Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

অ নু বা দ | পাবলো নেরুদার একটি সাক্ষাৎকার

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suva

একজন কবির কবিতায় তো তাঁর জীবন প্রতিবিম্বিত হবে, এটাই হওয়া উচিত। এটাই হচ্ছে শিল্প ও জীবনের নিয়ম...

neruda2

(গত সংখ্যার পর)

আপনার রচনাগুলো আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তো জড়িয়েই আছে?

এটাই তো স্বাভাবিক। একজন কবির কবিতায় তো তাঁর জীবন প্রতিবিম্বিত হবে, এটাই হওয়া উচিত। এটাই হচ্ছে শিল্প ও জীবনের নিয়ম।

আমার মনে হয় আপনার রচনাবলীকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়, তাই তো?

এ বিষয়ে আমি মনে করি আমার চিন্তা বেশ গোলমেলে । আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টিকে কোনো পর্যায়ে ভাগ করি না , কিন্তু যাঁরা সমালোচনা করেন তাঁরা বিষয়টিকে আবিষ্কার করেছেন । সত্যি যদি কিছু বলতে হয় তাহলে বিষয়টিকে বলা যেতে পারে যে আমার কবিতার একটি অবয়বগত একটা সামঞ্জস্য আছে , তা এই যে আমি যখন খুব কম বয়সের, বা আমি যখন কিশোর বা তরুণ , আর নিরানন্দময় যখন আমি কষ্ট পাচ্ছি , এবং যখন সংগ্রামশীল আমাকে সামাজিক সংঘাতে প্রবেশ করতে হয়েছে , এইরকম সব কিছুই মেশানো আছে আমার সাম্প্রতিক কবিতায়। ভেতরের তাগিদ থেকে আমি সবসময়ই লিখি আর কল্পনা করি যে সত্যি যদি এমন ঘটনা ঘটে সমস্ত লেখকের ক্ষেত্রে, তাঁদের জীবনে বা বিশেষত কবিদের জীবনে।

আপনার লেখার সময় কখন?

সেভাবে আমার লেখার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, কিন্তু যদি বেছে নিতে বলা হয় তাহলে বলব লিখি সকালেই, বলতে গেলে এই যে আপনি আমার সময় নষ্ট না করতেন (আর আপনারও সময় নষ্ট হচ্ছে) তাহলে হয়ত লিখতাম । বিশেষত দিনের বেলায় আমি পড়ি না। বরং সারাটা দিন আমি লিখি, কিন্তু অনেকসময়ই একটা চিন্তার পূর্ণতা , একটা প্রকাশের,  এমন একটা কিছু যা আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রবল উচ্ছ্বসিত স্পন্দনে —- একে বলা যেতে পারে ‘অনুপ্রেরণা’। কিন্তু আমি লিখে যাই অতল আহ্বানে যখনই লিখি, আর যেখানেই লিখি, আমার চারপাশে যদি প্রচুর লোকজন থাকেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। 

আপনার লেখা নিয়ে আলোচকরা কি সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন ?

ওঃ, আমার আলোচকগণ! আমার আলোচকরা আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন তাঁদের ভালোবাসা অথবা ঘৃণা মিশিয়ে । জীবনে , শিল্পেও , মানুষ তো সবাইকে খুশি করতে পারেন না , আর এটা একটা পরিস্থিতি যা আমাদের মধ্যে সবসময়ই আছে।

একটা মানুষ সবসময়ই চুমু অথবা থাপ্পড় পাচ্ছে , আদর কিংবা লাথি পাচ্ছে , আর এটাই একজন কবির জীবন । আমাকে যেটা সবথেকে বেশি বিব্রত করে সেটা কবির জীবন ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করা । যেমন ধরুন বহুলোক একত্রিত হন নিউইয়র্কে পি. ই. এন ক্লাব কংগ্রেসের সময় , আমি আমার কবিতা পড়ি , সামাজিক কবিতা, অনেক লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে এক জায়গায় জড়ো হন। আমি আমার সামাজিক কবিতা পড়ি, হয়তো এটা বেশি মাত্রায় ক্যালিফোর্নিয়ায় …কিউবায় বিপ্লবকে উৎসর্গ করা সব কবিতা। তবুও কিউবার লেখকরা একটি চিঠিতে সবাই স্বাক্ষর করে লক্ষ লক্ষ কপি বিতরণ করলেন যাতে আমার মতামত সন্দেহের বিষয় বলা হলো , আর ওই চিঠিতে আমাকে এমন এক প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত করা হল যে উত্তর আমেরিকার দ্বারা আশ্রিত ও রক্ষিত তাঁরা এটাই ইশারা করলেন যে যুক্তরাজ্যে আমার প্রবেশই হচ্ছে পুরস্কারের মতো। এটা একটা সম্পূর্ণ বোকামির বিষয় । যদি কাদা ছোঁড়া না হয় , কারণ ওই রকম একটা অনুষ্ঠানে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর থেকেও অনেক লেখক এসেছিলেন , এমনকি কিউবান লেখকদের আসাও প্রত্যাশিত ছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে আমরা আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রটি হারিয়ে ফেলিনি। তবুও এমন একটি ইশারা করা হয়েছিল , কিউবান লেখকদের তাড়নায় কিংবা অন্ধবিশ্বাসের মোহে । এই মুহুর্তে ঘটনাটা হচ্ছে এইরকম যে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমি পার্টির ক্যান্ডিডেট , এটাই প্রমাণ করে যে আমার একটা সত্যিকারের বিপ্লবী ইতিহাসের ঐতিহ্য আছে।

