উ দা সী ন তাঁ ত ঘ র | পর্ব ৩
নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে রাখাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি এখন। শঙ্খ ঘোষের মৃত্যু হয়তো আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে গেল। তাঁর মৃত্যুর পর যে বিষোদগারের নমুনা আমরা দেখলাম তা অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয়। বিরুদ্ধাচরণ চলতে পারে কিন্তু এই কুৎসার কোনো সামাজিক পরিসর নেই। অথচ তাই হল। নয়ের দশকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর আমরা দেখেছি অতিশয়োক্তি কাকে বলে। সেদিন অরুণ মিত্র বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে অপ্রাসঙ্গিক করে বলা হয়েছিল জীবনানন্দ পরবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালী কবি চলে গেলেন। আমরা প্রতিবাদের সুযোগ পাইনি। এর প্রায় কুড়ি বছর পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু। অথচ অতিশয়োক্তি নেই। ভিতরে ভিতরে ক্ষমতার সাম্রাজ্য তখন ভেঙে গিয়েছে। তাছাড়া সুনীল জীবৎকালে নিন্দিত এবং প্রশংসিত হয়েছেন। অপমান ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে মৃত্যুর পর তেমন সুযোগ ছিল না। ভাবতে অবাক লাগে দশ বছরের মধ্যে শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর পর পাঠক সমাজ এত দ্রুত বদলে গেল কীভাবে! অভিভাবকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকতেই পারে কিন্তু তার নগ্ন প্রকাশের এই নির্লজ্জতা কোথা থেকে এলো? নাকি অনেকদিন ধরে ভিতরে ভিতরে তৈরি হয়েছিল অলৌকিক ক্ষোভ এবং চাপা সন্ত্রাস! ক্ষমতার লোভ এবং লাভা উদগীরণ!
সুনীলের যে ক্ষমতা ছিল তার পাশে ভিন্ন এক ক্ষমতার কারাগারে বন্দী ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। নির্জন আর নিভৃত মানুষের সদর্থক ক্ষমতা। গত চল্লিশ বছরে যে মূল্যবোধ প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তিনি আজীবন তা পালন করে গেছেন শরীর উপেক্ষা করেও। সমস্ত বিষয়ে সকলের জন্য খোলা ছিল তাঁর দরজা। ছিল যথাসাধ্য সমাধান। দু’হাত বাড়ানো উদার আশ্রয়। তরুণ কবির জন্য অযথা প্রশ্রয়। কখনও প্রতিষ্ঠানের দিকে হাত বাড়াননি, স্পষ্ট অবস্থান নিতে সংকোচ করেননি। ছিল বিরল এক মানবিক বোধ। নিজেকে নেপথ্যে রেখে কত গবেষণায় সাহায্য করেছেন । শর্ত ছিল অপ্রকাশ্যতা। যেন আমাদের সকলের শেষ পারাণির কড়ি। তাঁর নির্জনতাই নিমার্ণ করেছে ক্ষমতা। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি হয়ে ওঠেন আর এক প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন যেন একটু একটু করে খসে গেছে তাঁর মানবসত্তা আর তিনি হয়ে উঠেছেন এক চিরন্তন বিগ্রহ। দিকে দিকে পূজা আর সংশয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূজার মধ্যে নিহিত সন্দেহ। অবিনশ্বর এক ভক্তি নিয়ে চারপাশে ছিলেন অনেক মৌলবাদী সুবিধাভোগী। প্রশ্নের কোনো অধিকার ছিল না কয়েক দশক। অনেক পাঠক গত চার দশক শঙ্খজীবনের আলোয় স্নান করেছেন।
