Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ধা রা বা হি ক  | পর্ব ১২

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

sankar_chakrabarty_hm

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি

ঝাড়বাতি

হারিয়ে যাওয়া এই কবির কথা হঠাৎই মনে পড়ল। শীর্ণ, ভাঙাচোরা শরীর। তামাটে রং। অফুরন্ত সিগারেটের তাপে পোড়া ঠোঁট। পরনে ধুতি এবং সাদা পাঞ্জাবি। এ হেন জৌলুসহীন মানুষটি, না; শুধু মানুষ নন, একজন সত্যদ্রষ্টা, আমূল বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করা সার্থক কবি, একদিন পায়ের ছেঁড়া চটি ছুড়ে ফেলার মতো নিঃশব্দে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, নিখিলদা। পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি নিখিলকুমার নন্দী’র কথাই বলছি। সাতান্ন বছর বয়েস একজন কবির পক্ষে এমন অবহেলায় চলে যাওয়ার উপযুক্ত সময় নিশ্চয় ছিল না। অথচ প্রায় এই বয়েসেই জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিময় জীবনও স্তব্ধ হয়েছিল। সুতরাং আরো বহু প্রিয় কবিদের কথা ভেবে ভয় হওয়াটাও নেহাত অমূলক নয়।

সারা জীবনে কিন্তু নিখিলদা’র একটিও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়নি। তাঁর অসংখ্য কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এতদিনে নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হওয়া এই কবির লেখাগুলো গ্রন্থভুক্ত করার দায়িত্বও কেউ নেননি। অন্তত ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার প্রধান কবির ক্ষেত্রে এই আশা অন্যায় কিছু নয়। ‘অনুক্ত’ পত্রিকারও অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। তিনি সেই বিরল শ্রেণির লেখক, যাঁর মেধাবী রচনাধারার সঙ্গেই নিজের জীবন অঙ্গাঙ্গীভূত। ফলে, পড়াশোনাও করতেন বিস্তর। শ্যামাপ্রসাদ কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান বা উপাধ্যক্ষ থাকাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাঁর কাছে। বরং বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ধারাবাহিক কাজগুলি স্রেফ অমরত্বের জন্য নয়, নিছক খেলার ছলে করে গেছেন যাবতীয় সাংসারিক দুর্দৈবের মধ্যেও। শেক্সপীয়ারের সনেটগুলির বাংলায় অনুবাদ নিয়ে একটি বই আছে তাঁর। সরোজ চৌধুরীর গ্রন্থাবলীর সম্পাদনা করেছেন যথেষ্ট দায়িত্ব সহকারে। এবং সর্বোপরি তাঁর ‘দেশ-কাল-সাহিত্য’ প্রবন্ধের বইটি বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল সংযোজন।

বাম রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নিখিলদা কখনো নিজের কবিতায় সরাসরি কোনো প্রতিফলন রাখেননি। বরং সমাজ বা পারিপার্শ্বিকতার ওপর তাঁর আস্থাহীনতাই বারবার প্রকাশ পেয়েছে কবিতায়। রাগ-দুঃখ বা নির্বিকার শ্লেষ ও আশ্লেষে, এক বেদনার্ত মোচড়ে নিজের কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেন যেন। আবার মতাদর্শ বা নিজস্ব চেতনাকে কখনোই গৌণ হতে দেননি লেখায়। যার ফলে সর্বজনীন হতে বাধা ছিল না তাঁর কবিতার। কিন্তু নিজের মতো মুখচোরা ছিল তাঁর কবিতাও। ভিতরের অজস্র কবিতার বুদবুদ কদাচিৎ বেরিয়ে আসতো কলমে। হয়তো অন্তঃস্থলের কোনো ব্যথা নিয়েই বেঁচে ছিলেন এতদিন। যে ব্যথা ছন্দ বা বিন্যাসে কখনো বা স্পন্দিত করতো কবিতাকেও।

‘চেয়ে দেখছি চারদিকে খুব, খুবই খোলামেলা/ আকাশে ছুটেছে নাকি বাতাস বোলবোলা গমগমে/ রক্তের ফিনিক-লেপা সোনারূপা ডলারের খেলা অনুপম/ বহুবিধ বিদেশী মুদ্রায় অ্যালবামে/ ছবি ফোটে তামাটে তল্লাট/ ঢের হলো রাজাসাজা গণ-সমাজের সমাধি/ এবার ছুটন্ত ঘোড়া শোরগোল-দহরমে পরিশ্রান্ত ভোগে/ গোঙায় হেঁচকি তুলে, খাবি খায়, বুঝি নাভিশ্বাস! যা হয় তা হোক শুধু এই কালবেলার প্রহর/ আবেশে মধুর বড়ো, মুক্ত মনে, যুক্তির বিচ্ছেদে…’। এমন প্রখর দৃষ্টি ছিল বলেই তাঁর স্বল্প সৃষ্টিতে কোনো খাদ ছিল না।

কিন্তু দৃষ্টি ছিল না নিজের শরীরের প্রতি। খাওয়া ও বিশ্রামের প্রতিও তাঁর মনস্কতার খুবই অভাব ছিল। পরিশ্রম যেন ছিল তাঁর জন্মলব্ধ অধিকার। আবার সংসারের প্রতিও ছিল এক ধরনের উদাসীনতা। অথচ নিশ্চিতভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ উপলব্ধি করতেন। তা না হলে, অমন সৃষ্টির বহমান সিদ্ধিতে নিজের বিষয় ও বিষয়ী এক অদ্ভুত অ্যাবস্ট্রাকশানে অটুট থাকবেই বা কেন! প্রস্ফুটিত ফুলটি নিশ্চয়ই সুদীর্ঘকাল আরো স্থির সম্পূর্ণতম হবার অপেক্ষাতেই ছিল। তবে কেন এসব পাপড়ি ক্ষণিকত্বের দিকে ভেসে যায়? সঠিক কোনো উত্তরই আমার জানা নেই। জানা নেই, তাঁর বুকের ভেতরের সেই সময়ের অস্থিরতার কারণও। এই যন্ত্রণা-কাতর কবিকে কেন যে আমাদের সমাজ ও আশ্চর্য রূপের সংসার কোনোভাবে সুস্থির থাকতে দেয়নি তাও জানা নেই! অথচ তাঁকে ভুলে যাওয়া নিশ্চিত আমাদেরই অপরাধ। এভাবে আমরা কতো কবিকেই যে হেলায় স্মৃতির ওপারে রেখে আসছি জানি না।

আরও পড়ুন...