আপনি অনেক গ্রন্থাগারে দান করেছেন । এখন কি ইসলো নেগ্রায় লেখকদের এক উপনিবেশ গড়ে তোলার কাজে আপনি যুক্ত নন?

 আমি একটা সম্পূর্ণ গ্রন্থগার দান করে দিয়েছি আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বইয়ের উপার্জনে আমার চলে যায়। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। বিলিয়ে দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই আর , শুধু আমার কিছু বই থেকে যেটুকু আমাকে দেওয়া হয় সেটুকুই ।

ওই আয় থেকে আমি উপকূলে একটা বড়ো জমি কিনেছি যাতে ভবিষ্যতে লেখকরা সেখানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে পারেন আর তাঁদের সৃজনশীল কাজ করে যেতে পারেন এমন একটা অসাধারণ সুন্দর পরিবেশ সেটা। এটা হবে কান্তলাও ফাউন্ডেশন—যার পরিচালকরা থাকবেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় , চিলি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেখক সমাজ থেকে।

কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান, আপনার প্রথম দিকের একটি বই , ধারাবাহিকভাবে হাজার হাজার ভক্ত সে লেখা পড়ে চলেছেন।

 ওই বইটার এক মিলিয়ন কপির প্রকাশ উপলক্ষে… খুব তাড়াতাড়ি এটা দু’মিলিয়ন হবে—যে সংস্করণ তার ভূমিকায় বলেছি —আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারি না কেন এমন হয়—কেন এই বইটা, যে বই প্রেম-বিষাদের, প্রেম-যাতনার , এত লোক পড়েই চলে , এত তরুণ পড়েই চলে। সত্যি এটা আমি বুঝতেই পারি না । হয়তো এই বইটা ভিন্ন ভিন্ন তারুণ্যময় প্রহেলিকার  ভঙ্গিমার ধারক। হয়তো এটা সেই সব প্রহেলিকার উত্তর দিয়ে যায়। এটা শোকভরা বই, যদিও এর আকর্ষণ এখনও কমে নি। 

আপনি এমন একজন কবি যাঁর কবিতা বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে প্রায় কুড়িটি ভাষায়। খুব বেশি অনুবাদ হয়েছে কোন ভাষায়?

 আমি বলতে চাই ইটালিয়ান… কারণ এই দুটি ভাষার খুবই সাদৃশ্য। ইংরেজি ও ফরাসি যে দুটি ভাষা ইটালিয়ান ছাড়া আমি জানি, সে দুটি স্প্যানিশের সঙ্গে মেলে না। স্বপ্নেও না, বিন্যাস কি বর্ণে ও শব্দের ভারেও নয় । এটা ব্যাখ্যামুলক সমার্থক নয় , বুঝলেন না , মানেটা ঠিক হল, অর্থাৎ অনুবাদের গ্রহণ বর্জন , কবিতা ধ্বংস করে দিতে পারে। আমার কবিতার অনেক ফরাসি অনুবাদে—-আমি এটা বলছি না যে সবক্ষত্রেই ….আমার কবিতা পালিয়ে যায় …কিছুই থাকে না,কেউ প্রতিবাদ করতে পারবে না কারণ সেখানে যা বলা হচ্ছে তাই তো লেখা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট এটা আমি যদি একজন ফরাসি কবি হতাম , আমি কবিতায় যা করেছি আমি বলতাম না, কারণ শব্দের মূল্য সম্পূর্ণ আলাদা । আমি হয়তো লিখে ফেলতাম ভিন্ন কিছু।

আর ইংরেজিতে?

আমি দেখি যে ইংরেজি ভাষা স্প্যানিশ থেকে এত ভিন্ন —তার থেকে এত বেশি সরাসরি… যে অনেকসময়ই তা আমার কবিতার অর্থ প্রকাশ করে ফেলে কিন্তু আমার কবিতার আবহ প্রকাশ করতে পারে না। আবার এমনটাও হয়তো হতে পারে যখন একজন ইংরেজ কবি স্প্যানিশে অনূদিত হন ।

কোন ধরনের বই পড়েন আপনি?

