অ গ্নি রা য়ে র ডা য়ে রি | পর্ব ৩
কোনও নতুন সিনেমা ‘রিলিজ’ করলে একসময় শহর জুড়ে সে যে কি দারুন দামামা বেজে উঠত, আজকের ‘ওভার দ্য টপ’ সভ্যতায় তা কল্পনাতীত। সব ছবির ক্ষেত্রে নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ল্যাম্পপোস্টের থেকে জলে ঝড়ে ক্ষয়ে যাওয়াই ছিল পোস্টারের নিয়তি। আবার ওই পোস্টার থেকেই তো আগুন লেগে যেত কলকাতার গলি, উপগলি, ইস্কুল-কলেজ, মফস্বল, হাটে-বাজারে।
আশির ঠিক মধ্যভাগে দেশের এ-কূল ও-কুল দু’কূল ভাসিয়ে এল রমেশ সিপ্পির ‘সাগর’। ডিম্পল কাপাডিয়ার ‘সাগর’। কমল হাসান-ঋষি কাপুরের ‘সাগর’। দেশ বলতে তখন আমাদের কাছে নিজের পাড়া, স্কুল, কতিপয় বন্ধু আর দাদা-দিদিদের ফিসফাস। আমি তখন নবম শ্রেণী, থিয়েটারে গিয়ে হিন্দি ছবি দেখার দৌড় অনেক ঘ্যানঘ্যান করার পরেও মেরে কেটে পনেরো-বিশ। ‘চিত্রহার’ ভরসায় বয়ঃসন্ধি কাটছে। আর কখনও সপ্তাহান্তে দূরদর্শনে ভাগ্যক্রমে জিনত আমন, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না। অমিতাভ বচ্চনের দর্শন পেয়েছি কেবল ‘শোলে’ দেখে।
ফলে কোনও বন্ধু, নতুন হিন্দি মারদাঙ্গা রোমান্স ভাগ্যক্রমে দেখে ফেললে, ব্লো বাই ব্লো সেই গল্প শোনা হত তার থেকে। যাকে বলে সিন বাই সিন। হৃদয় মুঠোয় নিয়ে। এভবেই ‘সাগর’ রিলিজ করার পর সমুদ্র থেকে উঠে বারবার আমাদের স্বপ্ন জুড়ে বসছেন ডিম্পল কাপাডিয়া তখন। শুধুমাত্র শ্রুতি-র মাধ্যমে, কারণ তখন শো এবং ইভেন্ট-এ ছবির টিজার-প্রোমোশনের ঘনঘটা নেই। আমির খানের সৌরভ গাঙ্গুলির বাড়ি চলে যাওয়া নেই। কপিল শর্মার শো-তে বামাল সমেত চলে আসা নেই। সেটা আশির মধ্যভাগে, যখন লোডশেডিংয়ে চাঁদের আলো। যখন বাড়িতে লুকিয়ে হিমসুধা আইসক্রিম (‘কোয়ালিটি’ কনশাস ছিলেন তখনকার অভিভাবকরা)। যখন ‘ছায়াগীত’ শুনতে শুনতে অঙ্কে ভুল। গাভাসকারের ওভাল-এর ইনিংস-এর জন্য রেডিও-র পাশে সমবেত রাত জাগা।
সাগরে যখন কাজ করেছেন, ডিম্পলের কেরিয়ারের মধ্যগগন আর নেই, তবুও আগুনের কি আর বয়স থাকে! কী মাস ছিল মনে নেই, কিন্তু প্রতিটা সন্ধ্যায় ফুটবল ম্যাচ শেষে ফাগুনে হাওয়া দিত। আমরা উন্মনা হয়ে গাইতাম, ‘জনি যব বুলাতা তুঝসে শাদি করোগি মুঝসে…’ অথবা ‘তু জো নেহি তো মেরা কোয়ি নেহি…’। কোথা থেকে আসত সেই বসন্ত সমীরণ? পূর্ণ, বসুশ্রী, ইন্দিরা থেকে?
