গ ল্প
সুন্দর মেয়েরা আজও আছে। নাঃ, আজ আর এ নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই। অথচ একসময় আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গোটা দুনিয়ায় কোথাও তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির সঙ্গে আমার একদিন দেখা হয়ে গেল। আর তাও খুব আকস্মিকভাবে। সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। একটা পার্কের বেঞ্চে সে একা একাই বসেছিল। আমি সেই পার্কে মর্নিং ওয়াক করতে এসেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাছপালার আড়ালে ছায়ায় একটি মেয়ে মুখে রুমাল চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সামনেই একটা পুকুর। সেখানে সাঁতার কাটছে অনেক রাজহাঁস। বিচিত্র সব পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে গোটা জায়গাটা সরব হয়ে উঠেছে।
একটু ইতস্তত করে আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে-ও আমাকে লক্ষ্য করেছিল আর দু’চোখে অভিমান নিয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?
কিছু হয়নি। সে সপাটে জবাব দিলো।
অমন ঝাঁঝালো উত্তরের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। একটু বেসামাল হয়ে গিয়েও আবার জানতে চাইলাম, তোমাকে দেখেই বুঝেছি অভিমান হয়েছে। কিন্তু কেন এত অভিমান করো? এই পৃথিবীটা কি সুন্দর নয়?
মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর চোখের জল মুছে আবার ঝাঁঝিয়ে উঠলো, না, সুন্দর নয়, কুৎসিত, খুবই কুৎসিত। নইলে কেউ আমাকে বোঝে না কেন? কেন, এমনকি কুট্টুসও আমার কাছে আসতে চায় না?
আমি জানতাম, পৃথিবীটা সুন্দর নয়। কিন্তু এই মেয়েটির তাতে কিছু যায় আসে না বলেই মনে হয়, এত নিষ্পাপ, পবিত্র, শান্ত, গভীর এর চোখের চাউনি, বসে থাকার ভঙ্গি, গলার স্বর! অন্তত এ যেখানে থাকবে, দুনিয়ার সেই জায়গাটাই সুন্দর হয়ে উঠবে, এরকমই মনে হলো আমার। এও বুঝতে পারলাম, কোনও কারণে তার খুব অভিমান হয়েছে এবং সেটা হয়তো ওই কুট্টুসকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু কুট্টুসটি কে?
হঠাৎ সামনের একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো একটা কুকুর, হিংস্রভাবে ডেকে উঠলো। মেয়েটি আঁতকে চেঁচিয়ে উঠলো, আমাকে বাঁচান, আমার ভয় করছে। আমার হাত খিমচে ধরলো সে। আমি কুকুরটার দিকে তেড়ে যেতেই সে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল। মেয়েটি এতক্ষণে সকৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকালো।
আমি আবার জানতে চাইলাম, এবার বলো, কি হয়েছে তোমার…
মেয়েটি যা বললো তার মর্মার্থ এই, কুট্টুস তার প্রতিবেশী। বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। মেয়েটি তাকে খুবই ভালোবাসে। কিন্তু কুট্টুস মেয়েটিকে পাত্তাই দিতে চায় না। কুট্টুস শুধু ওর বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না। তাছাড়া স্কুল, খেলার মাঠ, টিভি, এইসব নিয়েও সে খুব ব্যস্ত। মেয়েটির সঙ্গে সে যে ব্যবহার করে, তাকে হেঁয়ালি ছাড়া কিছুই বলা যায় না। কারণ মেয়েটি তাকে মুক্ত হস্তে দান-ধ্যান করলে সে-ও অকাতরে তা গ্রহণ করে।
কিন্তু ওইটুকু সময় ছাড়া সে সর্বদাই মেয়েটির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, মুখে যা আসে তাই বলে, আর তখন লুকিয়ে অশ্রুপাত করা ছাড়া মেয়েটির সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকে না।
কিন্তু কেঁদে কী হয়? আমি জানতে চাইলাম।
