Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ দা সী ন  তাঁ ত ঘ র পর্ব ৪

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

pankaj

রাত্রিশাসন অথবা মরীচিকা অন্বেষণে

কবিতা লিখতে এসে পিছনের দিকে তাকালে কোনো কিংবদন্তি কবির মুখ নয়, কয়েকটি আড্ডার কথা মনে পড়ে। নিছক আড্ডা অথবা নিছক কবিতা নিয়ে পাগলামি। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। নতুন কবিতার প্রশংসায় মন ভরে থাকে। কোনো কোনো কবিতার ব্যর্থতা আরও মনমরা বা সতর্ক করে দেয়। সদ্য প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকায় নিজের নাম দেখতে ইচ্ছে করে। কখনও কখনও বিষাদভরা মন নিয়ে প্রেরণা খুঁজতে যাই লোকাল কবির কাছে। সেখানেও জমে ওঠে আরেকপ্রস্থ আড্ডা। আড্ডা ছাড়া কবিতা নেই। তখনও মফস্সলের অনেক অঞ্চলে একটি ছোটো পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সান্ধ্য আড্ডা বসত। কোথাও শনিবার, কোথাও রবিবার। সারা সপ্তাহের লেখা উজাড় করে পড়া হত। ভালোমন্দ বিচার হত। থাকত গোপন অনেক ঈর্ষারও আয়োজন। সেইসব আড্ডায় প্রশংসিত কবিতা গোপনে খামবন্দি হয়ে চলে যেত ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে। ঘরের আড্ডা গড়াত রাস্তায়। তর্কবিতর্কে রাত বারোটা পেরিয়ে যায় কোনো কোনো দিন। শ্মশানের পাশে গঙ্গার ঘাটে,কোনো পার্কে অথবা চায়ের দোকানে জমে উঠত কবিতার নেশা। কবিতার আসরে অতর্কিতে হানা দিতে থাকে সন্দীপন অথবা সদ্য প্রকাশিত সুবিমল মিশ্র। তখনও বইমেলায় সুবিমল মিশ্র নিজেই নিজের বই বিক্রি করতেন। জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন মেলা আর নৈশ আড্ডার সুযোগ আসেনি।

আমাদের মাঝে মাঝে মনে পড়ে কিংবদন্তি কিছু আড্ডার মুহুর্ত। পঞ্চাশের দিনগুলিতে রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করত চারজন যুবক। কখনও কখনও বদলে যেত যুবকের নাম। এদের বাইরেও ছিলেন আরও কয়েকজন তরুণ কবি। কখনও কফি হাউসে কিংবা খালাসিটোলায় জমে উঠত আড্ডা। সেই অফুরন্ত আড্ডা গড়িয়ে আসত মধ্যরাতের ফুটপাতে। আড্ডা চলত মধ্যমণি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বৃন্দাবন পাল  লেনের বাড়িতেও। এই আড্ডার ফসল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা।

আলফা কাফে নয়, শতভিষা পত্রিকার প্রথম পরিকল্পনা হয়েছিল রাসবিহারী আর মহীশূর রোডের মোড়ের এক ছোট্ট চায়ের দোকানে। সেই চায়ের দোকানটি পরে হয় ঘড়ি মেরামতের দোকান। সেখানে দুই অতি তরুণ যুবক আলোক সরকার এবং দীপংকর দাশগুপ্ত পরিকল্পনা করেন পত্রিকাটির এবং তা পূর্ণ রূপ পায় আলফা কাফের আড্ডায়। সরি গলির সেই চায়ের দোকান আলফা কাফেতে তখন সাহিত্যের নিমগ্ন আড্ডা। ‘সেইখানে কবি আছে, গল্পকার আছে, চিত্রশিল্পী আছে,সঙ্গীতজ্ঞ আছে,রাজনীতিজ্ঞ আছে, আছে এমনকি খুন- জখম- ওস্তাদ গুণ্ডা।’ তবু শেষপর্যন্ত এই আড্ডার ব্রত ছিল কবিতাই।