ফিরে যাওয়া যাক মফসসলের এক তরুণের স্মৃতিতে। তখন সে মোটা কেমিস্ট্রি বইয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখে শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’। প্রতিদিন মুগ্ধ হয়। আর দিবাস্বপ্নে কবির সঙ্গে আলাপ করে আসে। মনে মনে ভাবে কোনোদিন সে কি লিখতে পারবে ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’র মতো আশ্চর্য কবিতাগুলি? তাঁকেই সে মনে মনে রবীন্দ্রনাথ ভাবে। শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি বই রক্তের ভিতরে, মজ্জায় মজ্জায় মিশিয়ে নেয়। পঁচিশ বছর পর সেই পাঠক খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়ে। তেমন করে টানছে না সব কবিতা। গত কুড়ি বছরের কবিতা নতুন করে পড়তে বসে সে ভাবে আরো অধিক সংকেত জরুরি ছিল। শব্দ আর নৈঃশব্দ্য আরও বেশি লিপ্ত হতে পারত। গোপন রাখা যেত কত পরিচর্যা। অথচ প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহারের মতো বাণী এসে পৌঁছয় মাঝেমধ্যে। এর গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। তবু মাঝে মাঝে এতদূর প্রকাশ্যতা ক্লান্তি আনে। না, তাঁকে কোনোদিন বলা হয়নি এইসব কথা। প্রশ্নহীন আনুগত্যর দেশে সকলেই কমবেশি সশস্ত্র। শুধু মনে মনে তৈরি হয় বিষাদ। কখনও একান্ত কোনো সভায় বিষোদগার। পাঠকের সংকট নিয়ে সেদিন প্রশ্ন তোলেনি কেউ।
শক্তি আর সুনীলের মিথ ছিল গোটা জীবন জুড়ে। ছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রচার। পাঠকের একটা বড়ো অংশ সেই মিথের পিছনে ছুটেছে। কেউ কেউ দীক্ষাও নিয়েছে। এসব থেকে অনেক দূরে ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তবুও তিনি ভিন্ন এক মিথের মানুষ। তাঁর নির্জনতা, প্রতিবাদ এবং সংবেদনশীলতা, আশ্চর্য পাণ্ডিত্য, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অথরিটি তাঁর এক মহৎ মূর্তি নির্মাণ করেছে কয়েক দশকে। তিনি এসব না চাইলেও প্রত্যাখান করেননি অনেক ক্ষেত্রে। উদার দু’হাত মেলে শহর আর মফসসলকে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রতিমুহূর্তের মিথ তাঁকে ঘিরে রেখেছে নিজস্ব বলয়ে। রবিবারের আড্ডাগুলি নানা অসামান্য গল্প দিয়ে আমাদের লোকাল কবিদের মুগ্ধ করে রাখত। গত তিন দশক জারি ছিল মুগ্ধতার সন্ত্রাস। যাঁরা তাঁর কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন অথচ সুযোগ মেলেনি আলস্য আর লজ্জায়, তাঁদের অনেকেই মনে মনে নির্মাণ করেছেন শঙ্খ ঘোষের কিংবদন্তির ছায়া। মুগ্ধতার বদলে ঈর্ষা আর সন্দেহে অহেতুক তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। কোন পথ না পেয়ে ভক্তির বদলে অকারণ বিষোদগার করেছেন। এভাবেই শহরে আর মফসসলে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। মিথ্যে ছায়াযুদ্ধ। অথচ যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন তাঁরা বাক্য খরচ করেননি। পাছে বিগ্রহের অপমান হয়। ক্ষমতার অলিন্দ থেকে হুমকি আসে। তাই মৃত্যুর পর শুরু হল অশ্লীল আক্রমণ। পুজো নেই, পুঁজি নেই শুধু মিথের অভিমান থেকে উঠে আসে নিরুপায় বিরুদ্ধাচরণ। অলীক ছায়াযুদ্ধ করতে দেখেছি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককেও।