বুকটা হালকা হয়। না কাঁদলে আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারি না।।
মেয়েটির নাম স্রোতস্বিনী। চোদ্দ বছর বয়েস। জোর করে ওদের বাড়ি সেদিন নিয়ে গেছিল সে। আর আমি মনে মনে ভাবছিলাম, সাড়ে তিন বছরের জন্য চোদ্দ বছরের এই বিরহ, দুনিয়ায় কত আশ্চর্য ঘটনাই ঘটে! কিন্তু স্রোতস্বিনীর কাছে ব্যাপারটা যে খুবই স্বাভাবিক, তা বুঝলাম ওদের বাড়ি গিয়ে। ওর বাবা রিটায়ার করেছেন, মাথার সব চুল পেকে গেছে, সহৃদয় মানুষ, আমাকে দেখেও খুব খুশি হলেন। স্রোতস্বিনী ফলাও করে যখন জানালো, আমি ওকে হিংস্র কুকুরের হাত থেকে রক্ষা করেছি, বলা যায়, পুনর্জন্ম দিয়েছি, তখন তিনি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলেন, ও, তাই, এ তো খুবই ভালো কথা। স্রোতস্বিনীর মা নেই। সাড়ে তিন বছর আগে তিনি মারা গেছেন। মায়ের ছবি দেখিয়ে সে উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠলো, এই দেখুন আমার মা, অনেকটা আমারই মতন দেখতে, তাই না?
হ্যাঁ, তোমারই মতো…
মা’র মৃত্যুর পরই কুট্টুসের জন্ম। খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগতো তখন। ও না জন্মালে কী যে হতো…
এবার বুঝলাম সাড়ে তিন বছরেই স্রোতস্বিনীর জীবনে কুট্টুস কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্রোতস্বিনী সবদিক থেকেই একটু অন্য ধরনের মেয়ে। সে খবরের কাগজ পড়ে না। খেয়াল করে সময় মনে রাখতে পারে না। পথ চিনতে পারে না। সাংসারিক ব্যাপারের খুঁটিনাটি দিকেও তার কোনও নজর নেই। সবসময়ই কেমন যেন বিভ্রান্ত। তার মন জুড়ে আছে শুধু শিশুরা। শিশুদের সান্নিধ্যেই একমাত্র সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। টিভিতে শিশুদের নিয়ে যেসব প্রোগ্রাম হয়, একমাত্র সেগুলিই মন দিয়ে দেখে। আর সবসময়ই কুট্টুস আর তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে চিন্তা করে। তাদের প্রতিটা বাক্য, স্বভাবের খুঁটিনাটি, অতি তুচ্ছ সব ঘটনা, সমস্ত তার মুখস্ত। এইসব চিন্তাই তাকে প্রাণশক্তি যোগায়, উত্তেজিত করে তোলে, কখনও সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, কখনও বিষাদে ডুবে যায়, তখন স্বগতোক্তি করে ওঠে, যতোই হোক, ওরা তো আমার নিজের কেউ নয়!
স্রোতস্বিনীর বাবাও সবসময় কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকেন। তিনি বললেন, আমার বয়েস হয়েছে, নিজের অনেক রকম কাজ থাকে, ওকে সময় দিতে পারি না। তুমি মাঝেমধ্যে এসো, ওর সঙ্গে গল্প করে যেও, স্রোতস্বিনী বড় একা…
আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
২
স্রোতস্বিনীর সঙ্গে প্রথম যেদিন বেরোলাম, সেদিনই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো।
সেই পার্কের বেঞ্চের কাছে ওকে আসতে বলেছিলাম। আমি এসে গেছিলাম বেশ কিছুটা আগেই। হঠাৎ চাদ্দিক অন্ধকার করে প্রবল ঝড় শুরু হলো। একটু পরেই নামলো বৃষ্টি। আমি একটা বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এই দুর্যোগে স্রোতস্বিনীর পক্ষে আসা সম্ভব নয়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাতে বুক কেঁপে যাচ্ছে। প্রকৃতির তাণ্ডবের মধ্যে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, বিপন্ন মনে হচ্ছিলো আমার।
এই দুর্যোগ কিন্তু বেশিক্ষণ চললো না। চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আবার সব শান্ত হয়ে গেলো। আর তখনই দেখলাম, স্রোতস্বিনী আসছে। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি?