এই তো সেদিনও কবিসম্মেলনের শেষে মধ্যরাতে শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণনগর দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ফিরলেন একদল তরুণ কবি। এই উত্তেজনার সঙ্গে কবিতার যোগ হয়তো সামান্য কিন্তু জীবনে জীবন যোগ করার এমন একটা সুযোগ তৈরি হয় কবিতার হাত ধরেই। যদিও কথাটি সুন্দর কিন্তু তা আদ্যোপান্ত সত্য নয়। বরং পিছনেই রয়েছে অনিবার্য লুপ্তপ্রায় এক ছুরি। অগোচরে হিংস্র দাঁতের মতোই মেধাবী এবং অক্ষম। প্রতারক স্মৃতির হাত ধরলেই মনে পড়ে যায় নব্বইয়ের এক কবিতাপ্রাণ  আড্ডার কথা। একটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই জড়ো হয়েছিলেন একদল তরুণ কবি। মধ্যমণি কখনও এক স্বপ্নাতুর মায়াবী জনপ্রিয় কবি। আড্ডার শেষে তিনি চোখে এঁকে দেন এক অলৌকিক স্বপ্ন। নিজের ছায়ায় বিখ্যাত হবার সাধনা। পকেটে করে নিয়ে আসেন তরুণ কবিদের কবিতা একটি বিখ্যাত পাক্ষিকে প্রকাশের জন্য। তারপর চতুর এক উদাসীনতায় হারিয়ে ফেলেন সেসব লেখা। এভাবেই কবিতার আড্ডায় ঢুকে পড়ে চাপা সন্ত্রাস। শুরু হয় পারস্পরিক ঈর্ষা। এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়। অথচ আমরা জানি শরৎচন্দ্র বা বিভূতিভূষণ, মানিক বা সুবোধ ঘোষ অনেকেই অতর্কিত আড্ডার সন্তান। খালাসিটোলার আড্ডায় রীতিমতো আবির্ভূত হতেন কমলকুমার মজুমদার। আমাদের অনেক কবিতা আড্ডা আর মধ্যরাতের সন্তান। এমনকী একদিন সংগোপনে পঞ্চাশের দুরন্ত ও দামাল কৃত্তিবাসী কবিদের নৈশ আড্ডার শরিক হতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুও। তিরিশের অনেক কবির বাড়িতেই বসত আড্ডা , ছিল তরুণ কবিদের উষ্ণ আমন্ত্রণ। মনে পড়ে বিচ্ছিন্ন এবং টুকরো কিছু পারিবারিক সাহিত্য আড্ডার মুহুর্ত যার অভিঘাত শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে বিষোদগার, এমনকী প্রচ্ছন্ন হুমকি অথবা হাতাহাতি। যে নৈশ আড্ডার জন্য বিখ্যাত পঞ্চাশের কয়েকজন কবি ও গল্পকার, যা দুর্দমনীয় এক বন্ধুত্বের উদযাপন তার পেছনেও আছে সিংহাসন দখলের গোপন রাজনীতি।ক্ষমতার  মিঠে আস্ফালন।

