Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ দা সী ন  তাঁ ত ঘ র পর্ব ৫

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

pankaj

ছোটো প্রকাশনীর অলীক বাজার

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেও ‘ বয়সে নবীন অভিজ্ঞতায় প্রবীণ’,’বর্ণাঢ্য এবং বেগবান’, ‘না লিখেই লেখক’, ‘এক কলমে দুবার লেখেন না’ এইসব বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে আমরা কত বই কিনেছি! খুঁটিয়ে দেখা হয়নি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীরবতার রাজনীতি। আমরা বিশ্বাস করেছি।লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। প্রতারণার বয়স তখন কম ছিল। বড়ো প্রকাশনী আর বড়ো লেখকের দাপটেই ভরে ছিল চরাচর। স্বপ্ন দেখার সামান্য পরিসরে ছিল প্রমা,প্রতিক্ষণ আরও দু-একটি প্রকাশনী। এই নিয়তির পাশে ছোটো পত্রিকার ব্যক্তিগত উদ্যোগের কিছু বই। বিক্রি নয় হিসেবি আত্মসমর্পণের উপহার ছাড়া তার কোনো গতি ছিল না। দৈনিক পত্রিকার দায়হীন রিভিউকে কতরকম আলো ফেলে বিশ্বাস করতে ভালো লাগত। সেই আলো অক্ষরবিহীন ঐশ্বর্যহীন অক্ষমের নিরর্থক সান্ত্বনা।

ছোটো পত্রিকা মাত্রই ছোটো প্রকাশনী হয়ে ওঠার মুদ্রাদোষ গত দশ বছরের। শেষপর্যন্ত পত্রিকার অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। কখনও কখনও বিবেক জাগ্রত হলে অথবা ধর্মবুদ্ধির টানে মাঝে মাঝে সাধারণ স়ংখ্যা হয়ে সে দেখা দেয়। তাঁরা জানে সহজ লাভের আশা থাকলে পত্রিকা করলে তার খেসারত দিতে হবে। তুলনায় ঠিকঠাক বিজ্ঞাপনে, ফেসবুকের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় ছোটো পত্রিকার বই বিক্রির সুযোগ অনেক বেশি। সত্যি কথা বলতে কী ইদানিং ছোটো পত্রিকার বই বিক্রির সম্ভাবনাময় এবং আশাপ্রদ বাজার তৈরি হয়েছে।বই মাফিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি বিশ্বাসযোগ্য জমি তৈরি হয়েছে। আমরা আমাদের কথা সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি। মান্য পত্রিকার রুচিহীন বিপথগামী দুর্বল কবিতার পথ থেকে অনেক পাঠক সরে এসেছেন ছোটো প্রকাশনীর প্রকৃত কবিতার কাছে। এই লড়াইয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। হয়তো আত্মপ্রতিষ্ঠার থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকে জোর দিতে হবে বেশি। সমূহ ফাঁদ এড়িয়ে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে অনেক বেশি।

দায়িত্ব। হ্যাঁ দায়িত্ব। ছোটো প্রকাশনীর পুঁজি কম, দায়িত্ব অনেক। কোনো জনপ্রিয় লেখকের বাঁ হাতের লেখা ছেপে বানিজ্য করা তার কাজ হতে পারে না। বিস্মৃত গুরুত্বপূর্ণ লেখকের পুনরুদ্ধার জরুরি। নীরবতার রাজনীতির শিকার লেখকের রচনার পুনর্মুদ্রণ জরুরি। সম্ভাবনাময় সাম্প্রতিক লেখকের রচনা প্রকাশে সতর্ক খোঁজ জারি রাখতে হবে। শুধুমাত্র মনে রাখা দরকার লগ্নিকৃত অর্থ যেন লাভ সহ ফেরত আসে। ব্যবসা উদ্দেশ্য নয় কিন্তু পুঁজি যেন বেহাত না হয়। প্রকাশনী না বাঁচলে এই লড়াই সফল হবে না। শুধু বিনিয়োগ করার আগে মনে রাখতে হবে আপনি কীভাবে কতদিনে টাকা ফেরত চাইছেন? হটকেকের প্রতি সন্দেহ এবং গোপন উচ্চাশা একই সাথে না রাখাই ভালো।

সম্প্রতি চতুর প্রকাশকের মতো অনেক ছোটো প্রকাশনী লেখকের অর্থের বিনিময়ে বই প্রকাশ করছেন। তাতে আপত্তির হয়তো কিছু নেই। কিন্তু তা যদি নেহাত ব্যবসা হয়, বইয়ের যদি ন্যূনতম মেধা না থাকে তা রীতিমতো বিপজ্জনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য এইসব বই ডিসপ্লে হয় না। এমনকী ক্যাটালগের অন্তর্ভুক্তও হয় না। তবু এই মনোধর্ম রুচিহীন। তা একধরনের প্রতারণা। অবশ্য দিকে দিকে স্বভাবকবি আই এ এস অফিসার, আধিকারিকদের অতি স্পর্শকাতর দুর্বল হৃদয়ের কাছে আত্মসমর্পণ অনেকখানি আর্থিক নিরাপত্তা দেয় – যেকোনো ছোটো পত্রিকার সম্পাদক এবং ছোটো প্রকাশনীর প্রকাশকমাত্রই জানেন। তবু মনে রাখতে হবে ছোটো প্রকাশনীর এই অলীক বাজার মূলত ফেসবুক নির্মিত এবং এই সুখের সংসার চিরস্থায়ী হবে না। আমাদের আরও অনেক বিকল্প লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিস্মৃত লেখকের ফানুস-আসনটিকে পাঠক একদিন প্রশ্ন করতে শিখবেন। তখন অপ্রস্তুত অস্ফুট শব্দটি যেন যেকোনো স্বীকারোক্তির জন্য প্রস্তুত থাকে।