সে হাসতে হাসতে বললো, আমি তো অনেকক্ষণ বেরিয়েছি…
তাহলে কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
সে দূরের একটা গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ওই যে, ওর তলায়।
হায় ভগবান! এই দুর্যোগে বেরোতে গেলে কেন?
তোমাকে কথা দিয়েছিলাম না?
আমি চমকে গেলাম। কথা দিয়েছিলো বলে স্রোতস্বিনী এসেছে! যে পৃথিবীতে কেউ কারও কাছে কথা দিয়ে রাখে না, শুধু নিজের স্বার্থে সম্পর্ক গড়ে তোলে, আবার স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ভেঙে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়, সেখানে স্রোতস্বিনী কোন পৃথিবীর মূল্যবোধ বহন করে চলেছে?
আমরা একটা সিনেমা হলে ঢুকেছিলাম। সিনেমাটা হাসির। আমি আড়চোখে মাঝেমধ্যে স্রোতস্বিনীর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনায় সে হাসিতে ফেটে পড়ছে। সারা মুখ ঝলমল করে উঠছে তার। কী অনাবিল, অম্লান সারল্যমাখা সেই মুখ। কী স্বর্গীয় সেই হাসি। কোনও পাপ কখনও স্পর্শ করতে পারে নি ওদের। আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, স্রোতস্বিনী, হাসো, তুমি হাসলে আমিও পবিত্র হয়ে যাই…
সিনেমা দেখে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। আর সেখানেই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটলো। আমি দেখতে পেলাম আমার এক বান্ধবীকে। মেয়েটিকে দেখে আমি একটুও খুশি হলাম না। একসময় ওকে আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। মেয়েটি রাজি হয় নি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। জরুরি কথাটা হলো, আমাকে বিদায় করার জন্য সে রোজই কিছু না কিছু মিথ্যে গল্প ফাঁদতো। আর আমি সরলভাবে তার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করতাম। পরে যখন জানতে পারলাম, মেয়েটি আদ্যন্ত মিথ্যেবাদী, তখন সেইসব মিথ্যে আর মিথ্যেবাদী মেয়েটিকে চিনতে না পারার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলাম। এরকম একটি নৈতিকতা-বর্জিত মেয়ের সংস্পর্শে স্রোতস্বিনী আসুক, আমি চাইছিলাম না। মেয়েটিকে দেখতে না পাওয়ার ভান করে দূরের একটা কেবিনে গিয়ে বসলাম। মেয়েটি কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই সেই কেবিনে এসে হাজির হলো। আমার বিরক্তি সে গ্রাহ্যই করলো না।
একটু পরেই দীপা মানে সেই মেয়েটির সঙ্গে স্রোতস্বিনীর গল্প জমে গেলো। প্রথম দিকে দীপাই কথা বলছিল, স্রোতস্বিনী চুপ করে ছিল। অচেনা মানুষের সামনে সহজে ও মুখ খোলে না। কিন্তু দীপা যখন জানতে চাইলো, স্রোতস্বিনী স্বপ্ন দেখে কি না, তখন আর ও চুপ করে থাকতে পারলো না। স্রোতস্বিনী রোজ রাতে কিছু না কিছু স্বপ্ন দেখে, আর আমাকে তার বিশদ বিবরণ শুনতে হয়। স্বপ্নের কথায় ও উত্তেজিত হয়ে উঠলো আর এভাবেই ওদের মধ্যে গল্প জমে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরেই দীপার চোখ-মুখ পাল্টে গেলো। কেমন যেন সম্মোহিতভাবে ও আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করলো। স্রোতস্বিনী আমাকে দেখিয়ে বললো, আদিত্য একসময় তোমাকে ভালোবাসতো, তাই না?