আমি ইতিহাসের পাঠক , বিশেষত আমার দেশের প্রাচীনতম ইতিবৃত্তের । চিলির এক অনন্য ইতিহাস আছে । এটা শুধু মিনার বা প্রাচীন স্থাপত্যের জন্য নয়, সে সব নেইও এখানে , বরং আগ্রহ এ কারণে যে চিলি আবিষ্কার হয়েছিল একজন কবির দ্বারা …

দোন আলোনসো দে এরসিইয়া ই জুনিগার দ্বারা —-যিনি ছিলেন কার্লোস পঞ্চমের  চাকর । এবং উনি ছিলেন এক বাস্ক অভিজাত , যিনি কানকুইস্তাদোরদের সঙ্গে এসেছিলেন …বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক কারণ চিলিতে পাঠানো বেশিরভাগ মানুষই তো আসতো অন্ধকার কারারক্ষ থেকে । বসবাসের পক্ষে জায়গাটা খুবই দুর্ভাগ্যের । আরাউকানিয়ান ও স্পেনীয়দের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, যা মানবতার ইতিহাসে  দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ। আরাউ কানিয়া-র অর্ধ-বন্য উপজাতিরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়েছেন  তিনশ বছর ধরে স্পেনীয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে । দোন আলোনসো দে এরসিইয়াই জুনিগা , তরুণ এক মানবতাবাদী , এসেছিলেন  দাসসৃষ্টিকারীদের সঙ্গে , যাঁরা  সমগ্র আমেরিকাকে পায়ে পিষে দিতে চেয়েছিলন  এবং পিষেও ছিলেন , তবে ব্যতিক্রমী ছিল এই বন্য অঞ্চল যাকে আমরা বলে থাকি  চিলি। দোন আলেনসো লেখেন ‘ দ্য আরাউকানা ‘ , কান্তিলীয়  সাহিত্যে যা দীর্ঘতম , যাতে বীরের দল যাদের তিনিই প্রথম নাম নথিভুক্ত করলেন , তার সঙ্গীরা  , সেই কান্তিলীয় সৈনিকরা যতটা আগ্রহী এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন তাদের থেকেও বহুগুণ  বেশি আগ্রহী । ‘দ্য আরাউকানা ‘, প্রকাশিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে , অনূদিত হয় এবং  ঘুরতে থাকে নানা ধাঁচে সমগ্র ইউরোপে। এটি ছিল এক মহান কবির মহান কবিতা। চিলির ইতিহাসে এভাবে পেয়েছিল মহাকাব্যিক মহত্ব এবং  বীরত্বময় জন্মলগ্ন থেকেই। অবশ্য আমরা চিলিবাসীরা , স্পেনীয় ও ইন্ডিয়ান আমেরিকা সংমিশনে দোআঁশলা মানুষের মতো ছিলাম না। আমরা স্পেনীয় সৈনিক ও তাদের ধর্ষণ অথবা রক্ষিতাজাত  নই , বরং এটা আরাউকানিয়ান ও স্পেনীয় মহিলাদের স্বেচ্ছা বা বাধ্যতামূলক বিবাহের ফসল , যে মহিলাদের বন্দী রাখা হয়েছিল দীর্ঘ যুদ্ধকালীন বছরগুলোতে। আমরা নিশ্চিতই ব্যাতিক্রমী । অবশ্য তারপরেই আসে ১৮১০ -এর পর আমাদের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস, যে ইতিহাস ট্র্যাজিডিতে বিবাদে এবং সংঘাতে পরিপূর্ণ যাতে সান মার্তিন ও বোলিভার , হোসে মিগুয়েল কারবেরা ও ও’হিগিনস  -এর নাম প্রবাহিত হয় অশেষ পৃষ্ঠা জুড়ে সাফল্য ও দুর্ভাগ্যের আভায় । এসবই তো আমাকে বইয়ের পাঠক করেছিল যেসব বই মাটি খুঁড়ে ধুলো ঝেড়ে বার করেছি আর যেসব বই আমাকে উপভোগ দিয়েছে বিপুলভাবে , যখন আমি খুঁজতে চেয়েছি আমার দেশের তাৎপর্য …আর সব দেশের থেকে এত দূর , অক্ষাংশ হিসেবে এত ঠান্ডা , এত পরিত্যক্ত প্রান্তর , এর বিপুল প্যাতাগনিয়া , আন্ডিজ -এ এত বরফ , সমুদ্র এত পরিপূর্ণ । আর এই হল আমার দেশ চিলি। আমি তো সেই পূর্ণতায়  থাকা একজন চিলিবাসী , এমন একজন , অন্যজায়গায় মানুষ কিভাবে আমার সঙ্গে আচরণ করে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না, অবশ্যই ফিরে ফিরে আসি আমার স্বদেশে । আমি পছন্দ করি ইউরোপের বড়ো বড়ো শহর । আমি ভালোবাসি অর্নো উপত্যকা , কোপেন হাগেন …এবং স্টকহোম -এর কোনো সড়ক আর স্বাভাবিকভাবেই প্যারী, আর তবু আমাকে ফিরতেই হয় চিলিতে।

আরও পড়ুন...