবার প্রতিমা নিরঞ্জনের পর বিজয়া–সম্মিলনে তারাও এসেছে আমাদের বাড়ি। আর পুজোর চারদিন একসঙ্গে প্রতিমা দর্শন। পরবর্তীকালে জেনেছি একেই নাকি বলে সাম্প্রদায়িক–সম্প্রীতি। এমনকি, নবম–দশম শ্রেণিতে যখন মানসিক পরিবর্তন ঘটছে, সমস্ত বিশ্বাস ও সমর্পণকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। ধীরে ধীরে নাস্তিকতার যুক্তিগ্রাহ্য কার্যকারণে প্রবেশ করছি, তখনও ওই শারদোৎসব শব্দটির মধ্যে পেয়েছি প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর পথ। অকালবোধন শব্দবন্ধের ভেতর যে মৃদু নঞর্থক আভাস, শারদোৎসব–এর স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় তা এক লহমায় দূরীভূত হয়, প্রজাপতিময় নির্ভার আনন্দ নিয়ে আসে। এভাবেই সম্পূর্ণ কৈশোর জুড়ে বারেবারে এসেছে দুর্গাপুজো গোটা একটা ঋতুর পশরা নিয়ে। যৌবনের প্রারম্ভে, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে, বসবাস হল কলকাতা নামক মহানগরীতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাক্পুজোর আবহাওয়াও গেল পাল্টে। পোশাকের বিপণীতে মানুষের ভিড়, ফুটপাতে সারা বছরের তুলনায় হকারদের সংখ্যাধিক্য, রেস্তোরাঁয় ভিড়, রাস্তায় অত্যধিক যানজট, টিভিতে চ্যানেলে চ্যানেলে দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন, কোন ক্লাব বা সংঘের পুজো কত অর্থে বলীয়ান আর পুজোর দিনগুলি গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ কীভাবে ‘সেলিব্রেট’ করবেন তার আলোচনা। এর মধ্যে কোথাও নেই সেই মফস্সলীয় গন্ধ। নেই শারদোৎসবীয় দ্যোতনা। তবে এও এক অভিজ্ঞতা। কলকাতাবাসের প্রথমদিকে একবার বন্ধুবান্ধব সহযোগে বেরিয়েছিলাম রাত্রিব্যাপী প্রতিমাদর্শনে। অসংখ্য মানুষের ভিড়, সর্পিল লাইনের ভেতর দীর্ঘ অপেক্ষা, ঠেলাঠেলি, অতীব কোলাহল —এ–সবই আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিল পুনরায় প্রতিমা দর্শনে। পরবর্তী সময়ে পুজোর দিনগুলিতে আমার এই ছোট্ট জেলাশহরে এসে দেখেছি, সেও আর পূর্বের মতো নেই, মহানগরীকে যথাসাধ্য অনুকরণ করে সেও কিছু একটা করে দেখাতে চাইছে। তারপর থেকে পুজো এলেই চলে যাই কোনও পাহাড়তলিতে, কোনও পাহাড়িয়া গ্রামে, পুজোর কটা দিন প্রকৃতির কোলে নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ। মনে পড়ে, ছোটবেলায়, পূজাবকাশ শেষে স্কুল শুরু হলে, মাস্টারমশাইরা জিজ্ঞেস করতেন, “এবার পুজোয় কে কোথায় গিয়েছিলে বেড়াতে?” আমি প্রতিবছর নিরুত্তর। বন্ধুরা সমস্বরে জানান দিত তাদের ভ্রমণস্থল। সেইসব স্থানের নাম শুনে, বর্ণনা শুনে কল্পনায় চলে যেতাম, ঘুরে বেড়াতাম। আর এই বছর, যখন কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়, অতিমারীর ভয়াবহ প্রকোপে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন, অনেকেই পরিজন বিয়োগের কারণে শোকে মুহ্যমান, অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত— এমন সময়ে আসছেন দুর্গতিনাশিনী, প্রকৃত অর্থেই অকালবোধন। পরিস্থিতির কারণেই এবার হয়তো বাইরে যাওয়া হবে না, তাই এবার পুজোর চারদিন বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে নিজের মতো ঘোরার ইচ্ছে আছে, যদি সেখানে কোথাও শিউলির আঘ্রাণে, কাশের রেণুতে, ঢাকের বোলে কিংবা কলাবউয়ের স্নানে ঘুম থেকে জেগে ওঠে আমার সেই ছোটবেলার দুর্গাপূজা, শারদোৎসব।