আমি আর দীপা দু’জনেই চমকে উঠলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীপা বললো, হ্যাঁ, কিন্তু আমি আদিত্যকে ভালোবাসতাম না। ওকে আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
দীপার এই অকপট স্বীকারোক্তি শুনে আমি চমকে গেলাম। বিভ্রান্তের মতো বললাম, সেকথা কিন্তু আগে কখনও স্বীকার করো নি। তুমি বরং বরাবরই বলে এসেছো…
আমি সত্যি-মিথ্যার ফারাক বুঝতাম না, তাই অমন করতাম। কিন্তু এখন আমি সত্যি কথাই বলছি… তাই বলে ঠকাবে আমাকে?
আমি ঠকাই নি, বন্ধুত্ব রাখতে চেয়েছিলাম, তুমিই শুনতে না…
আর সেই দুপুরগুলো…
তুমি চেয়েছিলে বলেই হয়েছিলো, আমি তখন অন্য একজনকে ভালোবাসতাম…
অথচ সেকথা একবারও আমাকে জানাও নি…
আমি তো বলছিই, সত্যি-মিথ্যার ফারাক তখন বুঝতাম না, যেটা হাতের কাছে পেতাম সেটাকেই বেছে নিতাম, কিন্তু এখন আমি সত্যি কথাই বলছি…
হ্যাঁ, ও সত্যি কথাই বলছে। স্বগতোক্তি করে উঠলো স্রোতস্বিনী।।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, না, ও সত্যি কথা বলতে পারে না, ও কখনও আমার কাছে সত্যি কথা বলে নি…।
দীপা মর্মাহত হয়ে বললো, হ্যাঁ, একসময় আমি মিথ্যা ছাড়া কিছুই বলতাম না, কিন্তু আজ আমি যা কিছু বলেছি তার প্রতিটি কথাই সত্যি, সত্যি ছাড়া অন্য কিছু বলার ক্ষমতাই আমার নেই… তুমি আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো…
ঠিক আছে, তুমি বলতে চাইছো তোমার অফিসের ঠিকানাটা সত্যি?
হ্যাঁ, তুমি চেক করে দেখতে পারো… কার্ডটা বের করে দেখালো দীপা।
তোমাদের নতুন বাড়ি বেহালায়?
হ্যাঁ, তাই… দীপা সেদিনই ক্যুরিয়রে পাওয়া একটি চিঠিতে ওদের বাড়ির ঠিকানা দেখালো।
তোমার প্রেমিকের নাম ঋত্বিক? আর সে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ… দীপা ঋত্বিকের ছবি আর কার্ড বার করে দেখিয়ে দিলো।
আর তাকেও তুমি ঠকাচ্ছো? তোমার মা-বাবা আসলে চান…
হ্যাঁ, রোজগারটা আরও বেশি না হলে… দীপা একটা ছোট্ট টেপরেকর্ডার চালিয়ে দিলো। একটা গান শেষ হতেই ওর বাবার হুঙ্কার শোনা গেল, এ আমি মেনে নিতে পারি না, ছেলেটি প্রতিষ্ঠিত নয়… গলাটা আমার পরিচিত।
তার মানে, ওই কারণেই আমার দিকে তুমি এগোওনি…
হ্যাঁ, বাবা-মা’ই চাননি…
তাহলে আজ কেন ছুটে এলে আমাদের টেবিলে?
হঠাৎ এই সুন্দর মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে গেল। স্রোতস্বিনীকে সে আঙুল দিয়ে দেখালো। তারপর বললো, তারপরই মনে হলো, আজই সেই দিন। আজ না হলে আর কোনওদিনই তোমাকে সত্যি কথাটা নিজের মুখে জানাতে পারবো না…।
আমি চমকে উঠলাম। তারপর বললাম, স্রোতস্বিনীকে দেখে?
