ব ই ক থা
চেরিবসন্ত
রাকা দাশগুপ্ত
ধানসিড়ি
কোনও সিনেমা খুব পেলব, মসৃন হলে কিংবা বর্ণনাতীত হলে আমরা তাকে বলি, ‘কবিতার মতো’। কোনও গদ্য যখন শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ নয়, বরং আমাদের মনের তন্ত্রীগুলিকে স্পর্শ করতে পারে, আমরা বলি ‘এ তো পুরো কবিতা’! কবে, কী করে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে গেছে এই ‘কবিতার মতো’ বিশেষণ, কবিতা নিজেও বোধহয় জানেনা।
রাকা দাশগুপ্তের ‘চেরি বসন্ত’ মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যক্তিগত আখ্যান, ভ্রমণকথা কিংবা দিনলিপি। কিন্তু পাতার পর পাতা যে বিস্ময়ের সামনে এনে দাঁড় করায়, সাবটাইটেলের মতো ভেতরে শুধু অনুরণন ঘটতে থাকে – এইসব কিছুই কবিতা… কবিতার মতো।
দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশের ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি এবং লোককাহিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। আগ্রহ আরও ইন্ধন পায় যখন জানতে পারলাম এ’বই জন্মেছে দক্ষিণ কোরিয়ায় লেখিকার আড়াই বছরের একাকী বসবাসের দিনগুলিতে। পদার্থ বিজ্ঞানের পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার কাজে তাঁকে যখন থাকতে হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পোহাং শহরে, তখন। আর দেরি করিনি। তৎক্ষণাৎ কুক্ষিগত করেছিলাম। তদ্দিনে বেশ সাড়া ফেলেছে চেরিবসন্ত।
দক্ষ শিল্পী চিরঞ্জিৎ সামন্ত’র অসামান্য প্রচ্ছদ, অলংকরণ এবং লেখার পরিপূরক সাদা কালো কিংবা রঙিন ছবির প্যানেল বইটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রতিটি ইলাস্ট্রেশন এ’বইয়ের সম্পদ।
উজ্জ্বল প্রচ্ছদটিকে পার করে লেখিকার সেই সময়ের দিনলিপিতে যখন ঢুকে পড়লাম, মনে হলো, এ তো ঠিক পাঠ নয়, বরং মনোরম ভ্রমণ। প্লাম ফুলের রাজ্যে, চেরি ব্লসমের দেশে, বাঁশপাতার আঁকাবাঁকা পথে, পাইনের সারিতে, দুর্গম পর্বত শিখরে, প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরে। কখনও ইতিহাস স্পর্শ করে, কখনও ইতিহাসের মিসিং লিঙ্ক জোড়া লাগিয়ে। আবিষ্কারের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে যখন জানা যাচ্ছে ভারতীয় ইতিহাসের টুকরো ভৌগোলিক গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর প্রাচ্যে রূপকথা হয়ে বেঁচে রয়েছে আজও।
যে চেরি ব্লসম নিয়ে সারা পৃথিবীর আগ্রহের শেষ নেই, জানা হয়ে যাচ্ছে স্বল্পায়ু সেই ফুলের নাকি ক্যালেন্ডার হয়! কিংবা আধিপত্য বিস্তারে চেরি এবং প্লাম ফুলের রাজনীতি জাপানের কোরিয়া দখলের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জানতাম দূরপ্রাচ্যে চায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জানা ছিল না কী অপরূপ ভাবে সেখানকার শিল্প সংস্কৃতি এমন কী সাহিত্যেও অনায়াসে মিশে আছে চায়ের উষ্ণতা। লেখিকার অনুবাদে কোরিয়ান চা বন্দনা দং-চা-সোং এর এক টুকরো পড়ানোর লোভ সামলাতে পারছি না।
সবুজ ফুলের চা-টি যখনই করেছি পান, দু’বাহুর নীচে বায়ু খরতেজ হয়
শরীর কী লঘু লাগে! ধীরে ধীরে উঠে যাই, পবিত্র দশায়
মোমবাতি হয়ে চাঁদ নেমে আসে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাই
সাদা মেঘ উড়ে এসে বসার আসন দেয়, পর্দাও টানিয়ে দেয় দূরে।
