Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

বি শে ষ  র চ না  | পর্ব ৯

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি 

ঝাড়বাতি

কবিকে কি উদাসী হতে হবে? কিংবা ভুলোমন? এই ভুলে থাকার স্বতঃস্ফূর্ততায় নিশ্চয়ই কেউ কেউ কখনো কখনো মহান হয়ে ওঠেন। আবার সবকিছু ভুলে থাকতে পারাটাও একধরনের শৈল্পিক পর্যায়ে উন্নত করে তুলতে পারে যে কোনো ঘটনা প্রবাহকে। এ এক মজার স্মৃতি-বিভ্রমের খেলা চলে প্রতিনিয়ত। যদিও কারো কারো ক্ষেত্রে সবরকম অতীত বিমুখিতাই যেন তাঁদের জীবন নিঃশব্দে আলোকিত রাখে। বলাবাহুল্য, তাঁরা স্বেচ্ছায় ভুলতে চান সবকিছু। দ্রুত আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পিছন ফিরতে প্রত্যেকেরই ভয়।  অর্থাৎ আবেগবিহ্বলতা আর কোনোভাবেই সযত্নে থাকার মতন নয়। তবুও স্মৃতির তলানিতে কিছু নুড়ি পাথর তো জমে থাকেই। যা কখনো হয়ত প্রাক-মৃত্যু পর্বে হঠাৎই ফের একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তবে এটা স্বীকৃত সত্য যে, অজান্তে বিস্মৃত হওয়াটাই চরিত্রের শুভ লক্ষণ। আর যেসব কবিরা জাগতিক ব্যাপারস্যাপার ভুলে থাকতে পারেন, তাঁদের চরিত্রের মানবিক দিকগুলিও নিঃসন্দেহে স্পর্শযোগ্য। বহু কবি-চরিত্রের সঙ্গে আত্মস্থ থেকেই আমি এই ধারণায় পৌঁছেছি। এবং একথা নিগূঢ় সত্য যে, তাঁরা প্রকৃত সুখের সন্ধানই পেয়ে যান। আসলে এই অনিচ্ছাকৃত ভুলে থাকাটাই প্রকৃত অর্থে একজন কবির নিষ্পাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বহু বছর আগে, পঞ্চাশের দশকের এক প্রধান কবির সঙ্গে তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাঁর স্ত্রী আমার দেখা অন্যতম সেরা মানবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত মহিলা। তো আড্ডার মাঝপথে তাঁর কাছে এক গ্লাস জল চেয়েছিলাম। তিনি জল আনতে উঠে গেলেন। আর আমরা ফের সাহিত্য আলোচনায় মশগুল। বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম তিনি হাতে একটি রঙিন তোয়ালে নিয়ে আমার পাশে সোফায় বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি এটা চেয়েছিলে না?” আমাকে অপ্রস্তুত করে প্রাণ-খোলা হাসিতে ফেটে পড়লেন আমার প্রিয় সেই অগ্রজ কবি। বললেন, “তোমার কাছে এসব নতুন লাগছে আমার কাছে নয়।”

যে সময়ের কথা বলছি, আমাকে তখন আমার শিলং অফিস থেকে বছর দুয়েকের জন্য গুয়াহাটির অফিসে কাজ করতে হয়েছিল। সেখানে প্রায়ই আড্ডা হতো আমার অসমীয়া কবিবন্ধু ও সেখানকার অগ্রজ কবিদের সঙ্গে। সেখানেই ষাটের দশকের একজন অগ্রজ কবির ভুলে-যাওয়ার গল্প শুনেছিলাম আমারই এক বন্ধুর কাছে। সেই অগ্রজ কবি একদিন নাকি তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে কাজে বসার পর খেয়াল করলেন যে চশমটাই সঙ্গে আনা হয়নি। অথচ চশমা ছাড়া কোনো কাজই তাঁর করা সম্ভব নয়। ফলে, একটা ট্যাক্সি করে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী তখন মেয়েকে আসন্ন পরীক্ষার জন্য  অঙ্ক বোঝাচ্ছিলেন। তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে একটি জটিল অঙ্ক বুঝতে না পেরে অঙ্কটি তাঁর দিকে এগিয়ে দেন। তিনি নিবিষ্ট মনে অঙ্কটি সমাধান করে আবার চশমা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মেয়ে সেদিন বাবার চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলেছিলেন, “খুঁজে দেখো তো পাও কিনা”! শুনেছিলাম, সেই সম্মাননীয় কবির এমন অনেক কাহিনিই নাকি উপন্যাসের আকার নিতে পারার মতন।

আমি কিন্তু নিজে মনে করি যে, একান্ত নিজস্বভাবে ভোলার মতন আমার কিছুই নেই। সবই যেন স্মৃতির কোটরে রাখা এক একটি উজ্জ্বল মুক্তো। এই প্রচণ্ড আত্মাভিমান নিয়েই আমি ভালো ছিলাম। কিন্তু অজান্তেই সে অহংকার চূর্ণ হল একদিন। আপাতত তাই, নিজেকেও এর বাইরে না রাখতে পেরে একটা মাত্র ছোটো ঘটনার উল্লেখ করে পর্বটি শেষ করছি। পরবর্তী সময়ে কখনো আমার সমসাময়িক কবি বন্ধুদের কিছু ভুলোমনের ছবি তুলে ধরার ইচ্ছে রইল।

প্রায় ৩৫বছর আগের কথা। আমি তখন শিলঙে। একদিন অফিস যাইনি। বাড়িতে বসে কিছু কাজ করছিলাম। ছেলে স্কুলে ও স্ত্রী অফিসে। একাই ছিলাম। তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। বাড়িতে শুধু অফিসের দেওয়া কালো ধুমসো ফোন। প্রেস থেকে ফোন করে জানিয়েছিল পত্রিকার গ্যালিপ্রুফ তৈরি আছে। আমি যেন গিয়ে নিয়ে আসি। তো আমি ভাবলাম প্রুফটা নিয়ে এসেই দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নেব। এই ভেবে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরোই। ঘন্টা খানেক পরে বাড়ি ফিরে দরজার কাছে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি চাবি নেই। তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও চাবিটি পেলাম না। আমার তখন মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। ক্লান্ত হয়ে বাইরের বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম। আমি জানি বাড়ির অন্য দুজনের যে কোনো একজন ফিরলেই আমি ঘরে ঢুকতে পারব। কেননা প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা চাবি আছে। ঘন্টা চারেক পরে আমার ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলে স্কুলবাস থেকে নেমেই গটগট করে দরজার হুড়কো টেনে খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। আমি অবাক হলাম। আমার বাইরে বসে থাকার কারণ ছেলে বুঝতে না পারায় তাকে কিছুই জানালাম না। আর নিজে চুপিচুপি ঘরে ঢুকে দেখি, নিঃসঙ্গ তালা আর চাবিটি তাঁর নিজস্ব জায়গায় তখনও হাসি মুখে ঝুলছে। 

আরও পড়ুন...