হ্যাঁ, আমি জানি তুমি ভালো করেই জানো, তোমাকে আমি কোনওদিনই ভালোবাসিনি। তোমাকে যেসব কথা বলেছিলাম, তার সবই মিথ্যা। কিন্তু আমি একথাও জানি, তুমি কখনই এই সত্যকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে পারোনি নিজেকে। কারণ আমাকে তুমি ভালোবাসতে। তাই এখনও তোমার মনে সংশয় রয়ে গেছে। এখনও মাঝেমাঝেই তোমার মনে হয়, ‘দীপা আমাকে ঠকিয়েছে? হয়তো আমারই ভুল হচ্ছে। হয়তো আমাকে ও ভালোই বাসতো! আসলে ওর বাবা-মা চাননি বলেই।‘… না, এই সংশয় আর রেখো না তুমি। আমি তোমাকে কোনওদিনই ভালোবাসিনি। আর আমার মুখ থেকে একথা না শুনলে চিরদিনই তোমার মনে সংশয় থেকে যেতো। আমি নিজের মুখে জানিয়ে গেলাম তাই…
কিন্তু কেন? ক্রুদ্ধ হয়ে জানতে চাইলাম, আমি কী তোমার কাছে জানতে চেয়েছি?
নিশ্চয়ই চেয়েছো!
মানে?
তুমি এই মেয়েটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, তুমি চেয়েছো…
কী যা-তা বলছো? স্রোতস্বিনীর সঙ্গে তোমার এই স্বীকারোক্তির সম্পর্ক কী?
সেটা তুমি স্রোতস্বিনীকেই জিগ্যেস করো। তাছাড়া, প্রসঙ্গটা ওই তুলেছে। ও জানলো কী করে, তুমি নিশ্চয়ই বলো নি… তাহলে, ভাবো, ভাবো…
কী বলতে চাইছো তুমি?
সুন্দর মেয়েরা আজও আছে পৃথিবীতে, আদিত্য… আমি সুন্দর নই, কিন্তু কোনও সুন্দর মেয়ের সামনে কেউ কখনও নিজেকে লুকোতে পারে নি, পারে না… তাই আমি ছুটে এসেছিলাম সেই কথা বলতে যাকে তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য বলে ভেবে এসেছো এতদিন… অথচ যা একটা মামুলি সত্য ছাড়া কিছুই নয়…
দীপা উঠে সোজা দরজার দিকে চলে গেল, তার হাতের ধাক্কায় একটা টেবিলের জলভর্তি কাচের গ্লাস উল্টে পড়ে গেল, সে একবারও পিছনে তাকালো না।
৩
স্রোতস্বিনীকে নিয়ে আমি এক নতুন সঙ্কটে পড়লাম। ও আমার জীবনে আসার পর থেকে একের পর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। যেসব মেয়েরা আমাকে ত্যাগ করেছিল, আমার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখতো না, তাদের কারও না কারও সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যেতে লাগলো। আর মজার ব্যাপার হলো, এরা কেউ-ই আর আগের মতো ছিল না। আমার প্রতি ঔদাসিন্য তাদের পুরোপুরি কেটে গেছিল। তারা গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল আমার প্রতি। আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে তোলার জন্য কেউ কেউ লাগামছাড়া ঔৎসুক্য দেখাতে শুরু করলো।
এরকমই একটি মেয়ে তাপসী। তার বিয়ে হয়ে গেছিল। স্রোতস্বিনীকে নিয়ে একটা নাটক দেখতে গেছিলাম। সেখানেই হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। আমাকে দেখে তাপসীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাখো মাখো কণ্ঠস্বরে সে প্রায়ই আমাকে ফোন করতে শুরু করলো। তারপর একদিন আমন্ত্রণই জানিয়ে বসলো রাতে খাবার জন্য।
তাপসীর বর চেন্নাইতে বড়সড় চাকরি করে। সে নিঃসন্তান। একাই একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে। নিজেও একটা কোম্পানিতে কাজ করে, বিস্তর মাইনে পায়। আমাকে দেখে সে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। খেতে বসে দেখা গেল, অঢেল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন একার হাতেই করে ফেলেছে সে।
আমার দিকে মাঝেমাঝেই সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকছিল। আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। হঠাৎ সে বলে উঠলো, কত সুন্দর হয়ে উঠেছিস তুই। আর কী একঘেয়ে জীবন আমার!
