আ মা র পু জো
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা শ্রেষ্ঠ পার্বণ। ঐতিহ্যে-অলঙ্কারে-সমারোহ-প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্যে যে অনুষ্ঠান আজ কার্নিভালের রূপ নিয়েছে। দর্শন-পৌরাণিক কাহিনি-আনুষ্ঠানিকতা এই তিনের মেলবন্ধনই ধর্ম । বাঙালি সেই সঙ্গে আন্তরিকতার মিশেলে ধর্মকে উৎসব থেকে ঐতিহ্যের কার্নিভালে পরিণত করেছে। যেখানে ধর্মীয় অনুশাসনের থেকেও সামাজিক, পারিবারিক, স্নেহবিধুর মরমী আবহের সার্বিক চিত্র পরিলক্ষিত হয় । উমা এখানে পূজিত হন কন্যা ভাবে। তাই তো বাংলার ঘরে ঘরে গান বাজে ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী উমা নাকি বড় কেঁদেছে’ – বাঙালি মায়ের চিরন্তন আকুতি ।
জগজ্জননীকে এইভাবে ঘরের কন্যা করে গড়ে তোলার রীতি ভারতের আর কোনো প্রদেশে বড় একটা দেখা যায় না । অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে নিত্যযাপনের মিশেলের অন্য নাম বাঙালিয়ানা।
আগমনী গানে বাংলার প্রকৃতি প্রতিফলিত হয় । কাশফুলের মায়া , শিউলির গন্ধ , প্রভাতী শিশির , নীলকন্ঠ পাখির ডাকে মুখরিত বাংলার গ্রামের শরৎ সজ্জা । সুজলাং-সুফলাং-শস্যশ্যামলাং ধরণী যেন তার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ উজাড় করে অপেক্ষা করে দেবী আবাহনের । পূজার উপচারেও বাংলার প্রকৃতির উজ্বল উপস্থিতি । নবপত্রিকা অর্থাৎ বাংলার ফসল – ধান, যব, কচু , মানকচু, বেল, অশোক , হলুদ , কলা, ডালিম । যা কলা বউ নামে পরিচিত । এই কলা বউকে আবার গণেশের বউ ভাবা হয় । এও বাংলার সংস্কৃতি । একাত্ম হবার সংস্কৃতি ।
দেবী মন্ত্রে আছে ‘স বাহনায় স পরিবারায়’-এর উল্লেখ , যা কি না রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ‘বাংলার ঘরে যত ভাইবোন’-এর মূর্ত প্রতীক । কার্তিক হচ্ছেন দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান , যিনি বৈদিক দেবতা নন , পৌরাণিক মতে ইনি দেব সেনাপতি । ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইনি পূজিত হন মুরুগান-স্কন্দ-সেন্থিল নামে । কিন্তু বাংলায় ইনি পুরুষের সৌন্দর্য পুত্র সন্তানের দ্যোতক । কার্তিক মাসে ইনি পূজিত হন আর কথিত আছে ছড়ার আকারে ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা একবার আসে মায়ের সাথে একবার আসে একলা’। এরপর আসি গণেশের কথায়। ইনি সমৃদ্ধির প্রতিভূ । সর্বপ্রকার সাফল্য এঁর নখদর্পণে । ইনি গজানন, গণপতি প্রভৃতি নামে পরিচিত । বাংলায় তিনি Chubby শিশুর প্রতীক । ‘গনেশ দাদা পেটটি নাদা , লুচি খায় গাদাগাদা’ এই ছড়াতেই তিনি আবদ্ধ । আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও বাংলায় এঁর আলাদা পূজার প্রচলন ছিল না । ইনিও পৌরাণিক দেবতা । এঁর মূর্তি শুধু পূজা নয় , সৌন্দর্য্যায়নেও ব্যবহৃত হয় । দেবীর অপর পাশে থাকেন লক্ষ্মী । যিনি অর্থ-সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি-সৌন্দর্যের প্রতীক । তিনি ধনলক্ষ্মী, তিনিই ধান্যলক্ষ্মী । কোজাগরী পূর্ণিমায় ইনি শুধু বাংলার ঘরে ঘরে পূজিতা হন । অথচ সারা ভারতে এঁর অসংখ্য মন্দির আছে । ধৃতি , কমলা , আরনা , নন্ধিকা নামে ইনি সমাদৃতা । দেবী সরস্বতী বিদ্যা-চারুকলা-সঙ্গীত-শিল্পকলার উপমা । তিনি বীণাবাদিনী । তিনি বসন্ত পঞ্চমীতে পূজিতা হন । ইনি বৈদিক দেবী । সরস্বতী নদীর ইনিই উৎস । বাংলায় ইনি সর্বগুণাসম্পন্নার উদাহরণ । বাংলার প্রতিটি বধূই রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী । আর দেবী সাক্ষাৎ জগজ্জননী মা । তিনি কখনো গিরিরাজের কন্যা , আবার কখনও শিবের ঘরণী । মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া শ্রীশ্রীচণ্ডী । তিনি বাংলার নারীদের চেনা রূপ । দশপ্রহরণধারিণী দশ হাতে সংসারকেও ধারণ করেন । বাংলার পূজা ঘিরে পারিবারিক মিলনের যে চিত্র ফুটে উঠে তা বাঙালির একান্ত যাপনের এক পূর্ণ চিত্র ।
বাংলার খাদ্যাভাসের আভাসও পাওয়া যায় দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগে । শোভাবাজার রাজবাড়ি-সহ অনেক সাবেকি পূজায় আলুর ব্যবহার হয় না । কারণ তা বাংলায় উদ্ভূত নয় । কোথাও নিরামিষ , কোথাও চারদিনই আমিষ খাদ্য থাকে । লুচি , পরমান্ন , মোহনভোগ , নাড়ু থেকে শুরু করে ছোলার ডাল , বেগুন ভাজা , ইলিশ মাছ-সহ বিভিন্ন মাছের পদেই সেজে ওঠে ভোগ সামগ্রী । যেখানে বলির প্রচলন আছে সেখানে পাঁঠার মাংসও ভোগের উপচারে থাকে । কারণ বাঙালি মাত্রই ভোজনরসিক ।
মধুর সামাজিক বন্ধন, সাবেকি আবেশ , বারোয়ারি পূজার মণ্ডপ স্থাপত্যের মুন্সিয়ানা , থিমের দাপট , অষ্টমীর অঞ্জলি , আরতির নাচ, বোধন থেকে বিসর্জন প্রভৃতির অসাধারণত্ব এই পূজাকে বিশ্বজনীন করেছে । যার আবেদন ভারতে ‘বিবিধের মাঝে’ মহা মিলনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।