বি শে ষ র চ না
কিছুদিন আগে জেলা শহরের এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য কলকাতা থেকে বেশ কয়েকজন কবিকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই তরুণ কবি। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সীমিত সামর্থ্যে যতখানি সম্ভব আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেননি। আসলে এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলির বেশিরভাগই আবেগনির্ভর― প্রিয় কবিদের সান্নিধ্য, আদানপ্রদান ও আড্ডাই ভালোলাগায় কেন্দ্রীভূত। তাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এ পরম্পরা বহুদিনের। অন্তত আমার নজরে তো গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের চিত্রগুলি এরকম ভাবনাতেই ধরা আছে। সেদিনের জেলা-শহরের সেই অনুষ্ঠানেও এমনই ছবি আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমন ঘটেনি। দেখা গেল, রাত্তিরে থাকার ব্যাপারে আমন্ত্রিত কবিদের নানারকম বায়নাক্কা। কেউ হোটেলের একটা ঘরে একাই থাকতে চান। কারো টয়লেট পছন্দ না হওয়ায় উদ্যোক্তাদের অন্য হোটেলের সন্ধান করতে বলেন। কারো রাতের খাবারের সঙ্গে পানীয়সহ রুটি-মাংস চাই। কেউ আবার নিরামিষাশী! তো, আয়োজক তরুণ কবিদের দুর্ভোগ দেখতে দেখতে নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল সেদিন। আমন্ত্রিত কবিদের প্রত্যেকেই তেমন দাবি করেননি যদিও, তবে অনুজ কবিদের আব্দারের বহর দেখে তো আরো অবাক হতে হয়েছিল। একাধিকবার এরকম ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমি। আবার অন্য ছবি দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল আমার। সেরকমই একটা ছবির কথা এখানে উল্লেখ করে অন্তত প্রমাণ করার চেষ্টা থাকুক যে, সকলেই নন, কেউ কেউ।
এটিও সত্তরের দশকের ঘটনা। বলাবাহুল্য আমি তখন শিলঙেই। আমার সেজমামা রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে চাকরির সুবাদে গুয়াহাটির মালিগাঁও-এ কোয়ার্টারে থাকতেন। প্রচুর পড়াশোনা করতেন আর সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর পছন্দের অঙ্গন। ফলে গুয়াহাটির অনেক কবি-লেখক-অধ্যাপকই তাঁর বাড়ির আড্ডায় শামিল হতেন নিয়মিত। আমিও মাঝে মাঝে শিলং থেকে সেখানে গিয়ে সেইসব আড্ডায় যোগ দিয়েছি।
একবার ‘মল্লার’ নামের এক মিনিপত্রিকার আয়োজনে শিলঙে একটি সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হয়। আমার ওপর শুধু দায়িত্ব ছিল কলকাতা থেকে আয়োজকদের পছন্দের কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ গ্রহণে রাজি করানো এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার। এটুকুই। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত আকাশপথ এবং বাকিটা সড়কপথে শিলং পর্যন্ত। মাত্র দু’দিনের ভ্রমণ। আয়োজকদের এই চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো এসে পৌঁছোলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং অমিতাভ চৌধুরী। অমিতাভদা তখনও আনন্দবাজারে, যুগান্তরে যাননি। এঁরা উদ্যোক্তাদের কাউকেই চেনেন না। এবং থাকা-খাওয়ার ব্যাপারেও কোনো অভিযোগ ছিল না ওঁদের। হল-ভর্তি দর্শক-শ্রোতা নিয়ে অনুষ্ঠানটিও জমজমাট ছিল।
তো, সমস্যা হল পরের দিন সকালে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর গাড়ি করে সোজা গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে গিয়ে সন্ধের ফ্লাইট ধরার কথা। কিন্তু উদ্যোক্তাদের পাত্তা নেই! ফেরার টিকিটও দিয়ে যাননি। আর যেহেতু আমিই আমন্ত্রিত চার অতিথির অবলম্বন, তাই দিশেহারার মতো ঘুরছি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সুনীলদা শুধু একবার খুবই নিচু স্বরে জানালেন যে পরের দিন সকালে তাঁর একটা জরুরি কাজ আছে। হোটেলের ফোন থেকে আয়োজকদের একজনকে ফোন করে জানতে পারলাম যে, চারটে টিকিটের টাকা তখনও জোগাড় হয়নি। তবে খুব শিগগিরই টিকিট কেটে তাঁরা হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাবেন বলেই তাঁদের বিশ্বাস। তবে সেক্ষেত্রে পরের দিন দুপুরের ফ্লাইট ধরতে হবে আমন্ত্রিতদের। অপরাধীর মতো এসে ওঁদের জানাই সে কথা। শুনে শক্তিদা হেসে বললেন, ‘আমাদের জন্য তুমি পড়েছ বিপদে।’ সুনীলদা শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরো একদিনের হোটেল-ভাড়া দিতে ওঁদের অসুবিধা হবে না তো?’ আমি তখন সাহস নিয়ে বলেছিলাম, ‘টিকিট হাতে পেয়েই যদি আজ আমরা গুয়াহাটি চলে যাই? আর রাতটুকু সেখানে আমার মামার বাড়ি থাকি, অসুবিধা হবে?’ শক্তিদা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে আমাকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। ওখানেই থাকব আমরা।’ আসলে শক্তিদা কলকাতা থেকে একদিন আগেই এসেছিলেন এবং আমি গুয়াহাটি গিয়ে তাঁকে আমার মামার বাড়িতেই রেখেছিলাম। যাই হোক, সেদিন বিকেলের মধ্যেই আয়োজকদের কয়েকজন টিকিট নিয়ে হাজির। এবং দেরির জন্য তাঁরা মার্জনা চেয়ে নিলেন। একটা লিটল ম্যাগাজিনের এইসব তরুণ কর্মীদের ভর্ৎসনা তো করেনইনি, উল্টে সুনীলদা ওঁদের আয়োজনের যথেষ্ট প্রশংসা করলেন।
সন্ধের সময় গুয়াহাটির মালিগাঁও-এ পৌঁছোলাম আমরা। রেল কলোনির অনেকেই ছুটে এসেছিলেন প্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ না করে সুনীল-শক্তি-শীর্ষেন্দু-অমিতাভ সবার সঙ্গেই সহযোগিতা করলেন। অমিতাভ চৌধুরীর এক আত্মীয় থাকতেন হাসপাতালের কাছেই। তো তিনি সেখানে চলে গেলেন। রাতে সেখানেই থাকবেন। সেবার শক্তিদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন মীনাক্ষী বৌদি ও ছোট্ট তাতার-তিতিরকে। ফলে রাতের খাওয়া শেষে আমার মামী পাশের ঘরে বৌদি, তাতার, তিতির ও ছোট্ট মামাতো বোনকে নিয়ে ঘুমোতে গেলেন। আমি ও আমার মামা পাশের একটা ঘরে। আর সামনের ঘরের একটা খাটে ওঁরা তিনজন। মাঝখানে শীর্ষেন্দুদা আর তাঁর দু’পাশে শক্তিদা ও সুনীলদা। মনে আছে, এমন কিছু বড়ো খাট ছিল না সেটি। স্রেফ লিটল ম্যাগাজিনের কয়েকজন তরুণ কর্মীদের কথা ভেবে ওঁদের এই ত্যাগ স্বীকারের কথা আমি এখনও ভুলিনি। আমার মামা প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। মামীও সদ্য প্রয়াত। শুধু সেই ঐতিহাসিক খাটটি এখন স্মৃতি-ভারে নিঃসঙ্গ।