মানে? আমি অবাক হয়ে তাকালাম। তারপর জানতে চাইলাম, কিন্তু তোর জীবন তো বেশ ব্যস্ত এবং নিরাপদ।
ব্যস্ত, কোথায় ব্যস্ত, যত সব মামুলি কাজ। আর নিরাপত্তা জীবনকে ক্লান্ত করে দেয়। জীবনে কোনও চ্যালেঞ্জ না থাকলে…
ও আমার লেখা কিছু কবিতা শুনতে চাইলো। একইসঙ্গে যৌনতা ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আলোচনা চালালো। নিজে বেশ কয়েকটা গান গেয়ে শোনালো। ওর বরের আঁকা বেশ কিছু ছবি দেখালো। তারপর আমি চলে আসার সময় আমাকে গাড়িতে করে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিলো। আর যেতে যেতে বললো, আজকের সন্ধেটা অনেকদিন মনে থাকবে। এত ভালো আমার যে কতদিন কাটেনি… তোর কাছে আমি ঋণী, আমি কৃতজ্ঞ…
কিসের ঋণ? ওর কথাগুলো দুর্বোধ্য মনে হলো আমার কাছে।
আমার বর একদম কেজো লোক, জানিস! আহার, নিদ্রা, মৈথুন ছাড়া আর যা বোঝে, তা হলো কাজ। ঠিক যেন একটা যন্ত্র, ক্রিয়েটিভ নয়। একসময় ভেবেছিলাম, গোটা জীবনটা নানা অ্যাডভেঞ্চার করে কাটাবো। কিন্তু অর্থের জোর ছিল না। তুই তো আর নিরাপত্তা দিতে পারতি না। এখন আমার যথেষ্ট নিরাপত্তা আছে। কিন্তু আমি অসুখী। আমি তোর মতো কাউকে খুঁজছিলাম, যে খুব ক্রিয়েটিভ, যে আমাকে জীবনে ফিরিয়ে দেবে, আমার ঘুমন্ত প্যাশনগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলবে, তাই ঋণ…
কিন্তু তুই তো কখনও আমাকে বলিসনি, স্রেফ নিরাপত্তা পাবি না বলে…
তোর প্রতি আমি বরাবরই আকর্ষণ বোধ করতাম, তোর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগতো, কিন্তু এসব কথা না বললেই হতো, হয়তো বলতাম না, কিন্তু সেদিন তোর সঙ্গে ওই মেয়েটিকে দেখার পর…
হ্যাঁ, ওর নাম স্রোতস্বিনী…
সত্যি, ভারি সুন্দর মেয়ে। (সুন্দর মেয়েরা আজও আছে তাহলে, কী বলিস?)… তা যা বলছিলাম, ওকে দেখার পর মনে হলো, তোকে সত্যি কথাটা বলা উচিত…
কিন্তু এ যে আমি আশাই করিনি। তাছাড়া তুই বিবাহিত…
আমি তোর কাছ থেকে বেশি কিছু চাই না। শুধু একটু ফোনে কথা বলিস, কোথাও দেখা করে দু-এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে যাস, তাহলেই হবে। আমার বরকে তো বলতে পারি না, তুমি আরেকটু ক্রিয়েটিভ হও… একেবারে তেড়ে আসবে তাহলে।… একটু থেমে সে আবার বলে, সত্যি কথাই বলছি, একমাত্র তুই-ই আমাকে বাঁচাতে পারিস…
তাহলে আমি যখন তোর সঙ্গে সময় কাটাতে চাইতাম, তখন এড়িয়ে যেতিস কেন? এতদিন আমাকে ভুলেই বা ছিলি কী করে?