এক হিসেবে শঙ্খ ঘোষের ছিল এক বড়ো পরাজয়। নিরুপম একাকীত্ব। তিনি নিজেই তাঁকে অতিক্রম করতে পারেননি সারাজীবন। পাঠকের তরফে কোনো প্রশ্ন তাঁর দিকে ধেয়ে আসেনি। দু-একটি বিচ্ছিন্ন এবং কখনও অবাঞ্ছিত অনুযোগ ছাড়া জীবৎকালে আর কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। তিনি ছিলেন আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির অভিভাবক। নেপথ্যে ক্ষমতার বিগ্রহ। পুজোর ছলনায় কত মানুষ তাঁর সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেইসব আনুগত্য কেবলই প্রশ্নহীন। তাঁর বিগ্রহই তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড়ো বাধা। তাঁর সবচেয়ে বড়ো অপরাধ- প্রতিভাবান এবং সুযোগসন্ধানীকে একইরকম সময় এবং প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। তিনি যা লেখেন তা মেনে নিতে আমরা সদাপ্রস্তুত। আর তাই সুযোগ্য পাঠক কোথাও তাঁকে সতর্ক করেনি। ভয় ছিল। মৌলবাদের বিপজ্জনক ভয়। ট্র্যাক থেকে ছিটকে যাওয়ার ভয়। আমরা তাঁর থেকে নিয়েছি কেবল। সাহস করে কিছু দিইনি তাঁকে। দেবার সাধ্য নেই ভেবে এড়িয়ে গেছি। একজন কবির চারপাশে বিগ্রহের আলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তাঁর।
তবু আজও নতুন করে ভাবতে হয় নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক রাখা কতখানি জরুরি। আজ বিস্মৃতিরও আছে নিজস্ব এক প্রাতিষ্ঠানিক বলয়। জনপ্রিয়তার বিপরীতে নির্জন বিস্মৃত লেখকেরও আছে উজ্জ্বল মহিমা। আজ চারপাশে বিস্মৃত লেখককে ঘিরে অতিশয়োক্তি আর উন্মাদনা স্পষ্ট। জনপ্রিয়তাকে সন্দেহ করে আমরা কেবলই ছুটে যাই প্রান্তিক লেখকের দিকে। সেখানে বিচার নেই, শুধু কিছু সস্তা আবেগ। আর তাই আমরা মাথায় তুলে রাখি ঋত্বিক ঘটক, জর্জদা, শম্ভুনাথ, নিত্য মালাকার, স্বদেশ সেনকে। তুলনা করে ছোট করে রাখি প্রতিষ্ঠিত শিল্পীকে। পুরস্কারের বাইরে বঞ্চনাও একধরনের জনপ্রিয় মিথময় প্রাতিষ্ঠানিকতা তৈরি করে একথা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে আজ। পাঠক সরাসরি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে – জনপ্রিয় লেখক বনাম উপেক্ষিত লেখক। আর তাই সহজেই শৈলেশ্বর ঘোষের পক্ষ নিয়ে শঙ্খ ঘোষকে কুৎসিত আক্রমণ করা যায়। এসব প্রশ্নে মানবতা আপাতত খুশি হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগেও ‘রুচির সমগ্রতা’র দিকে আমরা সম্ভ্রমের চোখে তাকাতাম। আজ পক্ষ নিতে হয়। শিবিরের চিহ্ন বুকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতে হয়। প্রসারিত রুচির দিকে উড়ে আসে বিদ্রুপ। মনে করা হয় এ আসলে একধরনের রুচির বিকার। উপেক্ষিত কবিকে মহৎ ভাবার এক ফাঁদ নির্মিত হয়েছে। উপেক্ষিত মাত্রই অসামান্য এই মুদ্রাদোষে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আচ্ছন্ন। তরুণ কবির প্রিয় তালিকায় রমেন্দ্রকুমার কীভাবে এসে পড়েন তার জটিল অঙ্ক আমাদের জানা নেই। শুধু এক অলীক মুখোশ কবিতার চেয়ে কীর্তিকে এগিয়ে দেয় পাঠকের দিকে। বিখ্যাত কবি মাছের কাঁটার মতো গলায় বিঁধে আছেন। আছে তাঁর বিরুদ্ধে আস্ফালন। কেন তিনি উপেক্ষিত কবিকে নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি তাই নিয়ে তাঁকে নীরবতার রাজনীতির ধিক্কার শুনতে হয়। যখন পাঠকই কবি অথবা কবিমাত্রেই পাঠক, তখন মৌলবাদ আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। টুকরো টুকরো ঘটনার মালায় তৈরি হয় অভিসন্ধি। পাঠকের আকাশ ছোটো হয়ে এসেছে। কিছু বলবার আগে ভেবে নিতে হয় মেরুদণ্ডের জোর কতখানি। বাজার কতখানি সইবে। সাম্রাজ্য হারাবার ভয় কতখানি। আজ পাঠকের ছদ্ম বিপ্লবও শেষপর্যন্ত নিরাপত্তাকামী। তাই এই দুইপ্রান্ত থেকে দূরে তৃতীয় কোনো পন্থা খুঁজে নিতে হবে আমাদের। যা স্পষ্ট এবং সত্যভাষী। যা দুর্নিবার অন্ধকারের মধ্যেও একটা সহজ পথের ঠিকানা দেয়।
* ক্রমশ