যে বিজ্ঞাপনের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল সেখানে ফেরা যাক। বড়ো প্রকাশনীর বিজ্ঞাপন এবং ছোটো প্রকাশনীর বিজ্ঞাপন এবং বানিজ্যিক কৌশলে তফাত আছে। বানিজ্যিক স্বার্থে বড়ো প্রকাশনী বিজ্ঞাপন দেয়। ছোটো প্রকাশনীকে মাথায় রাখতে হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস। আর এখানেই তৈরি হয় এক ধরনের বিরোধ।নীচু অভিমান। মনে রাখতে হবে ছোটো পত্রিকার বিজ্ঞাপন মূলত ফেসবুক নির্মিত। পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া। বিজ্ঞাপন নয় বিজ্ঞাপনের মুখোশটিকে প্রশ্ন করা উচিত ছোটো প্রকাশনীর। খেয়াল করলেই দেখা যাবে বেশিরভাগ ছোটো প্রকাশনীর প্রকাশক মূলত সম্পাদক,কবি বা লেখক। ফলে তাঁদের রুচির সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বিরোধ আছে। সেখানে ব্যবসার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট প্রকাশক নীরব এবং তাঁর পাঠরুচির বাইরে সমস্ত ক্ষেত্রে আক্রমণকারী। প্রশ্ন উঠবে তিনি পাঠক হিসেবে যে লেখাকে প্রত্যাখ্যান করেন সেই লেখার সপক্ষে নিজের প্রকাশনীর জন্য বিজ্ঞাপন দেন কোন রুচিতে? যদি এতে কোনো বিরোধ না থাকে তাহলে সমস্যা নেই। না হলে প্রকাশক হিসেবে পাঠরুচির প্রতি তিনি যেন নমনীয় থাকেন। নিজেকে চিন্তক প্রমাণ করার সমস্ত দরজাগুলি বন্ধ করে রাস্তায় নামতে হবে।

সম্প্রতি একটি লিটিল ম্যাগাজিন মেলা ফেরত একজন প্রকাশক ঘোষণা করেছেন তিনি আর সহজে কবিতার বই করবেন না। কবিতার বই বিক্রি হয় না। কথাটা সত্যি। আরও সত্যি কবিতার বই এবং ভৌতিক অমনিবাসের পার্থক্য চিনতে শেখা। রুচি এবং বানিজ্যের ভারসাম্য না থাকলে ছোটো পত্রিকা এবং প্রকাশনীর হাতে বিকল্প কোনো রাস্তা থাকার কথা নয়।আমি মনে করি যেকোনো প্রকাশকের লগ্নি অর্থ লাভ সহ ফেরত আসা উচিত। তাঁর কারণ এটা তাঁর জীবিকা, তাঁরও সংসার আছে এবং পরবর্তী অন্যান্য বই প্রকাশের জন্য লভ্যাংশ জরুরি। এবং তা নির্ভর করছে প্রকাশকের মনোধর্মের উপর। তিনি কী চাইছেন? যদি বই প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে তিনি টাকা ফেরত চান তাহলে কবিতা, ভালো গল্প, সিরিয়াস উপন্যাসের পেছনে না দৌঁড়োনোই ভালো। সেক্ষেত্রে ভৌতিক,হরর,রান্নার বই,ক্যুইজসমগ্র,শত মনীষী শত জীবনী,এই জাতীয় বই করাই উচিত। অথবা দরকার নীহাররঞ্জন গুপ্ত, শক্তিপদ রাজগুরু,নারায়ন সান্যাল, বুদ্ধদেব গুহ, শংকর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের মতো লেখকের যাঁদের লেখার স্থায়ী পাঠক আছেন। এবং তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো অপরাধ। কবিতা, ভালো গল্পের বই, এবং ভালো উপন্যাস থেকে টাকা তুলতে হলে প্রকাশককে অন্তত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কবি- লেখক মাত্রই আত্মমুগ্ধ, তাই কোন বইয়ে অর্থ লগ্নি করবেন এ বিষয়ে প্রকাশককেই সতর্ক সমীক্ষা করতে হবে। আর একটি কথা, ইদানিং ছোটো পত্রিকা এবং প্রকাশনীর সামান্য বিশ্বাসযোগ্য বাজার তৈরি হয়েছে। তা দেখে আপ্লুত হলে চলবে না। এই বাজারটি বেশ ঘোলাটে। এখানে কে কবি,কে শ্রোতা,কে পাঠক,কে মেধাবী ভ্রমণকারী তা বুঝতেই আরও দশ বছর লাগবে। তবু বলব এই অলীক বাজারটিকে সমস্ত সম্ভাবনা দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে এখনই।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...