হ্যাঁ, ঠিকই, এড়িয়ে যেতাম। ভুলেও গেছিলাম তোকে। আসলে নিজের কাছেও কোনওদিন এসব কথা স্বীকার করিনি। কিন্তু ওই মেয়েটা… ওকে দেখেই কী যে হলো… মনে হলো, আর লুকোনো ঠিক হবে না, এবার সব সত্যি কথা বলা উচিত… নইলে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবো…
৪
স্রোতস্বিনী কুটুসের খাতায় একটা ছবি এঁকে দিচ্ছিলো। কুটুস একের পর এক আব্দার করে চলছিল। আর স্রোতস্বিনী হাসি মুখে সেইসব আব্দার মিটিয়ে চলছিল। আমি অধৈর্য বোধ করছিলাম। কিন্তু স্রোতস্বিনী আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিলো না। কিন্তু শেষপর্যন্ত কুট্টুসের আঁকার স্যার এসে গেলো। আমিও একা পেলাম স্রোতস্বিনীকে।
স্রোতস্বিনী আমাকে দেখেই চমকে উঠলো। তারপর বললো, কী হয়েছে তোমার? অসুখ করেছে নাকি?
আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বললাম, স্রোতস্বিনী, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি।
স্রোতস্বিনী একটুও বিব্রত না হয়ে বললো, কী যা-তা বলছো তুমি! আমি তো কিছুই জানতে পারিনি…
তোমার জানতে পারার কথাও নয়, কিন্তু তুমি আছো বলেই আমি বদলে গেছি, আমিও সুন্দর হয়ে উঠেছি, আর যেসব মেয়েরা আমাকে এড়িয়ে চলতো, আমাকে ঠকাতো, নানা মিথ্যা কথায় ভুলিয়ে রাখতো, তারা সবাই একে একে আমার জীবনে ফিরে এসেছে, আর আমিও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি…
কিন্তু একথা তো ঠিক, আমি আছি বলেই ওরা আছে…
হ্যাঁ, তা ঠিক। আমি মেনে নিলাম।
আর আমি যখন থাকবো না, ওরাও থাকবে না…
হ্যাঁ, সে কথাও ঠিক।
তাহলে তুমি ওদের সঙ্গে জড়াওনি। ওরাই আসলে আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে…
আর আমি? ওরা আর তোমার মধ্যে আমার স্থান কোথায়?
তুমি একটি শিশু। হি হি করে হেসে উঠলো স্রোতস্বিনী। তারপর বললো, তোমাকে, একমাত্র তোমাকেই ভেবেছিলাম হয়তো কোনওদিন বড় হবে না। আর সত্যিই, বয়সটাই বেড়েছে তোমার। মনের দিক থেকে তুমি কুট্টুসের চেয়েও ছোট রয়ে গেছো…
কী বলতে চাইছো তুমি স্রোতস্বিনী?
তুমি ঠিক আমার ছেলের মতো, আমার মা যেমন আমার কাছে ছিল! তুমি আমাকে ঠকাবে কী করে?… আর তাছাড়া মা’র কাছে ছেলে তো সবসময়ই ক্ষমার যোগ্য!
৫
স্রোতস্বিনী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে এখন একটা পাহাড়ি শহরে নির্জন আশ্রমে অনাথ শিশুদের দেখভাল করে। বলা বাহুল্য, যেসব মেয়েরা আমার জীবনে ফিরে এসেছিল, তারা সবাই একে একে উধাও হয়ে গেছে। স্রোতস্বিনী চলে যাওয়ার পরই তারা মিথ্যে কথা বলতে বা আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। আমি আবার একদম একা হয়ে গেছি। মাঝেমাঝেই সেই পার্কের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকি। আর অপেক্ষা করি কোনও চঞ্চল পায়ের শব্দের। যদি সে ফিরে আসে! আসতেও তো পারে।
সুন্দর মেয়েরা আজও আছে পৃথিবীতে। তারা হারিয়ে যায় নি…