মোটামুটি আশির দশক থেকেই এইসব অনেক আড্ডা ঢুকে পড়ে কোনো কোনো কবির বৈঠকখানায়। ব্যক্তিগত রবিবাসরীয় বৈঠকে। কোথাও কবিতা বা ছন্দ নিয়ে সৃজনশীল পরামর্শ, কোথাও আর্থিক দীনতামোচন এবং পুরস্কারের সুযোগ, কখনও কোথাও ব্যক্তিগত বিষাদ উদযাপন। তরুণ কবির আশ্রয় আর প্রবীণ কবির প্রশ্রয়। সুযোগমতো টুনটুনির ছানা ডানা মেলে উড়ে যায়। এর পাশাপাশি মফস্সলে রয়েছে পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে আড্ডা। কবিতা নিয়ে সুযোগসন্ধানী স্বপ্নের পাশাপাশি পরনিন্দা, পরচর্চা।  মনোমালিন্য থেকে গোষ্ঠীবদল, আবার একটি নতুন পত্রিকার জন্ম। ষোলোআনা বিদ্রোহ আছে অথচ নিজের লেখাটির দেখা নেই। আত্মমুগ্ধ কবির দল নিজের লেখার বাইরে বাংলা কবিতা পড়ে না। জন্ম থেকেই কাফকার আত্মীয় , যতীন্দ্রমোহন বাগচীর  লেখা পড়তে লজ্জা পায়। এইসব বেশিরভাগ আড্ডা হয়তো আমাদের স্মৃতিময় জীবনকে অনেক আত্মমুগ্ধতা উপহার দিয়েছে কিন্তু বা়ংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে নি।

মাঝে মাঝে ছাত্রদের বলি ন্যাশনাল লাইব্রেরী নয়, জীবনে ঠিকঠাক একটি চায়ের দোকানের সন্ধান পেলে আমাদের যেকোনো গবেষণা সার্থক হতে পারে।  আমাদের কবিতা সর্বব্যাপী এবং সার্থক  হতে পারে এমন একটি চায়ের দোকান পেলে। কবিতাহীন হাজার হাটুরে মানুষে ভরা নির্জন একটি চায়ের দোকান। মানুষের দৈনন্দিন সংলাপে প্রানবন্ত। কিছুদিন আগেই চায়ের দোকানের পাশে একজন মাতাল গলা ছেড়ে গাইছিল – ‘ দয়াল তোমার বাড়ি, তোমার গাড়ি, আমরা সবাই প্যাসেঞ্জার।’ এই উত্তরাধিকারের আমাদের বড়ো প্রয়োজন ছিল। এই তো সেদিন একজন রাজমিস্ত্রি কাজের ফাঁকে স্টিলের গ্লাস হাতে চা নিতে ঢুকলেন। মুখে মুখে বলে চলেছেন- এতক্ষনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে,জানিনু কেমনে’ ইত্যাদি। ‘মেঘনাদবধকাব্যে’র কয়েকপাতা রীতিমতো মুখস্থ। তিনি কী বলছেন শোনা যাক:

” আমার পড়াশোনা যা কিছু বুঝলেন বাংলাদেশে। গ্রামের নাম গন্ধর্ব। কাউখালি থানা। পড়তাম জানকীনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রথম থিকাই কবিতায় আমি ফার্স্ট। সব কবিতা মুখস্থ বলতে পারতাম। মাইকেল, নজরুল, জসীমউদ্দীন, সুকান্ত,বন্দে আলী মিঞা। এদের কবিতা এখনও মনে আছে। তখন কবিতায় একটা ছন্দ ছিল। এখনের কবিতা তেমন না। এখনের পাইঠ্য বইগুলি যেন ক্যামন। কোনো ছন্দ নাই। সেইসব কবিও নাই। জানি নিউ জেনারেশনকে চান্স দিতে হচ্ছে…”
অতঃপর তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। এই বিলাপের উত্তরাধিকার আমাদের প্রয়োজন ছিল। অথচ আমরা তাকে কোনো কবিতার আড্ডায় ডাকিনি। এইসব রাত্রিশাসন  বা আড্ডার সাধনাকে আজও আমরা উচ্ছিষ্ট ঘোষণা করতে পারিনি।

আমাদের কবিতাকেন্দ্রিক সমস্ত আড্ডা আমাদেরই আত্মমুগ্ধতার  ইতিহাস। শেষপর্যন্ত কবিতা লিখতে যথাযথ শব্দ লাগে, চিত্রকল্প লাগে কিন্তু মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হয়, কোনো আড্ডাই আমাদের শেখায়নি।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...