এবং হ্যাঁ, সুদূর উত্তর কলকাতার একটি সিনেমা হল, ‘গ্রেস’ থেকেও! যার নামই জানতাম না। বয়সে সামান্য বড় হওয়ার কারণে এবং উত্তর কলকাতার হাই স্কুলে যাতায়াত থাকার সূত্রে, শিবু জানতো এসব। আমার পাড়ার বন্ধু, তার ছিল ফুসফুসভরা সাহস, বড়দের কথা না শোনার জেদ, এবং পাপ-এর প্রতি পরম প্রেম! সেই আমাকে সাহায্য করেছিল জীবনের প্রথম নিষিদ্ধ ফলটি খেতে। পনেরো দিন ধরে গোপন ষড়যন্ত্র চলেছিল। ‘সাগর’ দেখতে তো বাড়ি থেকে সোনামুখ করে নিয়ে যাবে না কেউ। কিন্তু না-দেখলে তো ঘুম উড়ে যাচ্ছে, কে সি নাগ মিলছে না! উপায় কী। ঠিক হল, রেবেল হতে হবে, তবে গোপনে! সোজা বাংলায়, স্কুল কেটে দুই মূর্তিমান একদুপুরে শেয়ালদা। তারপর সোজা হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটা (সে সব রাস্তাও চিনতাম না দক্ষিণের আমি)। হাঁটতে হাঁটতে গ্রেস (অনেক পরে যার পাশে ছিল আমার কলেজ)। শিবুই স্মার্টলি টিকিট কাটল, আমি অপরাধবোধে কান লাল করে শার্ট থেকে খুলে ফেললাম স্কুলের ব্যাজ। স্কুল ড্রেস আর পাল্টে ফেলা যায়নি! এরপর অপরাধবোধ ধুয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের ফেনায়! ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড উওম্যান’- ব্রিজিত বার্দো-কে তো অনেক পরে দেখেছি সমুদ্র থেকে উঠে আসতে। তেমনটা লাগেনি, ডিম্পল-দর্শন অনেক আগেই ঘটে গিয়েছে বলে।
সেদিনের গ্রেস সিনেমা হলের সেই ক্যাপটিভ অন্ধকারে ত্রিকোণ প্রেমের মহাকাব্য, কমল হাসানের জন্য বুক ফেটে যাওয়া, ঋষি কাপুরের গলায় একেবারে শেষদিকের কিশোর কুমার— এই সব কিছুই মা-কে মিথ্যে বলার (বা সত্য গোপন করার) গ্নানিকে কমপেনসেট করে দিয়েছিল মনে হয়। বরং স্কুল ড্রেস পরা দুই প্রায় বালক, একটি সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে, মায়ের তৈরি করে দেওয়া টিফিন খাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে— এই ফ্রেমটি থেকে গিয়েছে আমার কাছে আজ পর্যন্ত। অথচ, মা চলে গিয়েছেন, গ্রেস সিনেমা হলটিও সম্ভবত নেই আর, এই সেদিন চলে গেলেন ঋষি কাপুর, শিবুর সঙ্গেও যোগাযোগ ক্ষীণ।
দুটো কাজ আর করিনি কখনও। মরালিটির কারণে নয়। দ্বিতীয়বার সেই শিহরণ যদি ফিরে না আসে, সেই আশঙ্কায়। এক, স্কুল পালিয়ে আর কোনওদিন সিনেমা হলে যাইনি। দুই, ‘সাগর’ ছবিটি আর দ্বিতীয়বার দেখিনি। ইউটিউবে সিনেমাটি খুলে, আঙুল নিয়ে গিয়েছি। একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের প্রায় বালক এসে আস্তে করে আঙুলটা সরিয়ে দিয়েছে…
* ক্রমশ