ভ্রমণ করতে করতে কখনও পৌঁছে গেছি পাহাড় চূড়ায় প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরে। যেখানে স্বেচ্ছায় দু’দিনের ভিক্ষুণী জীবন কাটাবেন লেখিকা। কিংবা বুদ্ধজয়ন্তীতে কোরিয়ান-দের আলোর উৎসব, লোটাস ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যালে, কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে। যে ঘুড়ি ওড়ানোয় কোনও প্রতিযোগিতা নেই। ঘুড়িতে মাঞ্জার কনসেপ্টই নেই। পাশের ঘুড়িকে না কেটেই নিজের ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দে তারা বিশ্বাসী। কখনও পৌঁছে গেছি চাঁদ ও চেরি ফুলের দুর্লভ মিলন দৃশ্যে, যেখানে চেরিফুল দেখার এই উৎসবকে আলাদা করে ‘হানামি’ নামে চিহ্নিত করা হয়। চেরি উৎসবে উল্লেখ পাওয়া যায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সাইগ্যো হোশির, যিনি সমাজ সংসার সব ত্যাগ করার পরেও চেরি ফুলের প্রতি তীব্র আকর্ষণ কাটাতে পারেননি এবং এ’নিয়ে আক্ষেপ করেছেন তাঁর লেখায়।
ইতিহাস, অপূর্ব সব লোককাহিনির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হিরোশিমার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এসে মন ভিজে যায়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণঘটিত প্রভাবে দুরারোগ্য অসুখ ‘হিবাকুশা’ য় আক্রান্ত ছোট্ট মেয়ে সাদাকো সাসাকির লড়াইয়ের গল্প। সে বিশ্বাস করে তাদের উপকথায়, হাজারটি কাগজের সারস বানাতে পারলে তার আরোগ্য হবে। কিন্তু মৃত্যু অব্দি সে ছশো চল্লিশ-টি সারস তৈরি করতে পেরেছিল। সাদাকো সাসাকি ইতিহাসের অংশ। যে ইতিহাস যতটা যন্ত্রণার, ততটাই লজ্জার।
কখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে অসাধারণ সব মৌলিক কবিতা কিংবা অনুবাদে ওয়োন চোন সোক, কোবায়াশি ইসা, কিম ইন হু’র অনবদ্য সব টুকরো কবিতা। কিংবা ছবির মতো উঠে আসছে জাপানের হাইকু, কোরিয়ার শিজো। সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধারালো কবিতার এই দু’টি প্রায় অনুরূপ প্রাচীন কবিতার ফর্ম আপাতদৃষ্টিতে সহজ কিন্তু সামান্য নয়। তেমনই রেসিপির মতো বুঝতে বুঝতে প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে অপূর্ব কিছু শিজো এবং হাইকুর অনুবাদ। যেমন –
দশটা বছর ব্যয় করে এই পর্ণ কুটির তৈরি করা
আধখানা তার বাতাস থাকে, আধখানা তার চাঁদের বাড়ি
তোমায় কোথায় বসতে দেব? বরং তুমি বাইরে এসো।
= সং-নুন (কোরিয়ান কবি)
বইয়ের শেষাংশে এসে থমকে যেতে হয়। মনে গেঁথে যাওয়া কিছু কিছু গান আমরা যেভাবে লুপে শুনি, চার ঋতুর অনুষঙ্গে লেখা আটখানা কবিতা আমি সেভাবে পড়েছি, আবার পড়েছি। আবারও পড়েছি… সেইসব লেখা টাইম ট্র্যাভেল ঘটিয়েছে, সেইসব কবিতা এক একটা দিনের গতিপথ অনায়াসে বদলে দিয়েছে।
‘চার ঋতুর দিন’ শীর্ষক আটখানা কবিতার একটি পড়াই –
সামার – ১
সবুজ শিখেছি। এক ইস্পাতের নদী, তীক্ষ্ণধার
দৃশ্যের মোড়কে ছিঁড়ে পাকে পাকে নেমে আসছে, তার
দু-পাশে শ্যাওলার বন। পীচরং পেকেছে কোথাও।
ঘোড়ার আওয়াজ। যত আমাকে পেরিয়ে চলে যাও,
ড্রাগনফলের ত্বক ফেটে পড়ে। লাল এত লাল
ধুলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে দিকচক্রবাল
এতটা দহন আমি কাউকে বলিনি, শুধু এই
কাগজপাখার ভাঁজে নিঃশব্দ বীজন ফেলে গেছি।
গোটা চেরিবসন্ত জুড়ে যে নিঃশব্দ জীবন দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়, খালি চোখে যা দেখা যায় না, অন্তর্দৃষ্টির লেন্সের প্রয়োজন পড়ে, রাকা দাশগুপ্ত সেই লেন্স উজাড় করে বিলিয়েছেন। সঞ্চয়ে রাখা পাঠকের কাজ।