ব ই ক থা ১
সাইকো
বুদ্ধদেব হালদার
প্রকাশক । প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন
প্রচ্ছদ । সুপ্রসন্ন কুন্ডু
১৫০ টাকা
আত্মদহনের অন্তিম পর্যায় থেকে উঠে আসা ছাই
“একটা কবিতা লেখার পর দোতলায় ঘর বন্ধ করে চেঁচাতে থাকি। হয়তো সেদিন সারাক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছে দারুণ। এবং টিভির খবরে বার বার ঘোষণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলিতেও মেঘলা থাকবে আকাশ। পাড়ার অঙ্কের স্যার হকচকিয়ে বাবাকে বলে ফেলেন, ‘আপনার ছেলেটা কি পাগল?’ আমি জানি, নিভা আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। এবং আমাকে নিয়ে বাবা সারাজীবন অসম্ভব বিরক্ত ও লজ্জিত ছিলেন। তাঁর এই দুরবস্থা কাটাবার জন্য আমি বাবার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ফোন করে জিগেস করি, ‘বলুন তো, আমার কি নিজেকে পুড়িয়ে ফেলা উচিত?’ আমার এই ব্যঙ্গাত্মক বেঁচে থাকাকে মানুষ পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশংসা জানিয়েছেন। আর উত্তেজিত কিছু বাঙালি কবি আমাকে অযোগ্য মনে করে দারুণ খিস্তিখাস্তা করেছেন। অবশ্য এসব নিয়ে আমার কোনো বিরূপ মতামত নেই। আমি আমার দুঃখিত পাকস্থলীর পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকেই ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
লেখাটি পড়ে একটু অদ্ভুত মনে হল না? এটা কি কবিতা নাকি? এ তো স্বগতোক্তির ঢঙে বলে চলা এক আত্মকথন। ভারী বিভ্রান্ত লাগল! আরেকটি অংশ দেখা যাক—
“হে প্রভু, বাংলা কবিতা যেন হাজারবছর এই বিষণ্ণতা মনে রাখে। যেন কখনোই না ভোলে কবিদের হাতে আমি বহুবার খুন হয়েছিলাম এই পশ্চিমবাংলায়”…
আবার থমকে গেলাম। চমকে গেলাম। ভাবনা অন্য খাত থেকে বয়ে এল। এটা কি কবিতা নয়? এই তীব্র প্যাশন যদি কবিতা না হয়, তাহলে কবিতা কি কেবল নির্মাণসর্বস্ব? উঁহু! এই উচ্চকিত প্যাশন, চূড়ান্ত একাকী ও হতাশাই তো কবিতাসৃষ্টির করে! ওহ্ ইয়েস! এটাই কবিতা৷ সজীব বাংলা কবিতা।
এমনই ৫৮ টি তীব্র লাভা ও ম্রিয়মান বকুল দিয়ে তৈরি কবি বুদ্ধদেব হালদারের ‘সাইকো’ কাব্যগ্রন্থটি। বুদ্ধদেব হালদার। কবি বুদ্ধদেব হালদার। বরাবরই এক অন্য ধাঁচে নিজের লেখাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিকতার চেয়েও তাঁর কাছে অধিক ঘৃণিত হল প্রাতিষ্ঠানিক লেজ নাড়ানো—
“বিগত দশকের রুগ্ণ পঙক্তি বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে যারা পেয়ে গেছেন একাধিক সরকারি পুরস্কার, তাদের কাব্যসাধনার প্রতি আমি ভীষণই শ্রদ্ধাশীল। এবং প্রকৃতই লজ্জা পাচ্ছি নিজের লেখালিখি নিয়ে। হাসুন কবিগণ, হাসুন…”
অথবা,
“প্রিয় কবি, আপনারা কেন বোঝেন না, আপনাদের কাটা আঙুল বাংলাসাহিত্যে আর কোনো কাজে লাগে না এখন”
এবং কবি বুদ্ধদেব হালদারের কবিতার কথা এলে, যাঁর কথা আসতে বাধ্য, তিনি হলেন নিভা চৌধুরী। কবির প্রথম প্রেমিকা—
“তুমি বরং এক হপ্তার ছুটি নিয়ে ফিরে এসো শ্বশুরবাড়ি থেকে। আংশিক কৃতার্থ থাকা উচিত আমার প্রতিও। আমি তোমার প্রথম প্রেমিক। এজন্মের ঋণ শোধ করো। এসো, আমার যৌনাঙ্গে আগুন ধরিয়ে দাও”
শুধু প্রথম প্রেমিকা নয়। হয়তো শেষ প্রেমিকাই। কবি স্পষ্টতই লিখছেন—
“শোনো, ফাহিমা ভীষণ ভালো একটি মেয়ে এবং সে আমার কবিতা সম্পর্কে মোটেই আগ্রহী নয়, সবকিছু ঠিক থাকলে তাকে আমি বিয়ে করব আগামী ডিসেম্বর।
তুমি খুশি হবে?”
এভাবেই নিভা-র প্রতি আপোষহীন একতরফা টান, বেকারত্ব, কবিতা লেখার জন্য বেকারত্ব, অসুখ, একাকিত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক ভাঁওতাবাজদের প্রতি ক্ষোভ কবিকে নিয়ে গেছেন এই পর্যায়ে। কবি বুঝতে পারছেন, তিনি আর পাঁচজনের চেয়ে পৃথকভাবে পুড়ছেন। কবি নিজের কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করছেন— সাইকো…
“আমি এক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বসে থাকি সারাদিন। পায়রা উড়ে এসে বসে আমাদের সজনে গাছে। অন্ধকারে স্থির জেগে থাকি আমি। আমার ওষধু কেনা বাকি। দুটো ভিক্ষে দেবে কি তুমি? শুনেছি কী দারুণ সংসার পেতেছ; ঝকঝকে তকতকে একটা আকাশ কিনে ফেলেছ। দেখতে পাচ্ছি তোমায়, এই তো, এই যে তুমি- তোমার হাতে বোনা সোয়েটার গান গায়, ভেলকি দেখায়। এই শীত আমার হাড় চিরে শাস্তি দিচ্ছে। ভীষণ ভয়ে কাঁপছি আমি। অন্যদের মতো তুমিও কি বলবে, আমি সাইকো?”