আ মা র পু জো
দ্যাখো, ইয়োলো অকার, ক্রোম বা লেমন ইয়োলো নয় , ভিনসেন্টের ইয়োলো একটা আশ্চর্য জগৎ, নিজস্ব, তাতে ভাঙচুর চলছে অবিরত। হলুদের পরাক্রম আছে , আবার হঠাৎ অবনত হয়ে শূন্যে মিশে যাওয়ার ভঙ্গিটিও নিজস্ব। স্থান খালাসিটোলা, বক্তা পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। সময়টা সম্ভবত ১৯৯৮-৯৯। ৯৯-এ হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার আগে থেকেই যাতায়াত কালীজ ট্যাভার্নে ( পৃথ্বীশকৃত খালাসিটোলার নামকরণ )। পৃথ্বীশদা এবং ‘প্রতিশব্দ’ পত্রিকার সম্পাদক-তুমুল কবি শৌভিক চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে পানশালায় মদ্যপান আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল, সামান্য ভালুক-টালুক অবশ্য চলতই। আর ছিল পৃথ্বীশদাকে ট্রামে তুলে দেওয়া অথবা বাড়ি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মুখে মুখে ছবি দেখার ক্লাস। গগ্যাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে পিকাসোর সুন্দর ধ্বংসের প্রক্রিয়া, টুকরো টুকরো কথার মাঝখানে দুলুদার ( পৃথ্বীশ ) ঝাপসা চশমার কাচের ভিতর হঠাৎ জ্বলে উঠতেন আরেক কিংবদন্তি। তিনি চিত্রশিল্পী নন, জীবনশিল্পী- হেনরি ডিভিয়ান ডিরোজিও। দুলুদার কথায়, ডিরোজিও আমার জীবনটা গড়ে দিয়ে গেছেন। সমাজের একরৈখিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ডিরোজিওর দ্রোহ দুলুদাকে প্রভাবিত করেছিল। দর্শনের ছাত্র বলে প্রায়শই এ অধমের সঙ্গে আলোচনা করতেন প্লেটো – অ্যারিস্টটল থেকে রাসেল কিংবা সার্ত্রের চিন্তার ভুবন নিয়ে।
মাঝেমধ্যেই দুলুদার উল্টোডাঙার ফ্ল্যাটে সকাল সকাল হানা দিতাম। তখন তাঁর হাত চলছে জেট গতিতে। কব্জির আশ্চর্য মুভমেন্টে একবারও কাগজ থেকে হাত না তুলে এঁকে ফেলতেন ভোলা মহেশ্বর অথবা হিমেনেথের গর্দভ। রেখার ভিতর সঞ্চারিত হত গতি। যে গতি জীবনের, যে গতি সংশয়ের, যে গতি নেশা, মৃত্যু ও যৌনতার। যে গতি অতর্কিতের।
‘সংগ্রহ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে চলেছি । খালাসিটোলায় বসে সে কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে, প্রচ্ছদ কে আঁকছে? খানিকটা থতমত খেয়ে বললুম, না… মানে এখনও ঠিক করিনি। বললেন, ব্যাগে কাগজ আছে? খাতার পাতা থেকে একবারও কলম না তুলে আঁকলেন জুয়ার আসর, নাকি পানশালায় ভাবনার জুয়াখেলা? কাগজটা ছিঁড়ে দিয়ে বললেন, এই নাও ছেলে, তোমাদের কাগজের মলাট। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাশাপাশি তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদগুলোর সঙ্গেও আমাদের বড় হয়ে ওঠা। সেই সব অমর মলাটের শিল্পীর হাত থেকে আমাদের পত্রিকার প্রচ্ছদ ! বাপরে!
সেদিন এইচ.এস-এর রেজাল্ট বেরুবে। স্কটিশচার্চ কলেজের আর্টসের ছাত্র আমি। রেজাল্ট নিয়ে খালাসিটোলায় ঢুকে দেখি আজব কাণ্ড। বোতলপুরাণ রেডি, ভাঁড় রাখা সবার সামনে। কিন্তু পৃথ্বীশদা স্কুলমাস্টারের ভঙ্গিতে বলছেন, কেউ খাবে না , আগে ছেলে রেজাল্ট নিয়ে আসবে, তারপর। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই এক আঙুল দেখলাম। উল্লাস ধ্বনিতে মিশে গেল সূর্যাস্ত ও পানশালা। আমার জন্য বরাদ্দ ভালুকছানার ব্যয়ভার বহন করে শৌভিকদা আর দুলুদার মুখে তৃপ্তির হাসি।
জীবদ্দশাতেই মিথ হয়ে উঠেছিলেন দুলুদা । ছবি আর যাপন মিলিয়ে মিশিয়েই এক পরমাশ্চর্য জীবন। উল্টোডাঙার বাড়িতে থাকতে একটা শেয়াল পুষেছিলেন খাঁচার মধ্যে। নাম রেখেছিলেন ঘড়ি। সেই ঘড়ি প্রহরে প্রহরে ডাকতো। তাতে দুলুদার সময় সচেতন প্রতিবেশীরাও আনন্দিত ছিলেন। একবার পৃথ্বীশদার কী একটা অসুখ। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। একা পান করতে পারেন না। তাই ঘড়ির সঙ্গে পান করেন। এমনিতে সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু একদিন ডোজ বেশি হয়ে গেল। ঘড়ি আর প্রহর-ট্রহর মানলো না। সারারাত হুক্কা ধ্বনিতে তিতিবিরক্ত পাড়ার লোকের অভিযোগ পেয়ে ঘড়িকে নিয়ে চলে গেল বনদফতর। শূন্য খাঁচার দিক চেয়ে পৃথ্বীশদার সে কী কান্না!
চোখের অপারেশনের পর প্রায়শই মেজাজ হারাতেন দুলুদা। অনেক কথা ভুলেও যেতেন। ভুলতেন না একজনকে। খালাসিটোলার বেঞ্চগুলির মধ্যে একটা বিশেষ আসনে কোনও কবি বসলে সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন, জায়গাটা শূন্য রাখো, ওঁর জন্য রাখো, ও যে কোনও সময় এসে পড়বে। কখনও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তো জল ; ওই শূন্য স্থানটুকু দুলুদার পরম শূন্য, পরম বিচ্ছেদ। ওই শূন্যতাটুকু দুলুদার শক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।
মহালয়া এলেই আগমনীর সুর ঘন হয়। নাস্তিকেরও যে তর্পণ থাকতে পারে, মহীরূহকে আঁকড়ে ধরে কান্না থাকতে পারে, যত বয়স বাড়ছে বুঝতে পারি। স্মৃতির গঙ্গায় ডুব দিয়ে করতলে সামান্য পানীয় রেখে অস্ফুটে কখনও বলে উঠি, দুলুদা এটুকু খেয়ে নাও।
আলোকচিত্র: সন্দীপ কুমার