উ ই ন্ডো সি ট
বাবার একটা পুরোনো ঢ্যাঙা সাইকেল ছিল। অল্প জং ধরা কিন্তু মজবুত, রঙ বোঝা যেত না। সামনের রডে একটা গামছা কয়েক ভাঁজ করে জড়ানো। দুপুরের পর দু’জনে বেরিয়ে পড়তাম। থলেয় রাখা থাকত টর্চ।
একেকদিন একেক জায়গায় বেড়ানো। পুরনো পুরনো মন্দির বা গঙ্গার কিনারাতেই বেশি সময় কাটত। বয়েস হয়ে গেছে, চলতে পারে না এমন সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুমানুষদের বাড়িও বাবা নিয়ে যেত। বসে বসে কতোদিনের কতো কথা শুনতাম। মারি বিস্কুট খেতে দিলে একটু জল চেয়ে নিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতাম।
ফেরার পথে সন্ধে ঘোর হয়ে গেছে। আকাশে কতো চিকচিকে তারা। ছমছম করছে কালপুরুষ। সাইকেলে যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি তাই বাবা গল্প বলত – নৃসিংহ অবতার, গ্যালেলিও, হার্জ বালক, দাদুর গান, ফরিদপুরের ভিটের।
মন্দিরে নিয়ে গিয়ে চিনিয়েছে – এই দ্যাখ বাবু, পাথরের গরুড় পাখি, এটা কালিয়নাগ দমন, আর এই হাতিটার পা কামড়ে ধরেছে কুমির, মুখে দ্যাখ পদ্মফুল চেপে ধরা, ফুলটাও কেমন পাথরের…
বিকেলের নদীতীরে ডুবন্ত সূর্য দেখিয়ে বলেছে- আকাশের হাতিরা সূর্যকে নিয়ে শুঁড়ে করে লোফালুফি খেলছে দ্যাখ… বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে ওরা এবার পড়তে বসবে… চল আমরাও উঠি…
বাবা একবার ঘোড়ানাশ গ্রামে কীর্তনগানের আসরে নিয়ে গেল। বাবার বন্ধুর বাড়ি। রামায়ণ গান হচ্ছিল। সীতা মাটিতে ঢুকে যাবে রাম দৌড়ে এসে হাতের মুঠিতে চেপে ধরেছে সীতার মাথার চুল। তবু সীতা পাতালে চলে যাচ্ছে।
সেই আসরে এক বুড়ির বলা কথা আমার মনে এখনো জ্বলজ্বল করে। আমার ঠাকুমার বয়সিনী সে। পানদোক্তা খাওয়া মুখে ধীর গলায় বলছিল পাশের একজনকে – আউ আউ আউ! রাম ড্যাকরাডার কম্মো দ্যাহো, নিজের বৌডারে মাটির নীচে পাডাইলো… এইয়্যা হুনলে কান্দন আসে দিদি…
আবার যেদিন মিলন হইব হেই দিন কাঁচা সন্দেশ কিন্যা নিয়্যা আসুম। আইজ যাই গিয়া…
গান শেষে প্রসাদ খেতে দিল কলাপাতায়। তারপর রাতে যখন ফিরছি জগদানন্দপুর গ্রামের কাছ দিয়ে, বড়ো বড়ো আমবাগান পেরোচ্ছি তেজিবাবুর, টর্চ জ্বালা হয়েছে, অল্প আলোয় সাইকেল চলেছে আস্তে আস্তে।
বাবা বলছে – লুচি খেয়ে তোর পেট ভরেছিল তো রে?
আমি বলছি – হ্যাঁ বাবা। ও বাবা, সেই কেটে গেলে ব্যথায় লাগায় সাদা দুধের মতো রস বেরোয় তুমি গল্পো বলছিলে, বনতুলসী গাছের ওইগুলোয় কি সেইগুলো?
বাবা তাকিয়ে দেখে মাথা নেড়ে বলে – হ্যাঁ, কেমন একটা গন্ধ দ্যাখ, আর পাশের ঝোপটা হাতিশুঁড় গাছের, টর্চ মারছি দ্যাখ, নড়িস না…
তারপর আবার সব চুপচাপ। অল্প অল্প হাওয়া।
– ও বাবা, আজ সাইকেলটা একটু ভারি লাগছে না? তোমার চালাতে একটু একটু কষ্ট হচ্ছে না?
বাবা হাসতে হাসতে বলছে – হ্যাঁ রে, ঠিকই তো, তুই একরাতেই লুচি খেয়ে কুমড়ো হয়েছিস তো তাই খুউউউব কষ্ট হচ্ছে… হা হা হা…
আমি বলি – না গো, লবদাদা আর কুশদাদা মাঝরাস্তা থেকে ওই বনতুলসী ঝোপের কাছ থেকে ছোট্ট ছোট্ট তীরধনুক নিয়ে আমাদের সাইকেলে চেপেছে… তুমি পিছনে তাকিও না… ওরা লজ্জা পাবে…
বাবা আর হাসছে না। কোনো কথাও বলে না। কেবল ক্রিং ক্রিং মানে সাইকেলঘন্টির পাশে রাখা আমার ছোট্ট হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দেয়। সেই হাতের ছোঁয়া আমার হাতে এখনো লেগে আছে…